যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অচলাবস্থা কাটাতে নতুন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ডাক, নেতৃত্বে ইইউ ও জার্মানি

যুক্তরাষ্ট্রের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) দীর্ঘদিনের যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা পাশ কাটাতে একটি নতুন উদ্যোগ নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মানি। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন ও জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস এই প্রস্তাবটি সামনে আনার পর তা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
গত ২৭ জুন ব্রাসেলসে ইইউ নেতাদের এক শীর্ষ সম্মেলনের শেষে তারা ১৯৯৫ সালে গঠিত ডব্লিউটিওর একটি বিকল্প ফোরাম গঠনের ধারণা তুলে ধরেন, যার নেতৃত্ব দেবে ইইউ।
মের্ৎস বলেন, ধারণাটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে ডব্লিউটিওর মূল কাজের মতোই এখানেও বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা থাকতে পারে।
তিনি বলেন, 'আপনারা সবাই জানেন যে ডব্লিউটিওর আর কার্যকারিতা নেই।' তিনি আরও বলেন, একতি 'নতুন ধরনের বাণিজ্য সংস্থা' ধীরে ধীরে 'ডব্লিউটিওর সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে, যা আর কার্যকর নেই'।
জার্মান চ্যান্সেলর মূলত ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ার দিকেই ইঙ্গিত করছিলেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার মেয়াদের শেষ দিকে প্রথম ডব্লিউটিওর আপিল বিভাগে (বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ আদালত) বিচারক নিয়োগে বাধা দেন। সেই থেকে দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেক মার্কিন প্রশাসন এই বাধা অব্যাহত রেখেছে। একের পর এক মার্কিন সরকার ডব্লিউটিওর এমন সব রায়ের বিরোধিতা করেছে, যা তাদের মতে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে।
এর ফলে কোনো পক্ষ আপিল করলে বাণিজ্য বিরোধগুলোর আর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে অমীমাংসিত মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে নিকেল আকরিক রপ্তানি নিয়ে ইইউ ও ইন্দোনেশিয়ার বিরোধ, উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারক বোয়িং ও এয়ারবাসকে ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়ে রায় এবং চীনের বিরুদ্ধে অ্যান্টি-ডাম্পিং মামলা।
ইইউর প্রেসিডেন্ট ফন ডার লিয়েন এশিয়ার সমমনা বাণিজ্যিক দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (সিপিটিপিপি) সঙ্গে সম্ভাব্য সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন।
এই বাণিজ্য জোটে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম রয়েছে। যুক্তরাজ্যও এই জোটে যোগ দিয়ে প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে এর সদস্য হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই বাণিজ্য উদারীকরণ?
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ছাড়া ইউরোপ কি সত্যিই একটি নতুন ডব্লিউটিও গঠন করতে পারবে? আর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে জোট গঠনই বা কতটা কার্যকর হবে?
জার্মানির কোলোন-ভিত্তিক জার্মান ইকোনমিক ইনস্টিটিউটের (আইডব্লিউ) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি বিশেষজ্ঞ ইয়ুর্গেন মাথেস ডিডব্লিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই উদ্যোগকে সমর্থন করেছেন।
মাথেস বলেন, 'সিপিটিপিপিতে যোগদানের জন্য ইইউর আনুষ্ঠানিক আবেদন বিভিন্ন দিক থেকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা দেবে, সংরক্ষণবাদী নীতির কারণে তারা একঘরে হয়ে পড়ছে, আর বাকি বিশ্ব বাণিজ্য উদারীকরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।'
মাথেস আরও বলেন, এর ফলে প্রধান প্রধান অর্থনীতিগুলোকে নিয়ে 'একটি অত্যন্ত বৃহৎ আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি' তৈরি হবে, 'যেখানে ইইউ হবে বৃহত্তম ব্লক'।
তিনি আরও বলেন, 'এতে প্রায় সব মহাদেশ অন্তর্ভুক্ত হবে। হয়তো আফ্রিকার কিছু দেশকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।'
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে বাইরে রেখে
তবে এ জোটে প্রাথমিকভাবে চীনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। মাথেসের মতে, চীন সাধারণত ন্যায্য প্রতিযোগিতার নিয়মকানুন মেনে চলে না।
মাথেস বলেন, 'এর লক্ষ্য হলো এমন একটি কৌশলগত বাণিজ্য জোট গঠন করা, যা বিশ্ব বাণিজ্যের আজকের গুরুতর সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণবাদই নয়, চীনের ভর্তুকির কারণে সৃষ্ট ব্যাপক বাজার বিকৃতিও রয়েছে, যা বর্তমান ডব্লিউটিওর নিয়মে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা যায় না।'
ইইউর জন্য অগ্রাধিকার হবে এই নতুন কাঠামোর মধ্যে কঠোর প্রতিযোগিতার নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও শিল্প ভর্তুকির ক্ষেত্রে। তিনি আরও বলেন, 'যারা এই মানদণ্ড পূরণ করবে, তারাই যোগ দিতে পারবে।'
এর জন্য চীনকে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে, যেমন—বাজারের বিকৃতি ও ভর্তুকি কমানো, অথবা ডব্লিউটিওর নিয়মের ব্যাপক সংস্কারে রাজি হওয়া।
সমমনাদের উদ্যোগ
মুক্ত বাণিজ্যের সমর্থকরা এরইমধ্যে ডব্লিউটিওর অচল আপিল প্রক্রিয়ার একটি বিকল্প সমাধান তৈরি করেছেন, যার নাম মাল্টি-পার্টি ইন্টারিম আপিল আরবিট্রেশন অ্যারেঞ্জমেন্ট (এমপিআইএ)। ডব্লিউটিওর ভেতরেই গঠিত এই এমপিআইএ যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ছাড়াই একটি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা দিয়ে থাকে।
ইউরোপীয় কমিশনের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্য ও ইইউর সব সদস্য রাষ্ট্রসহ ৫৭টি দেশ এমপিআইএতে যোগ দিয়েছে, যারা বিশ্ববাণিজ্যের ৫৭.৬ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
তবু জার্মানির রপ্তানি খাতের প্রতিনিধিত্বকারী ফেডারেশন অব জার্মান হোলসেল, ফরেন ট্রেড অ্যান্ড সার্ভিসেস-এর (বিজিএ) মতো ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ডব্লিউটিওকে দুর্বল করার বিষয়ে সতর্ক।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজিএর প্রেসিডেন্ট ডার্ক জান্ডুরা সিপিটিপিপির মাধ্যমে কার্যকর গণতন্ত্রের দেশগুলোর মধ্যে একটি নতুন কাঠামো গঠনের কৌশলগত সুবিধার কথা স্বীকার করলেও এর ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
তিনি বলেন, 'আমাদের কোনোভাবেই বিশ্ববাণিজ্যকে ভিন্ন ভিন্ন নিয়মের অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লকে বিভক্ত হতে দেওয়া উচিত নয়। এই নতুন সংস্থাকে অবশ্যই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান হিসেবে দেখতে হবে, যার সুস্পষ্ট লক্ষ্য হবে ডব্লিউটিওকে সংস্কার করা, প্রতিস্থাপন করা নয়।'
ভাঙন নয়, সংস্কারই লক্ষ্য
ব্রাসেলসও সতর্কতার সঙ্গে স্পষ্ট করেছে, তাদের লক্ষ্য ডব্লিউটিওকে অকার্যকর বা অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া নয়। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ফন ডার লিয়েন সিপিটিপিপি সদস্যদের কাছে এই 'কাঠামোগত সহযোগিতাকে' বর্ণনা করেছেন ডব্লিউটিওকে নতুন করে সাজানোর সম্ভাব্য সূচনা বিন্দু হিসেবে।
এমনকি ডব্লিউটিওর সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ রালফ ওসা-ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা খোলামেলাভাবে স্বীকার করেছেন।
জার্মানির অর্থনীতি মন্ত্রণালয়ও একই মত পোষণ করেছে। মন্ত্রী ক্যাথারিনা রাইখের একজন মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, জার্মান সরকার ইউরোপীয় কমিশনের সঙ্গে মিলে সক্রিয়ভাবে ডব্লিউটিওর সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছে।
প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে শিল্প ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল বাণিজ্য উদ্যোগ ও বিনিয়োগ সহজ করার জন্য নতুন নিয়মকানুন। ইইউ এরইমধ্যে সিপিটিপিপি সদস্যসহ মুক্ত ও নিয়মভিত্তিক বাণিজ্য সমর্থনকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।