ইউরোপের প্রাচীনতম ভাষা যেভাবে বেঁচে আছে শুধু গাছের বাকলে
ইতিহাস সাধারণত লেখা হয় বইয়ের পাতায়। কিন্তু আমেরিকার নেভাডা, ক্যালিফোর্নিয়ার মতো রাজ্যগুলোর গহীন জঙ্গলে এমন এক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়, যা লেখা হয়েছে গাছের ছালে। আর এই ইতিহাসের লেখক হলো 'বাস্ক', যারা ইউরোপের এক স্বতন্ত্র জাতি, যাদের বাস স্পেন ও ফ্রান্সের সীমান্তে পিরেনিজ পর্বতমালার কাছে।
বাস্কদের ভাষা 'ইউস্কারা' এক জীবন্ত রহস্য। এটি ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা, যার সঙ্গে অন্য কোনো ভাষার বিন্দুমাত্র মিল নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইউরোপের এই আদি ভাষার চিহ্ন হাজার হাজার মাইল দূরে আমেরিকার জঙ্গলে পৌঁছাল কীভাবে?
গল্পটা শত বছর আগের। ভাগ্য বদলাতে আর সোনার খোঁজে বহু বাস্ক পাড়ি জমান আমেরিকায়। কিন্তু ইংরেজি না জানায় তাদের ভাগ্যে জোটে নিঃসঙ্গ এক পেশা, ভেড়া চরানো। পরিবার ও দেশ থেকে দূরে, পাহাড়ের ওপর একাকী জীবনে তাদের সঙ্গী ছিল কেবল প্রকৃতি আর এই গাছগুলো। মনের কষ্ট, দেশের স্মৃতি, প্রিয়জনের নাম সবই তারা ছুরি দিয়ে খোদাই করে গেছেন নরম অ্যাসপেন গাছের গায়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গরাজ্যের মরুভূমি আর জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটে চলেছেন নেভাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন বিলবাও বাস্ক লাইব্রেরির প্রধান গ্রন্থাগারিক ইনাকি আরিয়েতা বারো। সঙ্গে একটি বাস্ক-আমেরিকান পরিবার, যারা তাদের পূর্বপুরুষের এক বিশেষ স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছে। দাদার রেখে যাওয়া পথের দিশা ধরে, জিপিএস-এর সাহায্যে তারা পৌঁছালেন এক প্রত্যন্ত খামারবাড়িতে।
আর সেখানে অ্যাসপেন গাছের বনের মধ্যে তারা খুঁজে পেলেন তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিস—একটি প্রাচীন গাছ, যার গায়ে কয়েক দশক আগে খোদাই করা তাদের দাদার নাম।
"আমরা ঠিক সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেখানে বহু বছর আগে তাদের পুর্বপুরুষ, তাদের দাদা দাঁড়িয়েছিলেন," বলছিলেন ইনাকি। "মুহূর্তটা ছিল খুবই আবেগঘন।"
যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে ওয়াইওমিং অঙ্গরাজ্য পর্যন্ত, বিশাল এলাকাজুড়ে অ্যাসপেন গাছের নরম ছালে লেখা আছে ঊনিশ ও বিশ শতকের বাস্ক অভিবাসী রাখালদের না বলা গল্প। এই গাছগুলো যেন এক-একটা জীবন্ত ইতিহাসের বই। নাম, তারিখ, কার্টুনের মতো ছবি থেকে শুরু করে নিজেদের শহরের স্মৃতিচারণ আর রাজনৈতিক বার্তা—সবই খোদাই করা হয়েছে ইউস্কারা ভাষায়। এটি ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন জীবন্ত ভাষা। গাছের গায়ে খোদাই করা এই শিল্পকর্মকে বলা হয় 'আরবোরগ্লিফ', যা সেই বিস্মৃত মানুষগুলোর জীবনে উঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
কেন তারা রাখাল হয়েছিলেন?
উনবিংশ শতকে গোল্ড রাশ বা সোনা আবিষ্কারের খবরে উৎসাহিত হয়ে বহু বাস্ক স্পেনের পিরেনিজ পার্বত্য অঞ্চল থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা এবং আইডাহোর মতো রাজ্যগুলোতে পাড়ি জমান। পরবর্তী শতাব্দীতেও ভালো ভবিষ্যতের আশায় তাদের এই সংগ্রাম চলতে থাকে।
আইডাহোর বোইসি শহরে বসবাসকারী আনুমানিক ১৬,০০০ বাস্ক-যুক্তরাষ্ট্রনদের একজন আমায়া হেরেরা। তার পূর্বপুরুষরাও এভাবেই এসেছিলেন। তিনি বলেন, "আমার দাদার দাদা-দাদিরা ১৮৯০-এর দশকের শেষের দিকে এখানে আসেন। প্রথমে তারা খামারে কাজ করতেন এবং পরে নেভাডায় একটি বোর্ডিং হাউস চালাতেন।"
আমায়ার পরিবারের মতো আরও অনেকের চালানো এই বোর্ডিং হাউসগুলোই ছিল পশ্চিমে বাস্ক সম্প্রদায়ের গোড়াপত্তনের কেন্দ্র। এগুলো শুধু থাকার জায়গাই ছিল না, বরং অন্যান্য বাস্কদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, কাজের সন্ধান পাওয়ার একটি কেন্দ্র ছিল। সদ্য আসা অভিবাসীরা ভেড়া চরানোর কাজে অনভিজ্ঞ হলেও, প্রয়োজনের তাগিদেই তারা এই পেশা বেছে নিয়েছিলেন। এর প্রধান কারণ ছিল, তারা ইংরেজি বলতে পারতেন না বললেই চলে। ভেড়া চরানোর কাজে খুব বেশি কথা বলার দরকার হতো না।
একাকীত্বের সঙ্গী যখন গাছ
রাখালদের জীবন ছিল ভীষণ একাকী। 'ট্রান্সহিউম্যান্স' নামক একটি পদ্ধতিতে তারা বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে ভেড়ার পালকে পাহাড়ের চূড়ায় চারণভূমিতে নিয়ে যেতেন এবং শীতকালে আবার উপত্যকায় ফিরে আসতেন। এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা তাদের জন্য যেমন নতুন ছিল, তেমনই অচেনা ছিল চারপাশের পরিবেশ।
পরিবার ও মাতৃভূমি থেকে দূরে, এই নিঃসঙ্গ রাখালেরা গাছের কাছেই নিজেদের মনের কথা বলতেন। তারা ছুরি দিয়ে গাছের ছালে বার্তা ও ছবি খোদাই করে নিজেদের আবেগ, অনুভূতি আর বিশেষ করে 'গুরে আমা' বা 'আমাদের মা'-এর জন্য আকুতি প্রকাশ করতেন।
ইউস্কারা ভাষা ইউরোপের এক ভাষাগত রহস্য। এর সঙ্গে অন্য কোনো জীবন্ত ভাষার কোনো মিল নেই। ধারণা করা হয়, এর শেকড় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোরও আগে, নব্য প্রস্তর যুগে প্রোথিত। হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের গাছের গায়ে এই প্রাচীন ভাষায় "গোরা ইউস্কাদি" (বাস্ক দেশের জয় হোক) এর মতো বার্তা খুঁজে পাওয়া এই রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে।
শিকড়ের টান
অ্যাসপেন গাছকে বলা হয় "এক গাছের জঙ্গল" (forest of one)। কারণ, একটি পুরো বন আসলে একটিমাত্র মূল সিস্টেমের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে। হাজার হাজার গাছ জেনেটিক্যালি অভিন্ন ক্লোন হিসেবে একটি বিশাল জীবন্ত সত্তা তৈরি করে।
যে অভিবাসী গোষ্ঠীর জীবন ছিল একাকীত্বে ভরা, কিন্তু যাদের খোদাই করা শিল্পকর্মে সংযোগের জন্য আকুতি প্রকাশ পায়, তাদের গল্পের সঙ্গে অ্যাসপেন গাছের এই বৈশিষ্ট্যটি যেন অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।
ইনাকি বলেন, "এই খোদাইগুলো শুধু সৌন্দর্যের জন্য ছিল না। এর মাধ্যমে তারা বলতে চাইতেন, 'আমি এখানে আছি।' এটি প্রমাণ করে, মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, সেই জায়গার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার এক সহজাত মানবিক চাহিদা অনুভব করে।"
কোথায় দেখবেন বাস্ক আরবোরগ্লিফ
ইনাকি আরিয়েতা বারোর মতে, জঙ্গলের গভীরে এই আরবোরগ্লিফগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এর জন্য কোনো গাইডের প্রয়োজন নেই, দরকার শুধু অনুসন্ধানী চোখ।
- নেভাডা: রেনো শহরের কাছে মাউন্ট রোজ পর্যন্ত বিস্তৃত হোয়াইটস ক্রিক ট্রেইলে হেঁটে দেখতে পাওয়া যায়।
- আইডাহো: উড রিভার ভ্যালিতে ঈগল ক্রিক রোড ধরে নিল ক্যানিয়নের দিকে গেলে এমন একটি বন মেলে যেখানে বোর্ডিং হাউস, বিভিন্ন চিত্র, নাম ও তারিখের খোদাই রয়েছে।
- ক্যালিফোর্নিয়া: লেক তাহোর পশ্চিম দিকে পেজ মেডোসের আশেপাশের অ্যাসপেন বনগুলোতে অথবা সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার হর্স মেডো ট্রেইলে এমন অনেক খোদাই নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
এছাড়াও, বোইসির বাস্ক মিউজিয়াম এবং রেনোর জন বিলবাও বাস্ক লাইব্রেরিতে আরবোরগ্লিফের ছোট সংগ্রহশালা ও একটি বিশাল ডিজিটাল আর্কাইভ রয়েছে।
ইতিহাস সংরক্ষণের দৌড়
বাস্ক-যুক্তরাষ্ট্রন গবেষক হোসে মালেয়া ওলাএক্সের মতো ব্যক্তিরা ১৯৬০-এর দশক থেকে এই আরবোরগ্লিফগুলো নথিভুক্ত করা শুরু করেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত ২৫,০০০-এর বেশি খোদাইয়ের ছবি, কাপড়ে নেওয়া ছাপ এবং সম্প্রতি থ্রিডি ফটোগ্রামেট্রি ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে।
দেখা গেছে, রাখালেরা খোদাইয়ের জন্য অ্যাসপেন গাছই বেছে নিতেন, বিশেষত এমন জায়গায় যেখানে ভেড়াদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও জলের উৎস ছিল। খোদাইগুলোর মধ্যে ছোট কবিতা, প্রেমমূলক বার্তা, মানুষের মুখ এবং বিভিন্ন পশুর চিত্র পাওয়া যায়, যদিও আশ্চর্যজনকভাবে ভেড়ার কোনো ছবি পাওয়া যায় না। বাস্ক অঞ্চলের খামারবাড়ির ছবি দেখে বোঝা যায় তাদের তীব্র গৃহকাতরতা। তবে সবচেয়ে বেশি খোদাই করা হয়েছে নাম ও তারিখ, যা দেখে মনে হয় রাখালেরা প্রতি বছর একই জায়গায় ফিরে এসে তাদের উপস্থিতির চিহ্ন রেখে যেতেন।
কিন্তু এই জীবন্ত ইতিহাস আজ সংকটে। অ্যাসপেন গাছ সাধারণত এক শতাব্দীর বেশি বাঁচে না। খরা, দাবানল এবং রোগবালাই এদের আয়ু আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
একজন সংগ্রাহক ২০২১ সালে জানিয়েছিলেন, তিনি যে গাছগুলো নথিভুক্ত করেছিলেন তার প্রায় ৮০ শতাংশই মরে গেছে। এর ওপর রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট ঝুঁকি। অনেক সময় সরকারি মালিকানাধীন বনভূমি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, যা এই গাছগুলোর অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
ইনাকি আরিয়েতা বারো এই আরবোরগ্লিফগুলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে নথিভুক্ত করার প্রচেষ্টাকে "সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়" বলে মনে করেন । আর এতে তিনি সাধারণ মানুষকেও শামিল করতে চান।