‘এক কিডনির গ্রাম’: দরিদ্র ডোনারদের যেভাবে প্রতারিত করছে ভারত-বাংলাদেশ কিডনি প্রতিস্থাপন চক্র

২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ভারতে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বেগুন গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী সফিরউদ্দিন। আশা ছিল—এই টাকায় তিনি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবেন, তিন সন্তানকে নিয়ে গড়বেন একটু ভালো জীবন। সন্তানদের জন্য একটি পাকাবাড়ি গড়ার স্বপ্ন ছিল তার। ছোট দুই মেয়ে—পাঁচ আর সাত বছর বয়সী, আর বড় ছেলের বয়স মাত্র দশ বছর।
কিন্তু সেই টাকা বহু আগেই শেষ। বাড়ি এখনও অসম্পূর্ণ, আর শরীরের একপাশের ব্যথা প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেয়—এই স্বপ্নের জন্য তাকে কী মূল্য দিতে হয়েছে।
এখন তিনি কাজ করছেন একটি কোল্ড স্টোরেজে দিনমজুর হিসেবে। শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ। প্রায়ই এমন ক্লান্তি আর ব্যথায় ভোগেন, যেটা নিয়ে স্বাভাবিক কাজ করাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমি আমার কিডনি দিয়েছিলাম যাতে আমার পরিবার ভালো জীবন কাটাতে পারে। আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য সবকিছু করেছি।'
সেই সময়ে এটা কোনো বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত মনে হয়নি তার কাছে। দালালরা তার কাছে বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করেছিল, যেন সেটি খুবই সহজ একটি সুযোগ। প্রথমে তার মনে দ্বিধা থাকলেও, চরম অভাবের কারণে তিনি একটি কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হন।
দালালরা তাকে মেডিক্যাল ভিসায় ভারত নিয়ে যায়। যাবার সব ব্যবস্থা—ফ্লাইট, কাগজপত্র, হাসপাতালের কাজকর্ম—তারাই করে দিয়েছিল। ভারতের ভেতর সফিরউদ্দিন নিজের মূল বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করলেও, কিছু নকল কাগজ তৈরি কড়া হয়েছিল। সেখানে কিডনি নেওয়ার ব্যক্তির সঙ্গে তার ভুয়া পারিবারিক সম্পর্ক দেখানো হয়েছিল।
তার পরিচয় বদলে দেওয়া হয়, আর তার কিডনি অজানা একজন রোগীর দেহে স্থাপন করা হয়, যাকে সে কখনো দেখেনি। সফিরউদ্দিন বলেন, 'আমি জানি না আমার কিডনি কে পেয়েছে। তারা (দালাল) কিছু বলেনি।'
ভারতে আইন অনুযায়ী, কেবল নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বা বিশেষ সরকারি অনুমতি নিয়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু পাচারকারীরা সবকিছু ভিন্নভাবে চালায়—পারিবারিক সম্পর্কের কাগজপত্র, হাসপাতালের রেকর্ড, এমনকি ডিএনএ পরীক্ষাও নকল করে নিয়ম এড়িয়ে যায়।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গ প্রতিস্থাপন টাস্ক ফোর্সের সদস্য মনির মনিরুজ্জামান বলেন, 'সাধারণত বিক্রেতার নাম বদলে দেওয়া হয়, আর একজন আইনজীবীর মুদ্রাঙ্কিত নোটারি সার্টিফিকেট তৈরি করা হয় যেটি ভুয়া পারিবারিক সম্পর্ক প্রমাণ করে। নকল জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে এটাও দেখানো হয় যে, ডোনার রোগীর আত্মীয়—যেমন বোন, মেয়ে বা অন্য কোনো সদস্য—যিনি দয়া থেকে অঙ্গ দিচ্ছেন।'
সফিরউদ্দিনের গল্প আলাদা কিছু নয়। তার গ্রামে প্রায় ৬,০০০ মানুষ বাস করে, সেখানে কিডনি বিক্রি খুবই সাধারণ ঘটনা। গ্রামের মানুষ এটাকে 'এক কিডনির গ্রাম' বলে ডাকে। বেগুন গ্রাম যে কালাই উপজেলার অংশ, ওই এলাকা কিডনি পাচারের হটস্পট হিসেবে পরিচিত।
২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল গ্লোবাল হেলথে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানা গেছে, ওই অঞ্চলের প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের একজন কিডনি বিক্রি করেছেন।
কালাই উপজেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকার একটি। বেশিরভাগ ডোনার ৩০-বছর বয়সী পুরুষ, যারা দ্রুত টাকা পাওয়ার লোভে এই কাজ করেন। ওই গবেষণায় ৮৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্রকেই কিডনি বিক্রির প্রধান কারণ হিসেবে জানিয়েছেন। এছাড়া অনেকেই ঋণ পরিশোধ, মাদকাসক্তি বা জুয়া খেলার জন্য এই পথে নামেন।
সফিরউদ্দিন বলেন, দালালরা তার পাসপোর্ট নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। অপারেশনের পর যে ওষুধগুলো দরকার ছিল, সেগুলোও তিনি পাননি। তিনি বলেন, 'তারা সব কিছু নিয়ে গেছে।'
অপারেশনের পর দালালরা অনেক সময় ডোনারর পাসপোর্ট ও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নেয়, যাতে কিডনি প্রতিস্থাপনের কোনো প্রমাণ না থাকে। ফলে ডোনাররা ভবিষ্যতে কোনো চিকিৎসা সহায়তাও পান না।
এই কিডনিগুলো সাধারণত বাংলাদেশ বা ভারতের ধনী রোগীদের কাছে বিক্রি করা হয়। তারা আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘ অপেক্ষা ও কঠোর নিয়ম এড়িয়ে দ্রুত কিডনি নিতে চায়। ভারতে ২০২৩ সালে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। অথচ প্রতি বছর সেখানে আনুমানিক দুই লাখ রোগীর শরীরে কিডনি জটিলতা দেখা দেয়।
আল জাজিরা বাংলাদেশের অন্তত এক ডজন কিডনি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে। সবার গল্প প্রায় একই—অভাবের কারণে তারা বাধ্য হয়ে কিডনি বিক্রি করেছেন।
এই পাচার বাণিজ্য চলে একটি নির্মম বাস্তবতার ওপর: অভাব তৈরি করে ডোনার, আর ধনী রোগীদের তাড়াহুড়ো, বৈধ ডোনারের সংকট ও দুর্বল নজরদারির সুযোগে এই চাহিদা কখনো থেমে থাকে না।

বাঁচার তাগিদে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত
৪৫ বছর বয়সী জোছনা বেগম জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বিনাই গ্রামের বাসিন্দা। ২০১২ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই মেয়েকে (তখন ১৮ ও ২০ বছর বয়সী) নিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। জীবিকার খোঁজে তিনি ঢাকায় গিয়ে একটি গার্মেন্টসে কাজ নেন। সেখানেই বেলাল নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়, পরে তাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের পর ২০১৯ সালে এক দালাল কিডনি বিক্রির প্রস্তাব দেয়। শেষ পর্যন্ত দুজনেই ভারতের একটি হাসপাতালে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেন।
'এটা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত,' বলেন জোছনা। তিনি জানান, শুরুতে দালালরা তাকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল। পরে সেটা বাড়িয়ে সাত লাখ বলে রাজি করায়। কিন্তু অপারেশনের পর হাতে পান মাত্র তিন লাখ টাকা।
জোছনা বলেন, তারা দুজনকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেস হাসপাতালে। বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাসে করে নেওয়া হয় তাদের। এরপর হাসপাতালের কাছেই একটি ভাড়াবাড়িতে রাখা হয়।
কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দালালরা নকল কাগজপত্র তৈরি করে, জোছনা ও কিডনি গ্রহীতার মধ্যে রক্তের সম্পর্ক দেখানো হয় । সফিরউদ্দিনের মতো তিনিও জানেন না, তার কিডনি কে পেয়েছে।
আল জাজিরা একাধিকবার যোগাযোগ করেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো মন্তব্য পায়নি। তবে ২০১৭ সালে একই হাসপাতালে অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপনে দালালদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনেছিল কলকাতা পুলিশ।
জোছনা বলেন, তার পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্রের সব কিছুই দালালরা নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। তিনি বলেন, 'প্রেসক্রিপশন তারা নিয়ে নিয়েছে, এতে সমস্যা ছিল না। কিন্তু পাসপোর্টটা চেয়েছিলাম। আর ফেরত দেয়নি।'
প্রায় দুই মাস ভারতে থাকার পর দালালদের সঙ্গেই দেশে ফিরে আসেন জোছনা। তখনো আশ্বাস পেয়েছিলেন, বাকি টাকা ও পরিবারের জন্য সহযোগিতা পাবেন। ঈদে কয়েকবার অল্প কিছু টাকা দেওয়ার পর আর কোনো খোঁজ নেয়নি তারা।
অপারেশনের জন্য বেলালও তিন লাখ টাকা পেয়েছিলেন। এরপর তিনি জোছনাকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করেন। জোছনা বলেন, 'আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে।'
এখন তিনি সব সময় ব্যথায় ভোগেন, ওষুধ কেনার টাকাও জোগাড় করতে কষ্ট হয়। তিনি বলেন, 'কোনো ভারী কাজ করতে পারি না। বাঁচতে হবে, কিন্তু ওষুধ সব সময় লাগে।'

'এই চক্রের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি'
কিছু ক্ষেত্রে যারা একসময় কিডনি বিক্রির শিকার ছিলেন, পরে তারাই এই প্রতারণার অংশ হয়ে উঠেছেন।
মোহাম্মদ সজল (ছদ্মনাম), একসময় ঢাকায় প্রেশার কুকার, প্লাস্টিকের বাটি, ব্লেন্ডার ইত্যাদি বিক্রি করতেন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির মাধ্যমে। ইভ্যালি বড় লাভের আশ্বাস দিলেও ২০২১ সালের কেলেঙ্কারির পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এর সঙ্গে হারিয়ে যায় সাজলের জমানো টাকা ও জীবিকা।
ঋণের বোঝায় ডুবে গিয়ে এবং টাকার চাপ সামলাতে না পেরে, ২০২২ সালে তিনি দিল্লির ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতালে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন। তাকে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
'ওরা (দালালরা) আমাকে ঠকিয়েছে,' বলেন সাজল। ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতাল এ নিয়ে আল জাজিরার বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো মন্তব্য করেনি।
সেই সময় সজল ভেবেছিলেন, তিনি যেটুকু পাওয়ার কথা ভেবেছিলেন, তা কেবল আরেকজনকে এনে কিডনি বিক্রি করিয়ে তবেই অর্জন করা সম্ভব। এরপর কয়েকমাস তিনি নিজেই দালাল হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশি ডোনারদের ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু টাকার ভাগাভাগি নিয়ে চক্রের লোকদের সঙ্গে বিরোধ হওয়ায় তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন। তখন থেকেই তিনি নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত।
তিনি বলেন, 'আমি এখন এই চক্রের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।' তিনি জানান, বাংলাদেশি হাসপাতাল থেকে শুরু করে ভারতীয় চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যন্ত পুরো নেটওয়ার্কটি এখনো নির্বিঘ্নেই চলছে। 'ডাক্তার থেকে শুরু করে রোগী, দুই দেশের দালাল—সবাই এতে জড়িত,' বলেন তিনি।
এখন ঢাকায় রাইড শেয়ারিং চালক হিসেবে কাজ করছেন সজল। অতীত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন, কিন্তু শরীর আর মন, দুটোতেই সেই ঘটনার দাগ রয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'কেউ শখ করে বা ইচ্ছায় কিডনি দেয় না। এটা একেবারে সরল হিসাব—অভাবেই মানুষ বাধ্য হয়।'
সীমান্ত পার হওয়া এই কিডনি পাচার নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এনামুল হক সাগর বলেন, ইউনিফর্মধারী সদস্য ছাড়াও এখন গোপন তদন্তকারীরা মাঠে নেমেছে, যারা পাচার চক্রের খোঁজ নিচ্ছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করছেন।
তিনি বলেন, 'এই বিষয়টি আমাদের নজরদারিতে আছে, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।' সাগর জানান, কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন দালালসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 'অনেক মানুষ এই চক্রের ফাঁদে পড়ে কিডনি বিক্রি করে ফেলছে, আমরা তাদের ধরতে কাজ করছি,' যোগ করেন তিনি।
সীমান্তের ওপারে ভারতেও কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৫০ বছর বয়সী কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ডা. বিজয়া রাজকুমারীকে। ভারতীয় কর্মকর্তাদের দাবি, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ১৫টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেন, যার সবগুলোতেই ছিলেন বাংলাদেশি ডোনার।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশিদের কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ভারতের চিকিৎসক গ্রেপ্তার
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচ্ছিন্নভাবে এসব গ্রেপ্তারে কিডনি পাচারের মূল ব্যবসা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
তারা আরও বলেন, ভারত সরকার একদিকে আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে চাপের মুখে আছে, অন্যদিকে তাদের রয়েছে মেডিকেল ট্যুরিজম শিল্পকে টিকিয়ে রাখার চাপ। ২০২৪ সালে এই খাতের মূল্য ছিল ৭.৬ বিলিয়ন ডলার।
গবেষক মনিরুজ্জামান বলেন, 'নৈতিকতা বজায় রাখার বদলে সরকার এখন অর্থনৈতিক দিকটাই গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে করে বেআইনি প্রতিস্থাপন থামছে না।'

'আরও বেশি প্রতিস্থাপন মানেই আরও বেশি আয়'
ভারতে মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ১৯৯৪ সালে চালু হয়, যা কিডনি দান নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইন অনুযায়ী, সাধারণত বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান বা স্বামী-স্ত্রীর মতো নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই কিডনি প্রতিস্থাপন অনুমোদিত। নিকটাত্মীয় না হলে, দানের উদ্দেশ্য নিঃস্বার্থ কিনা তা যাচাই করে অনুমোদন দিতে হয় সরকার নিযুক্ত একটি কমিটিকে, যাকে বলা হয় 'অনুমোদন কমিটি'।
কিন্তু কিডনি পাচারের সঙ্গে জড়িত দালালরা এসব নিয়মকে ফাঁকি দেয়। তারা নকল কাগজ তৈরি করে ডোনার ও গ্রহীতার মধ্যে ভুয়া আত্মীয়তার সম্পর্ক দেখায়। এই জাল দলিল অনুমোদন কমিটিতে জমা দেওয়া হয়। আর বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায়ই এসব ভুয়া কাগজে প্রতিস্থাপনের অনুমতি মিলে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ফাঁক-ফোকর কাজে লাগিয়েই এই পুরো পাচার চক্র চলে। মনিরুজ্জামান বলেন, 'তারা জাতীয় পরিচয়পত্র ও নোটারি সার্টিফিকেট জাল করে, যাতে ডোনার ও গ্রহীতার মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক দেখানো যায়। এসব নকল কাগজ খুব দ্রুত এবং অল্প খরচেই তৈরি করা সম্ভব।'
এই ভুয়া পরিচয়ের ভিত্তিতে হাসপাতালগুলোতে বৈধ আত্মীয়তার ছলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসুলার বিভাগের মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুর বলেন, কাগজপত্র জালিয়াতিতে বাংলাদেশের কোনো সরকারি কর্মকর্তার ভূমিকা নেই এবং তারা সব আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করেন। তিনি আরও জানান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কিডনি পাচার ঠেকাতে কোনো তথ্য আদান-প্রদান নেই।
অন্যদিকে, দিল্লির ডেপুটি পুলিশ কমিশনার অমিত গোয়েল—যিনি রাজাকুমারী নামে এক চিকিৎসকসহ কয়েকটি কিডনি পাচার মামলার তদন্ত করেছেন বলেন, হাসপাতালগুলো অনেক সময় নকল কাগজ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়, ফলে অবৈধ প্রতিস্থাপন হয়েই যায়।
তিনি বলেন, 'আমার তদন্তে দেখা গেছে, অনুমোদন বোর্ড অনেক সময় নকল কাগজ চিনতে পারে না, তাই প্রতিস্থাপনের অনুমতি দিয়ে দেয়।'
আরও পড়ুন: কিডনি প্রতিস্থাপন চক্র: দিল্লি পুলিশের অভিযোগপত্রে তিন বাংলাদেশির নাম
তবে মনিরুজ্জামান বলেন, কেবল ভুল নয়, অনেক সময় হাসপাতাল নিজেরাই ইচ্ছাকৃতভাবে এসব ভুল উপেক্ষা করে।
তিনি বলেন, 'হাসপাতালগুলোর জন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনগতভাবে বৈধ, তাই তারা অনেক সময় চোখ বুজে থাকে। কারণ যত বেশি প্রতিস্থাপন হবে, তত বেশি আয়। জালিয়াতি ধরা পড়লেও হাসপাতাল দায় স্বীকার করে না, বলে কাগজপত্র তো ঠিকই ছিল। এভাবেই পাচার চলতেই থাকে।'
বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় কাজ করা দালাল মিজানুর রহমান আল জাজিরাকে বলেন, পাচারকারীরা সাধারণত কোনো এক চিকিৎসক বা হাসপাতালের রিভিউ বোর্ডের সদস্যদের টার্গেট করে এবং ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করে। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশি দালালরা সাধারণত ভারতের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, তারা এসব ডাক্তার ঠিক করে দেয়। এ ধরনের ডাক্তাররাই সাধারণত পুরো লেনদেনের বড় অংশ নিয়ে নেয়।'
ভারতের জাতীয় অঙ্গ ও টিস্যু প্রতিস্থাপন সংস্থার (এনওটিটিও) পরিচালক ডা. অনিল কুমার এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে সংস্থাটির এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হাসপাতালগুলো শুধু দালাল ও ভুয়া কাগজ হাতে আসা ডোনারদের সঙ্গেই লড়ছে না, তাদের মুখোমুখি হতে হয় ধনী গ্রহীতাদেরও।
তিনি বলেন, 'অনুমোদন বোর্ড যদি সম্মতি না দেয়, তাহলে অনেক সময় ধনী রোগীরা ওপর মহলে অভিযোগ করে বা আদালতে যায়। তাই হাসপাতালগুলো আইনি ঝামেলা এড়াতে প্রতিস্থাপনের অনুমতি দিয়ে দেয়।'
এদিকে, অঙ্গ পাচার চক্রও কৌশল পাল্টাতে থাকে। কোনো এলাকায় পুলিশি নজরদারি বাড়লে, তারা অন্য জায়গায় সরে যায়।
মনিরুজ্জামান বলেন, 'কোনো একটি নির্দিষ্ট হাসপাতাল নেই, জায়গা বদল হয় বারবার। পুলিশ যখন অভিযান চালায়, তখন সেই হাসপাতাল প্রতিস্থাপন বন্ধ করে দেয়।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশি ও ভারতীয় দালালরা মিলে একসঙ্গে কাজ করে, সময় ও সুযোগ বুঝে নতুন নতুন হাসপাতাল বেছে নেয়।'

সীমান্তের ফাঁকফোকর, বড় বাণিজ্য আর প্রতারণার ফাঁদ
দালাল ও কিছু হাসপাতালের জন্য এই কিডনি পাচার অনেক বড় টাকার খেলা। একজন রোগী সাধারণত একেকটি কিডনির জন্য ২২ থেকে ২৬ হাজার ডলার (২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা) পর্যন্ত দিয়ে থাকেন।
কিন্তু ডোনাররা এর সামান্যই পান। দালাল মিজানুর রহমান জানান, 'ডোনাররা সাধারণত তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পায়। বাকি টাকা দালাল, জাল কাগজ তৈরির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।'
তিনি বলেন, 'কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও এর থেকে ভাগ পান। আবার ভারতে থাকাকালীন ডোনারদের কিছু খরচও এখান থেকে দেওয়া হয়।'
কখনো কখনো আরও ভয়ংকরভাবে প্রতারণা করা হয়। দালালরা বাংলাদেশি নাগরিকদের ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে নিয়ে যায়, পরে জোর করে বা ফাঁকি দিয়ে তাদের থেকে কিডনি নিয়ে নেয়।
হন্যে হয়ে কাজের খোঁজে থাকা এসব মানুষকে হাসপাতালে নেওয়া হয় মিথ্যে কথা বলে, সেখানে তাদের শরীরে অপারেশন করা হয়—যেটার পরিণতি তাদের অনেকেই বুঝতে পারেন না। যেমন গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে, ভারতের এক পাচারকারী চক্র অনেক বাংলাদেশিকে চাকরির কথা বলে আটকে রাখে, কাউকে জোর করে বা ফাঁকি দিয়ে কিডনি দান করায়। পরে অল্প কিছু টাকা দিয়ে ফেলে রেখে দেয়।
ওই বছরই বাংলাদেশ পুলিশ ঢাকায় তিন দালালকে গ্রেপ্তার করে, যারা অন্তত ১০ জনকে চাকরির কথা বলে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে কিডনি দিতে বাধ্য করেছিল।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, 'কেউ কেউ চরম দারিদ্র্যের কারণে জানিয়ে কিডনি বিক্রি করে, কিন্তু অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। একজন ধনী ভারতীয় রোগী কিডনি খোঁজেন, একজন দালাল কোনো গরিব বাংলাদেশিকে খুঁজে আনেন বা চাকরির প্রলোভনে কাউকে নিয়ে যান—এই চক্র এভাবেই চলতে থাকে।'
ভারতের কিডনি রোগীদের সহায়তাকারী সংগঠন 'কিডনি ওয়ারিয়র্স ফাউন্ডেশন'-এর সিইও বসুন্ধরা রাঘবন বলেন, বৈধ ডোনারের ঘাটতি এই অবৈধ বাজারকে বাড়িয়ে তুলছে।
তিনি বলেন, 'চরম অসুস্থ রোগীরা তখন বাধ্য হয়ে বেআইনি পথ বেছে নিচ্ছে, আর এই পদ্ধতি গরিবদের শিকার বানাচ্ছে।'
তিনি স্বীকার করেন, ভারতের আইন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাণিজ্য ঠেকাতে করা হলেও বাস্তবে তা কেবল পাচারকে গোপনে চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
রাঘবনের মতে, 'যদি এই বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ না করা যায়, তাহলে অন্তত একটি নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যেমন ডোনারদের বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের পর এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া, আর ভবিষ্যতের জন্য তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।'
এদিকে কালাই উপজেলায় সফিরউদ্দিন এখন বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন। আগের মতো আর চলাফেরা করতে পারেন না, শরীরেও আগের মতো শক্তি নেই। তিনি বলেন, 'ভালোভাবে কাজ করতে পারি না।'
তিনি বলেন, এমন অনেক রাত যায়, যখন তিনি ঘুমাতে পারেন না—দালালদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি, আর তার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলো মনে পড়ে। জানেন না, তার অসম্পূর্ণ বাড়িটা আর কোনোদিন শেষ হবে কি না।
অপারেশন করে তিনি ভেবেছিলেন হাতে অনেক টাকা আসবে, একটা ভবিষ্যৎ গড়বেন। কিন্তু তার বদলে সন্তানরা পেয়েছে অসুস্থ এক বাবা, আর তিনি পেয়েছেন একরাশ প্রতারণা আর শূন্যতা।
সফিরউদ্দিন বলেন, 'তারা আমার কিডনি নিয়ে উধাও হয়ে গেল।'
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়