চট্টগ্রাম কাস্টমসের অধীনে বিলাসবহুল গাড়ি যেভাবে বিকল স্ক্র্যাপে পরিণত হচ্ছে

জাপান থেকে সুজুকি ব্র্যান্ডের একটি প্রাইভেট কার চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। তবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস খালাস না দেওয়ায় পরবর্তীকালে একাধিক নিলামেও গাড়িটি বিক্রি করা যায়নি। গত ৩০ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমসের পুরনো অকশন শেডে খোলা আকাশের নিচে পড়েছিল গাড়িটি। এ গাড়ির যন্ত্রপাতি চুরি হয়েছে এবং মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্ক্র্যাপ করে নিলামে ২৪.২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
শুধু এই গাড়িই নয়, বিলাসবহুল প্রাইভেট কার, ট্রাক, ডাম্প ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ৭৪টি যানবাহনের শেষ পরিণতি হয়েছে স্ক্র্যাপ হিসেবে। আনুমানিক ৭০ কোটি টাকা মূল্যের এসব গাড়ির ১৪৭.৬৮ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ বিক্রি করে কাস্টমস পেয়েছে ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব গাড়ির আমদানিকারক কারা, কয়বার নিলামে উঠেছে, কেন নিলামে বিক্রি হয়নি, এসবের কোনো নথিই কাস্টম হাউসের কাছে নেই।

নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ অবাস্তব রিজার্ভ মূল্য
এসব গাড়ি ব্যক্তিগতভাবে আমদানি করা হলেও নানা কারণে আমদানিকারকেরা সেগুলো বন্দর থেকে খালাস করতে পারেননি। এক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন হলো—তাহলে এসব গাড়ি ন্যায্য বা কম মূল্যে বিক্রি না করে বছরের পর বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেওয়া হলো কেন? এর বড় কারণ- অবাস্তব রিজার্ভ মূল্য।
কাস্টমসের আইনি বেড়াজালে বিলাসবহুল গাড়ির এ পরিণতির ঘটনা শুধু এটিই নয়, কারনেট সুবিধায় দেশে আসা ১১২টি বিলাসবহুল গাড়ির ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে।
কারনেট ডি প্যাসেজ সুবিধার আওতায় ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশে আসা মর্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, জাগুয়ার, টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, রেঞ্জ রোভার, মিতসুবিশি, ফোর্ড ও লেক্সাসের মতো ব্র্যান্ডগুলোর ১১২টি বিলাসবহুল গাড়ি ২০১৬ সাল থেকে একে একে অন্তত ৮ বার নিলামে তুলেছিল কাস্টমস। তবে প্রতিবারই নিলামে দাম ধরা হচ্ছিল গাড়ি প্রতি ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত।

সবশেষ ২০২২ সালের নিলামে এসব গাড়ির রিজার্ভ মূল্য ১৮০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও ১১২টি গাড়িতে দাম ওঠে মাত্র ১৭ কোটি টাকা।
অবশেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশে এসব গাড়ি বিক্রি করা হয়, যেখানে মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের গাড়ি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়।
আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ কীভাবে আকাশছোঁয়া রিজার্ভ মূল্য নিলামে অচলাবস্থা তৈরি করে, তা স্পষ্ট করছে। যেমন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা হয় ৩০টি এসইউভি গাড়ি (ল্যান্ড ক্রুজার জেডএক্স, ৩৩৪৬সিসি)।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এসব গাড়ি খালাস না নেওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৪টি গাড়ি অনলাইন নিলামে তোলে কাস্টমস। উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় নিলাম স্থগিত করে কাস্টমস।
অত্যধিক মূল্যায়ন খরচ
শুল্কমুক্ত সুবিধায় জাপান থেকে প্রতিটি গাড়ি আনা হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। এসব গাড়ির দাম সর্বোচ্চ ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা উঠলেও বিভিন্ন আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে গাড়িগুলো বিক্রি করেনি কাস্টমস। গত জানুয়োরিতে অনলাইন নিলামে তোলা এসব গাড়ির আমদানি মূল্যের সাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নির্ধারিত ৮২৬ শতাংশ শুল্ককর যোগ করে প্রতিটি গাড়ির রিজার্ভ মূল্য নির্ধারণ করে ৯.৬৭ কোটি টাকা।

গাড়ির নিলাম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকল্স ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএআরভিআইডিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. হাবিব উল্লাহ ডন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সাড়ে ৯ কোটি টাকার যে রিজার্ভ মূল্য ধরা হয়েছে, এ দাম দিয়ে যদি শতবার নিলাম ডাকা হয়, তবুও একটি গাড়িও বিক্রি হবে না।'
তিনি বলেন, 'দেশে ল্যান্ড ক্রুজার জেডএক্স ব্র্যান্ডের রিকন্ডিশন্ড গাড়ি অর্থাৎ আরো দুই, তিন বছরের পুরনো হলে সেগুলো ৪ থেকে ৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। এমপিদের আনা গাড়িগুলো শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা হয়েছিল। এগুলো খালাস হলে সরকার কোনো শুল্ক পেত না। এখন গাড়িগুলোর শুল্ক কম ধরে যদি পুনরায় মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তাহলে দ্রুত বিক্রি হতে পারে।'
এসইউভি গাড়িগুলোর মধ্যে কিছু গাড়ির দর উঠেছিল ১ লাখ টাকা। আবার একটি গাড়ির দর উঠেছিল ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। তবে বিভিন্ন আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে গাড়িগুলো বিক্রি করেনি কাস্টমস।
এমপিদের আনা গাড়ির মধ্যে একটি গাড়ির জন্য সর্বোচ্চ ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা দর উল্লেখ করেছিলেন এস এম আরিফ নামের এক ব্যবসায়ী। কাস্টমসের নিয়ম অনুযায়ী রিজার্ভ মূল্যের ৬০ শতাংশ দর না পড়ায় গাড়িটি বিক্রি হয়নি। অথচ শো-রুমে এই দামে এই রকম একটি গাড়ি পাওয়া যায়। পরে সর্বোচ্চ দরের ১০ শতাংশ অগ্রিম বাবদ অর্থাৎ ৩১ লাখ টাকার ব্যাংক ড্রাফট দুই মাস পর এই ব্যবসায়ীকে ফেরত দেয় কাস্টমস।

কাস্টমস আইন অনুযায়ী, প্রথম নিলামে সংরক্ষিত মূল্যের ৬০ শতাংশ উঠলে পণ্য বিক্রি করতে পারে কাস্টম। দ্বিতীয় নিলামে প্রথম নিলামের চেয়ে কেউ বেশি দাম দিলে সেটি বিক্রি করে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
নিলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় নিলামে গাড়ি তুললে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কম দামে গাড়ি বিক্রি হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। দরদাতারা সিন্ডিকেট করে প্রথম নিলামে গাড়ির দর দিয়েছেন। যাতে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় নিলামে কম দামে গাড়ি ক্রয় করা যায়। আইনি বাধ্যবাধতায় গাড়িগুলো যাতে কম দামে বিক্রি করতে না হয়, এজন্য এনবিআরের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
কিন্তু অনলাইনে নিলামে কীভাবে সিন্ডিকেট কাজ করে তার কোনো উত্তর তারা দেননি। আবার সাড়ে ৩ কোটি টাকা দাম উঠলেও কেন গাড়ি দেওয়া হয়নি তার উত্তরও পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম পরিচালনাকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কে এম কর্পোরেশন জানিয়েছে, প্রতিবার নিলামে অন্তত ৪টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, লজিস্টিকস সাপোর্ট, স্টাফ কর্মচারীদের বেতন ও আনুসাঙ্গীক ব্যয় বাবদ খরচ ৩ লাখ টাকার বেশি।
সংস্কারের আহ্বান
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'নিলামে বিক্রি না হলে আলোচনার মাধ্যমে নিলামে তোলা পণ্য বিক্রি করা উচিত। কাস্টমস, আমদানিকারক ও ক্রেতাকে নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে পণ্যের ভালো দাম নিশ্চিত করা সম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, 'জাতীয় সম্পদ নষ্ট ও রাজস্বের ক্ষতি হয়—এমন পুরনো চিন্তা বাদ দিতে হবে। উন্নত দেশের পদ্ধতি অনুযায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে নিলাম প্রক্রিয়ার সংস্কার করা উচিত।'
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার সাকিব হোসাইন টিবিএসকে বলেন, দ্বিতীয় নিলামে পণ্য বিক্রির জন্য সংরক্ষিত মূল্যের একটি যৌক্তিক ন্যূনতম শতকরা হার নির্ধারণ অথবা অন্য কোনো উপায়ে নিষ্পত্তির বিষয়ে সম্প্রতি এনবিআরের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এনবিআরের নির্দেশনা পেলে ২৪টি গাড়ির দিতীয় নিলাম আহ্বান করা হবে। প্রথম নিলামে তোলা হয়নি এমপিদের এমন আরো ৬টি গাড়ি রয়েছে। এবার ৩০টি গাড়ি নিলাম করবে কাস্টমস।
এনবিআরের সদস্য (কাস্টম, রপ্তানি, বন্ড ও আইটি) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন টিবিএসকে বলেন, এমপিদের গাড়ির প্রথম নিলামে অযৌক্তিক দর দেওয়ায় আমরা দ্বিতীয় নিলাম স্থগিত করেছি। কীভাবে গাড়িগুলো দ্রুত বিক্রয় করা যায়, আমরা বিকল্প পথ খুঁজছি। এ বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেবে কীভাবে যৌক্তিক নূন্যতম দাম নির্ধারণ করে দ্বিতীয় নিলাম আয়োজন করা যায়।
সিন্ডিকেটের বিষয়টি অস্বীকার করে নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াকুব টিবিএসকে বলেন, অনলাইন নিলামে সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই। দেশ কিংবা বিদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিড করার সুযোগ আছে। কাস্টমসের এ অভিযোগ সত্য নয়।'

তিনি বলেন, '২০২৪ সালের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি ইতোমধ্যে পুরাতন হয়ে গেছে। তাই গাড়িগুলো বাজারে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার বেশি দামে কেউ কেনার সম্ভাবনা নেই। রিকন্ডিশন্ড গাড়িও এই দামে পাওয়া যায়। সুতরাং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বাস্তবতার নিরিখে গাড়ির দাম নির্ধারণ না করলে, সেগুলো দিনে দিনে নষ্ট হতে থাকবে।
বন্দরে জট ও অপরিশোধিত পাওনা
নিলামে কাস্টমসের এমন নীতির ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রমশ বাড়ছে নিলামযোগ্য পণ্যের সংখ্যা। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে নিলামযোগ্য পণ্যভর্তি কনটেইনার রয়েছে ১০ হাজার ৩২ টিইইউ।
বন্দরে কনটেইনার রাখার সক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউ। এর মধ্যে নিলামযোগ্য কনটেইনারে ভর্তি হয়ে আছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এর প্রভাবে বন্দরে কনটেইনার জট তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর অভ্যন্তরে নিলামযোগ্য প্রায় ১০ হাজার টিইইউএস কনটেইনারের কারণে বন্দরের নিয়ামতি কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। গত ১ জুন চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমসের যৌথ সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। এসব নিলামযোগ্য কনটেইনার বিভিন্ন অফডকে স্থানান্তরের অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
নিলামে বিক্রিত পণ্যের হিস্যা বাবদ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কাছে ১৪২ কোটি ৭২ লাখ হাজার টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। পাওনা টাকা আদায়ের বন্দর কর্তৃপক্ষ কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষকে অন্তত ৫৯টি চিঠি দিয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, একদিকে এলসির মাধ্যমে আমদানি মুল্য বিদেশে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে গাড়িসহ অন্যান্য আমদানি পণ্য এভাবে নষ্ট হচ্ছে। আইনের দোহাই দিয়ে এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করলেও এর সাথে যুক্ত সরকারী কর্মকর্তারা শাস্তির আওতায় আসে না। এভাবে দিনের পর দিন নিলামযোগ্য পণ্য শেডে পড়ে থাকায় বড় অংকের ভাড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বন্দর। নিলামযোগ্য পণ্যের দ্রুত নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে।
ছবি: ফাইল ছবি/মিনহাজ উদ্দিন