‘ট্রোজান হর্সের পর সবচেয়ে চতুর কৌশল’: যে সোভিয়েত শিল্পকর্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করেছিল
১৯৪৫ সালে এক শিল্পকর্মের ভেতরে লুকানো একটি গোপন আড়ি পাতার যন্ত্র (লিসেনিং ডিভাইস) সাত বছর ধরে মার্কিন নিরাপত্তাকর্মীদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এটি শিল্পকর্মকে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহার করার প্রথম ঘটনা ছিল না। খবর বিবিসি'র।
প্রায় আশি বছর আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে রাশিয়ার বয় স্কাউটদের একটি দল মস্কোতে অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবন 'স্পাসো হাউস'-এ হাতে খোদাই করা 'গ্রেট সীল' উপহার দেয়। যুদ্ধকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রদূত ডব্লিউ. অ্যাভারেল হ্যারিম্যান গর্বের সঙ্গে এটি গ্রহণ করেন এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার বাসভবনে টাঙিয়ে রাখেন।
রাষ্ট্রদূত ও তার নিরাপত্তা দল জানতেন না, সেই সীলমোহরের ভেতরে ছিল একটি গোপন আড়ি পাতার যন্ত্র। পরে মার্কিন প্রযুক্তি দল এটিকে 'দ্য থিং' নাম দেয়। সাত বছর ধরে এটি চুপিচুপি কূটনৈতিক কথাবার্তা শুনত, অথচ কেউ বুঝতেই পারেনি।
একটি সাধারণ শিল্পকর্মের ভেতরে এমন যন্ত্র লুকিয়ে শত্রুপক্ষের গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছিল সোভিয়েতরা। এটি যেন ট্রয়ের যুদ্ধে ওডিসিয়াসের সেই 'ট্রোজান হর্স'-এর মতো বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল, তবে পার্থক্য হলো—এটি গল্প নয়, সত্য ঘটনা।
'দ্য থিং' যেভাবে কাজ করত
৭৯ বছর বয়সী কাউন্টার-সারভেইলেন্স বিশেষজ্ঞ জন লিটল বহু বছর ধরে 'দ্য থিং'-এর প্রযুক্তিতে মুগ্ধ। তিনি এমনকি এর একটি নকলও তৈরি করেছেন। এ বছর তার এই অসাধারণ কাজ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। মে মাসে প্রথম প্রদর্শনীতর সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর এটি বাকিংহ্যামশায়ারের ব্লেচলি পার্কে 'ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব কম্পিউটিং'-এ প্রদর্শিত হবে।
জন লিটল 'দ্য থিং'-কে সঙ্গীতের ভাষায় ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, এটি ছিল অর্গান পাইপের মতো নল দিয়ে তৈরি, আর একটি পর্দার আবরণ ছিল ঢোলের মতো, যা মানুষের কণ্ঠ শুনে কাঁপা শুরু করত। তবে পুরো যন্ত্রটি এতটাই ছোট ছিল যে, দেখতে প্রায় টুপির পিনের মতো। এর বড় সুবিধা ছিল—কোনো ইলেকট্রনিক অংশ ছিল না, ব্যাটারি লাগত না, আর তাপে গরমও হতো না। ফলে এটি সহজেই নজর এড়িয়ে চলতে পারত।
এমন যন্ত্র তৈরি করা ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম প্রকৌশলের কাজ; 'একদিকে সুইস ঘড়ির মতো নিখুঁত, আর অন্যদিকে মাইক্রোমিটার মতো সূক্ষ্ম।' ইতিহাসবিদ এইচ. কিথ মেলটন বলেন, 'দ্য থিং আড়ি পেতে শোনার প্রযুক্তিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, যা আগে কেউ কল্পনাও করতে পারত না।'
স্পাসো হাউসে 'দ্য থিং' তখনই কাজ করত, যখন কাছের একটি ভবনে রাখা রিমোট ট্রান্সিভার চালু করা হতো। এটি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির সিগন্যাল পাঠাত, যা আড়ি পাতা যন্ত্রের অ্যান্টেনা থেকে আসা কম্পনকে প্রতিফলিত করত।
১৯৫১ সালে এক ব্রিটিশ সেনা রেডিও অপারেটর মস্কোতে কাজ করার সময় ভুলবশত ঠিক সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যে রেডিও টিউন করলেন যা 'দ্য থিং'-এ ব্যবহার হতো। তখন তিনি দূরের একটি ঘরের কথোপকথন শুনতে পেলেন। পরের বছর, মার্কিন প্রযুক্তিবিদরা তিন দিন ধরে রাষ্ট্রদূতের বাসভবন তল্লাশি করার পর বুঝলেন, হাতে খোদাই করা গ্রেট সীল আসলে একটি আড়ি পাতার যন্ত্র, যা রাষ্ট্রদূতের গোপন আলোচনার সব আওয়াজ শুনছিল।
শিল্পকর্ম দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি
'দ্য থিং'-এর সাফল্য নিয়ে এক রুশ প্রযুক্তিবিদ ভাদিম গনচারভ বলেন, 'দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের দেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে সক্ষম হয়েছিল, যা কোল্ড ওয়ারের (স্নায়ুযুদ্ধ) সময় আমাদের কিছু সুবিধা দিয়েছিল।' এখনও কেউ ঠিক জানে না, সেই সময়ে পশ্চিমের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির জন্য কতগুলো 'থিং' ব্যবহার করা হয়েছিল।
তবে এটি সফল হওয়ার প্রধান কারণ শুধু প্রযুক্তি নয়, বরং মানুষের সুন্দর জিনিসকে নিরীহ ভাবার বিশ্বাসকে ব্যবহার করেই এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়েছিল। সাধারণত শিল্পকর্ম বা সাজসজ্জার জিনিসকে নিরীহ মনে করা হয়—সেটিকে কেবল মর্যাদা, রুচি বা সাংস্কৃতিক আগ্রহের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। রুশ গোয়েন্দারা এই বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তাদের খোদাই করা মেপল কাঠের গ্রেট সীলকে একটি আড়ি পাতার যন্ত্রে পরিণত করেছিলেন।
শিল্পকর্ম শুধু সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার জন্যই ব্যবহার হয়নি, অনেক সময় গোয়েন্দাগিরি, ছদ্মবেশ এবং সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। ইতালির বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি শুধু মোনালিসা আঁকেননি, ট্যাংক ও অস্ত্রের নকশাও এঁকেছিলেন। পিটার পল রুবেন্স ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা ছদ্মবেশ ও গোপন মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শিল্প ইতিহাসবিদ অ্যান্থনি ব্লান্টও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধের শুরুতে সোভিয়েত গুপ্তচর ছিলেন।
'দ্য থিং'-এর সঙ্গে সঙ্গীতের ইতিহাসও জড়িত। এর উদ্ভাবক লেভ সারগিভিচ টারমেন, যাকে মূলত লিও থেরেমিন নামে চেনে সবাই—তিনি ছিলেন রাশিয়ার এক উদ্ভাবক এবং মেধাবী সংগীতজ্ঞ। তিনি বিশ্বের প্রথম বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যা তার নাম অনুসারে থেরেমিন নামে পরিচিত। এটি স্পর্শ না করেই বাজানো যায় – এর অ্যান্টেনার চারপাশে হাতের চলাচল দিয়ে সুর নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ১৯৫০-এর দশকে থেরেমিনের রহস্যময় সুর আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন সিনেমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়, বিশেষ করে 'দ্য ডে দ্য আর্থ স্টুড স্টিল' (১৯৫১)-এ। এই সিনেমাটিকে অনেকেই স্নায়ুযুদ্ধের আতঙ্কের গল্প হিসেবে দেখেন।
'দ্য থিং' খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সম্পূর্ণ গোপন রাখে। কিন্তু ১৯৬০ সালের মে মাসে, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সময়, একটি আমেরিকান ইউ-২ গুপ্তচর বিমান রাশিয়ার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এরপর কূটনৈতিক উত্তেজনার সময় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় 'গ্রেট সীল' দেখিয়ে প্রমাণ করতে চান, স্নায়ুযুদ্ধের সময় গুপ্তচরবৃত্তি একপাক্ষিক ছিল না।
একজন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে গুপ্তচর প্রবেশ করা নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এত বড় লজ্জা ছিল যে, জন লিটল মনে করেন, 'একটি গুপ্তচর বিমান ভূপাতিত না হলে দ্য থিং জনসাধারণের সামনে আসত না। তবে 'দ্য থিং'-এর আসল প্রযুক্তিগত চমক কখনো সাধারণ মানুষকে দেখানো হয়নি।
দ্য থিং-কে গোপনে ব্রিটিশ কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স গভীরভাবে পরীক্ষা করেছিল এবং তারা এটির নাম দিয়েছিল 'এসএটিওয়াইআর' (স্যাটায়ার), যা মূলত সাংকেতিক নাম। এর সব তথ্য সরকারিভাবে গোপন থাকলেও, ১৯৮৭ সালে সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তা পিটার রাইট তার স্মৃতিকথা 'স্পাইক্যাচার'-এ সব খুলে বলেন।
'দ্য থিং'-কে ইতিহাসবিদরা আগ্রহের সঙ্গে দেখেছেন কারণ এটি সেই সময়ের জন্য খুব উন্নত প্রযুক্তির ছিল এবং স্নায়ুযুদ্ধের গুপ্তচর কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছিল। তবে এটি দেখায়, উচ্চ সংস্কৃতির আড়ালে কিছু অজানা ও অন্ধকার দিকও ছিল—অপেরা হাউস বা আর্ট গ্যালারিতে শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীরা আড়ি পাতার যন্ত্র তৈরি করতেন এবং হাতের খোদাই করা শিল্পকর্মও সামরিক গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহার হতো।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়
