আশিকের স্টুডিও: ট্রাম্প-পুতিনের ঢাকাস্থ আড্ডাখানা!

শিল্পী আমিনুল ইসলাম আশিকের প্রিয় বিষয় হলো মুখ। চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে মুখ গড়ার নেশায় পড়ে যান তিনি। ২০১২ সালে গড়েন বিরাট একটি মুখের অবয়ব। পরে তার ওপর ছোট ছোট অসংখ্য আলোকচিত্র সেঁটে দেন। সেগুলো ছিল তার নিজের সারাদিনের বিভিন্ন সময়ের মুখচ্ছবি। ওই বছরের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন এই শিল্পকর্ম নিয়েই।
সার্টিফিকেটে ২০১২ সাল হলেও আশিকের এমএফএ (মাস্টার অব ফাইন আর্টস) শেষ হয়েছে ২০১৪ সালে। ২০১৩ সালে তিনি বৃত্ত আর্ট ট্রাস্টের স্টুডেন্ট রেসিডেন্সি শিল্পবৃত্তি পান। সেই বৃত্তির অধীনে যান নেপালে। দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডুর বিন্দু আর্ট স্পেস ছিল তার কর্মক্ষেত্র। এক মাস ছিলেন সেখানে। নেপালের সরোগঙ্গা দর্শনধারী ও পৃথিবী শ্রেষ্ঠা ছিলেন তার সতীর্থ। মোটমাট ২২টি মুখ গড়েছিলেন সেবার। তার মধ্যে কেবল পৃথিবী শ্রেষ্ঠারই ছিল ২০টি। নেপালের রেসিডেন্সি তার কাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
মুখ সবারই আছে
সব বাদ দিয়ে মুখ কেন? জিজ্ঞেস করায় আশিক বলছিলেন, 'মুখের মধ্যেই মানুষের হাসি-খুশি, রাগ-ক্ষোভ, বেদনা-দুঃখ, ভাবনা-চিন্তা, ভালোবাসা-ঘৃণা সব ধরা থাকে। তাই মুখের মধ্যেই আমার মনোযোগ নিবদ্ধ হলো। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ হয়ে উঠলেন আমার পর্যবেক্ষণের বিষয়। ধনী-গরিব, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ সবারই মুখ আছে। সুসময় ও দুঃসময়ে সবাই হেসে বা কেঁদে ওঠে আর তার প্রকাশ ঘটে মুখে।'
আরেকটি যে বিষয় বাস করে মুখে সেটি হলো ক্ষমতা। অবস্থাভেদে সবারই কিছু না কিছু ক্ষমতা আছে। তবে 'ক্ষমতা' আশিকের বিষয় হয়ে উঠতে কিছু সময় নিয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রথম এর প্রকাশ দেখা যায়। আর তখন থেকে এটিই হয়ে উঠেছিল আশিকের কেন্দ্রীয় বিষয়।

তাদের ইচ্ছাই সব
২০১৮ সালে আশিকের 'ক্ষমতা' সিরিজের চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন। ওই বছরই সিঙ্গাপুরে ট্রাম্প আর কিমের মধ্যে ঐতিহাসিক এক বৈঠক হয়েছিল।
বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেছিলেন, 'আমরা প্রেমে পড়েছি।' কিন্তু তার এই কথার কোনো ধারাবাহিকতা বিশ্ববাসী দেখতে পায়নি। দুজনে আগের মতোই তাদের ক্ষমতার খাঁচায় বন্দি থেকেছেন। ক্ষমতা খাঁচাবন্দি করেছিল মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকেও। তার দল যখন ক্ষমতায়, তখনই লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুহারা হয়েছিল।
আশিক অফিস করার মতো নিয়ম করে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত স্টুডিওতে কাজ করেন। গড়ে চলেন ক্ষমতাবান তথা বিশ্বনেতাদের মুখাবয়ব। যুদ্ধ, শান্তি, হিংসা, অহিংসা, জীবন ও মৃত্যু সব ওই নেতাদের ইচ্ছার অধীন। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে তারা ২০-২৫ জন হবেন মোটে। কিন্তু তাদের কারসাজিতে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাস্তুহারা হতে হয়, ফিলিস্তিনিদের না খেয়ে মরতে হয়, আফ্রিকায় গরিবের সংখ্যা বাড়ে। এ দলের নেতৃত্ব দেন ট্রাম্প, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। তাদেরই ঢাকাস্থ আড্ডাখানা হলো আশিকের স্টুডিও!

স্টুডিওটা একটা কারখানা ঘরের মতো। চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা এ স্টুডিওর মাথায় টিনের ছাদ। সেখানে ওয়েল্ডিং মেশিন, করাত, হাত কুঠারসহ রয়েছে নানা জিনিস। আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদ পার হয়ে আমতলায় এই স্টুডিও। আশিক ফাইবার গ্লাস, কপার বা কাঠ দিয়ে নেতাদের মুখ গড়ে বিশ্বের ক্ষমতাচিত্র দৃশ্যমান করেছেন। গেল মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অনুষ্ঠিত আশিকের একক প্রদর্শনীর কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল 'পাওয়ার'।
মনোযোগী আর অধ্যবসায়ী
শিল্পের প্রতি আশিকের অনুরাগ তৈরি হয় সেই ছোটবেলায়। পত্রিকায় ছাপা কার্টুন আর বইয়ের অলঙ্করণ তাকে আকৃষ্ট করত। বিটিভিতে মোস্তফা মনোয়ারের 'মনের কথা' অনুষ্ঠানটি দেখে কৌশল শিখতেন, রঙের ব্যবহার জানতেন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় রবীন্দ্র-নজরুলের পোর্ট্রেট এঁকে শিক্ষকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।

অন্যসব বাবা-মায়ের মতো আশিকের বাবা-মাও চেয়েছিলেন তার ছেলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক। তাকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তিও করানো হয়েছিল। কিন্তু আশিকের ইচ্ছা আর্টস পড়ার। শেষে বাবা-মা হার মানলেন। আশিক আর্টিস্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলেন। প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষা দেননি, দ্বিতীয়বার পুরো নয় মাস কোচিং করলেন। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে। পড়া শেষ করেছিলেন অনুষদের সবার মধ্যে প্রথম হয়ে।
আশিকের শিক্ষক ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান বলেন, 'শিল্প জীবনের কথা বলে, এটা আশিকের কাজে আরো বেশি করে বোঝা যায়। সে আমার সরাসরি ছাত্র। চারুকলায় অধ্যয়নের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন মনোযোগী আর অধ্যবসায়ী। তাই আয়ত্ত্ব করতে পেরেছে অনন্য দক্ষতা ও সৃজনীশক্তি। তার শিল্পকর্মে মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ তবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্ট বা ভাবনা।'

যখন একটি চেয়ারও শিল্প
আশিকের জন্ম মাদারীপুরের শিবচরে, ১৯৮৮ সালে। ছোটবেলা থেকেই তিনি গোছালো আর সুবোধ। যা করতেন, মন দিয়েই করতেন। চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর প্রতিদিন সকাল ৭টায় চলে যেতেন ক্যাম্পাসে। তখনো ক্লাস শুরু হওয়ার তিন ঘণ্টা বাকি থাকত। আশিক আগের দিনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে বসতেন অথবা নতুন কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিতেন।
চারুকলা থেকে পাশ করার পর বৃত্ত হয়ে উঠল তার নতুন একাডেমি। সেখানে মাহবুবুর রহমানকে দেখে বিস্মিত হতেন। এমন কোনো মাধ্যম নেই যাতে তিনি দক্ষ নন। ভাবনা প্রকাশে যে মাধ্যম প্রয়োজন তা-ই তিনি আয়ত্ত্বে আনতে পারেন, সেটা হতে পারে কাইনেটিক বা মুভিং অবজেক্ট, ইনস্টলেশন, ভিডিও আর্ট অথবা সফট স্কাল্পচার।

মাহবুবুর রহমানের কাজ দেখে ও আলাপচারিতার মাধ্যমে আশিকের ভাবনা সমৃদ্ধ হয়। কনসেপচুয়াল আর্টে আরো মনোনিবেশ করেন। আশিক বুঝতে পারেন একটি চেয়ারও শিল্প হয়ে উঠতে পারে যদি তার মধ্যে কনসেপ্ট যুক্ত হয়।
মাহবুবুর রহমান আশিকের শিল্পকর্ম নিয়ে লিখেছেন, 'ভাবনা ও ভাষ্য দিয়ে তাড়িত হয় তার শিল্পকর্ম। ভাবনা প্রকাশের সুবিধার্থে কখনো কখনো উপকরণের নিজস্বতা অটুট রাখেন, আবার কখনো তার রূপান্তর ঘটান।'
শিল্পী ও শিল্প লেখক মোস্তফা জামান লিখেছেন, 'চরিত্রগুলো বিশ্বমঞ্চের খেলোয়াড় হলেও আশিক তাদের হাটুরে হিসেবে উপস্থাপনের সাহস করেন। রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রকৃতি বুঝতে সমাজে পেতে রাখা ফাঁদগুলো খুঁজে বের করেন তিনি।'

আশিকের প্রবণতা হলো খুঁড়ে খুঁড়ে দেখা এবং একটি বস্তুর সঙ্গে আরেকটি বস্তুর সংযোজন ঘটানো। দুটি বস্তুর সমন্বয়ে নতুন কোনো অর্থ দাঁড়ালে নিজেই চমকে যান। যেমন, তিনি মুখের একটি ভাস্কর্যের ঊর্ধ্বভাগে চেয়ার বসিয়ে দেখলেন অর্থ বদলে যাচ্ছে। ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠছে চেয়ার।
চাকরি কেন করবেন?
অনুষদে প্রথম হয়ে, পুরস্কার আর প্রশংসা পেয়েও নিশ্চিত জীবন পেলেন না আশিক। তিনি চাকরির উদ্দেশে গেলেন কৃষি ভবনে। সেখানে গিয়ে দেখা হয় হুমায়রা কলির সঙ্গে। তিনিও চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করেছেন। তিনি অবশ্য আশিকের জুনিয়র।

হুমায়রা কলি বললেন, 'আশিক ভাই আপনি এত ভালো কাজ করেন, চাকরি কেন করবেন? আপনি প্লিজ স্বাধীনভাবে কাজ করে যান।'
তারপর থেকে আশিকের সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো কলির। কিছু একান্ত কথাও হলো। দুজনের মনের মিল হয়ে গেলে বিয়েটাও সেরে নিলেন। এতে তাঁর জীবনে স্থিতি আসে এবং শিল্পের সাধনা সহজ হয়।
২০১৫ সালে আশিক জাপানের কিয়োটোতে একটি আর্ট রেসিডেন্সিতে গিয়েছিলেন। জাপানে তিনি সূক্ষ্ম কলাকৌশল, উপকরণের সৌন্দর্য ও সেফটি বিষয়ে অবগত হয়েছেন।
আশিক বলছিলেন, 'আমাকে দেখলে আর্টিস্ট মনে হয় না অনেকের। বড় চুল-দাড়ি আমার পছন্দ নয়। কালি-ঝুলি মেখে কাজ করাও পছন্দ করি না। রাত জাগি না, ভোরে উঠতে পছন্দ করি। স্টুডিওতে কাজ করি অফিস করার মতো।'

ওগো দয়াময়
ক্ষমতা যে সবারই আছে, বেশি বা কম, তার প্রকাশ আশিকের দুই ভিক্ষুকের জায়গা নিয়ে ঝগড়ায়। জায়গার দখল নিয়ে দুজনেই হাত উঁচু করে শাসাতে থাকেন। শেষে একজন পরাজিত হন। বাধ্য হন জায়গা ছেড়ে দিতে। তার আর কিছু করার থাকে না। হাত তোলেন আকাশের দিকে, বিচার দেন দয়াময়ের কাছে। তৈরি হয় আরেকটি ভাস্কর্য।
ক্ষমতা আছে প্রতারক বা ছদ্মবেশীরও। সে স্যুট-কোট পরে রিকশায় বসা, হাতে মোবাইল ফোন, কিন্তু মুখটা ছাগলের। আশিকের এ শিল্পকর্মের নাম 'পাওয়ার অব হিপোক্রেট'।

'মায়ের দোয়া' নামে আশিকের আরেকটি স্থাপনা শিল্প আছে। এতে কয়েকটি পিলো একটির ওপর আরেকটি বসানো। লোহার রড দিয়ে এগুলো গাঁথা, বিদ্যুতায়িত করলে কেঁপে কেঁপে ওঠে, শহরের বাড়িগুলোর প্রতীক এই স্থাপনা শিল্প। আমাদের দেশে বাড়ির ব্যবসা করার ক্ষমতা রাখেন কেবল ক্ষমতাবানেরা। বাড়িগুলো তারা ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি করেন না। তাই মায়ের দোয়াই শেষ ভরসা।
সব সত্ত্বেও নৈরাশ্য আশিকের শেষ কথা নয়। বুড়িগঙ্গার সাকার ফিশ নিয়ে তিনি ব্রোঞ্জে যে শিল্পকর্ম গড়েছেন, তাতে অনেকগুলো মাছ ভেলায় চড়ে ভেসে যাচ্ছে। তার এই শিল্পকর্মের নাম 'ফ্লো অব ড্রিমস'।
সবশেষে তিনি এটিও বলেন, 'ক্ষমতা কেবল সংঘর্ষ তৈরি করে না, সংঘর্ষ থামায়ও। রক্ষা করে মানবতা।'

ছবি সৌজন্য: এআরকে রীপন/আর্টকন/সালেহ শফিক