সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় সৌদিতে ক্লিনার-লোডার পেশায়ও চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে

সৌদি আরবে ক্লিনার ও লোডিং-আনলোডিংয়ের মতো উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন অথচ স্বল্প দক্ষতার পেশাগুলোতেও চাকরি পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে বাংলাদেশিদের জন্য। কারণ, দেশটি এখন এসব খাতেও তাদের 'স্কিল ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম' (এসভিপি) সনদ বাধ্যতামূলক করেছে।
বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া মোট কর্মীদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই এই দুই পেশায় নিযুক্ত হন বলে জানিয়েছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)।
সম্প্রতি ঢাকায় সৌদি দূতাবাস এসভিপি সনদ ছাড়া এসব পেশায় কর্মী নিয়োগের জন্য ভিসা ইস্যু করা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে ভিসা জট। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, নতুন এই বাধ্যবাধকতার কারণে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সংকুচিত হতে পারে।
যদিও এখন সৌদি আরবে স্বল্পদক্ষ পেশাগুলোতে কর্মসংস্থানের জন্য 'স্কিল ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম' (এসভিপি) সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, কিন্তু এর সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। ফলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও অভিবাসী অধিকারকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি হিসাবে, বর্তমানে সৌদি আরবে ৩০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত আছেন, যা দেশটির শ্রমবাজারকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গন্তব্যে পরিণত করেছে।
এখন পর্যন্ত সৌদি আরব ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন ও মালয়েশিয়ার মতো প্রধান শ্রমবাজারগুলো বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কার্যত বন্ধ রয়েছে।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরব প্রথমে পাঁচটি খাতে—প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার, রেফ্রিজারেশন/এসি টেকনিশিয়ান এবং অটোমোবাইল ইলেকট্রিশিয়ান—বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে এসভিপি চালু করে।
গত দুই বছরে এর পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১টি পেশায় এবং বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, এটি শিগগিরই ৭৩ এ পৌঁছাতে পারে। নতুন করে ক্লিনার ও লোডার (লোডিং-আনলোডিং) পেশাও এর আওতায় আসছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) সূত্র জানায়, আকস্মিকভাবে এসভিপি সনদ বাধ্যতামূলক করার কারণে বর্তমানে ঢাকায় সৌদি দূতাবাসে আনুমানিক ৮০ থেকে ৯০ হাজার ভিসার আবেদন আটকে আছে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে সৌদি গমনকারী কর্মীর সংখ্যা মে মাসের তুলনায় ৫ হাজারের মতো কমে ৬৪ হাজার ৫০৪ জনে দাঁড়িয়েছে।
তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সৌদি দূতাবাস লোডিং-আনলোডিং পেশার ক্ষেত্রে আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত এসভিপি সনদ দেখানোর নিয়ম শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই সপ্তাহ আগেই দূতাবাস কর্মীদের জন্য এই সনদ বাধ্যতামূলক করেছিল বলে জানান বিএমইটি'র এক শীর্ষ কর্মকর্তা।
এদিকে, ক্লিনার পেশার ক্ষেত্রে আরও কয়েক মাসের ছাড় দেওয়া হতে পারে বলেও জানা গেছে।
বিএমইটির আরেক কর্মকর্তা জানান, প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ইতোমধ্যে ক্লিনার ও লোডার-আনলোডারদের জন্য বাধ্যতামূলক সনদ শিথিল করতে সৌদি কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন।
খাত সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ
বৃহস্পতিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএমইটির ট্রেনিং অপারেশনের পরিচালক মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, "আমরা সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ফেস করছি লোডিং-আনলোডিং এবং ক্লিনার ট্রেড নিয়ে। নতুন করে এই দু'টিকে তাকামুলে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে মন্ত্রণালয়ের বারবার মিটিং হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "বিভিন্ন এজেন্সি বিপদে পড়ে গেছে। হঠাৎ করে এরকম ভিসা বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ অ্যাসেসমেন্ট ছাড়া তো যেতে পারবে না।"
সালাহ উদ্দিন জানান, "আমরাও চাই না ক্লিনার বা লোডার-আনলোডারদের জন্য সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা হোক। সার্টিফিকেশন ভালো উদ্যোগ হলেও এভাবে চললে সব শ্রেণির লোকেরা আর যেতে পারবে না। কারণ পরীক্ষা দিলে সবাই পাশ করতে পারবে না, ফলে বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে।"
তিনি বলেন, "এখানে কম্পিউটারে একটি লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। এরপর ক্লিনিংয়ে কী স্কিল আছে, সেটা প্র্যাকটিক্যালি দেখা হবে। যদিও আমরা এখনো শুরু করতে পারিনি।"
তার মতে, "ক্লিনার ও লোডারদের জন্য যদি কম্পিউটার পরীক্ষা বাদ দেওয়া যেত, তাহলে ভালো হতো। তাদের জন্য এটা কঠিন। তারা যে প্রসেসে আছে, তাতে শুধু প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার ভিত্তিতেই সার্টিফিকেট দিলে ভালো হতো।"
সালাহ উদ্দিন আরও বলেন, "এ ধরনের উদ্যোগ স্কিল উন্নয়নের জন্য ভালো। তবে লোডিং-আনলোডিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু ফিজিক্যাল ফিটনেস থাকলেই যথেষ্ট ছিল। হঠাৎ করে এই বাধ্যবাধকতা আমাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
ঝুলে আছে হাজারো কর্মীর ভিসা, তৈরি হচ্ছে বিশাল ব্যাকলগ
ফ্রিডম ওভারসিজের মালিক কাফিল উদ্দিন মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যারা সাধারণ কর্মী ভিসায় যান, তাদের বেশিরভাগই ক্লিনিং বা লোডিং-আনলোডিংয়ের কাজ করেন। আমাদের দাবি ছিল, ক্লিনার এবং লোডিং-আনলোডিং ট্রেডগুলো ট্রেনিংয়ের আওতার বাইরে রাখা। কিন্তু হঠাৎ করেই এগুলোকে সেই আওতায় আনা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "অনেকের ভিসা এখন প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় আছে, কিন্তু তারা ট্রেনিং করেননি। অনেকের মেডিকেল রিপোর্ট আছে, যেগুলো এক্সপায়ার হয়ে যাবে। এই পর্যায়ে এসে প্রায় সব রিক্রুটিং এজেন্সির অনেক কাজ ঝুলে গেছে।"
কাফিল উদ্দিন আরও বলেন, "দুই দিন আগে দূতাবাস একটি ঘোষণা দিয়েছে—১৯ জুন পর্যন্ত যাদের মোফা (সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ডাটা এন্ট্রি) করা হয়েছে, তাদের পাসপোর্ট বৃহস্পতিবার দূতাবাস গ্রহণ করেছে। তবে যাদের এখনো প্রসেসিং হয়নি, তাদের বিষয়ে দূতাবাস কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।"
"প্রতিদিন দূতাবাসে ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ পাসপোর্ট জমা পড়ে। এর মধ্যে যদি ২০ শতাংশও এই দুই ক্যাটাগরির হয়, তাহলে পেন্ডিং সংখ্যাটা বিশাল। শুধু আমার কোম্পানিরই প্রায় ১০০ কর্মী ব্যাকলগে পড়েছে," বলেন তিনি ।
যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএমইটি
এসভিপি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে লোডিং-আনলোডিং ট্রেডে স্কিল যাচাই পরীক্ষার আয়োজন শুরু করেছে বিএমইটি, যা আপাতত দেশের নয়টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে (টিটিসি) চলছে।
বিএমইটি সূত্র জানায়, সৌদি কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে পরিদর্শন করে অনুমোদন দিলে এটি আরও ২০টি টিটিসিতে সম্প্রসারণ করা হবে।
বিএমইটি'র ট্রেনিং অপারেশন পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. সালাহ উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের টার্গেট হচ্ছে, প্রতি মাসে লোড-আনলোড ট্রেডে ৩০,০০০ জনকে এবং ক্লিনিং ট্রেডে ৫,০০০ জনকে স্পেসিমেন করানো। অন্যান্য স্কিলসহ অন্তত ৪০,০০০ কর্মীকে প্রতিমাসে তাকামুলের আওতায় আনতে চাই।"
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মোট ২৭,০০০ জনকে এসভিপির আওতায় অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২১,০০০ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। অর্থাৎ, প্রায় ৭৩ শতাংশ পাস করে সৌদি আরবে গেছেন।
সালাহ উদ্দিন বলেন, "বিদেশ যাওয়ার প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর এই পরীক্ষা নেওয়া হয়। নিয়োগকর্তা কাজের নিশ্চয়তা দিলে এবং চাহিদাপত্র অনুমোদন হওয়ার পর কর্মীরা পরীক্ষায় বসেন।"
তাকামুল প্রক্রিয়ার আওতায়, কর্মীদের নিবন্ধনের পর অনলাইন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একটি সনদ অর্জন করতে হয়। এজন্য ৫০ ডলার রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়। এই পরীক্ষায় একাধিকবার অংশ নেওয়া যাবে এবং সনদ পাঁচ বছরের জন্য বৈধ থাকবে।
শুরুতে বলা হয়েছিল, কর্মীদের পরীক্ষার নিবন্ধনের জন্য কোনো অর্থ দিতে হবে না। তাকামুল ৫০ ডলার খরচ বহন করবে। তবে জানা গেছে, এ খরচ বর্তমানে সৌদি অভিবাসী কর্মীরা নিজেরাই বহন করছেন। ফি জমা দিয়ে অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হচ্ছে।
ফি জমা দিয়ে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করার পর টিটিসিতে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অনলাইন পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন কর্মীরা।
বাধ্যতামূলক সার্টিফিকেশনেও বাড়েনি বেতন
সৌদি আরব ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী, এসভিপি চালু হওয়ার পর সৌদি আরবে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো সহজ হবে এবং এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে—এমনটাই বলেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি আরবের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসুফ ইসা আল দুহাইলান।
তবে বাধ্যতামূলক সার্টিফিকেশন চালু হলেও বাংলাদেশি কর্মীদের বেতন এখনও বাড়েনি বলে অভিযোগ করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, ক্লিনার ও নির্মাণশ্রমিকদের মতো স্বল্পদক্ষ কাজ করা শ্রমিকরা সৌদি আরবে সাধারণত মাসে ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা আয় করেন, যা এখনও আগের মতোই।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-এর সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই সার্টিফিকেট দিয়ে আমাদের কর্মীদের কী লাভ হলো? একদিকে তাদের ফি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে বেতন কি বেড়েছে? যদি বেতন দ্বিগুণ হতো, তাহলে তা কিছুটা যৌক্তিক হতো।"
তিনি আরও বলেন, "সৌদির সঙ্গে এই এমওইউতে যাওয়ার আগে সরকারের উচিত ছিল একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) চাওয়া। সেটা না করেই আমরা প্রসেসে ঢুকে পড়েছি, কিন্তু কোনো বাস্তব সুবিধা পাচ্ছি না।"
এ বিষয়ে বিএমইটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, "বেতন বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে সৌদি সরকারকে পুশ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। যখন সবাই কান্ট্রি-টু-কান্ট্রি প্রসেসে যাবে, তখন বিষয়টি নিয়ে বার্গেইন করা হবে। যেহেতু কর্মীরা পাস করেই যাচ্ছেন, এখন আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।"