কিডনি দাতার তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন ভাতিজা-ভাতিজি ও ভাগ্নে-ভাগ্নি

কিডনি প্রতিস্থাপন সহজ করতে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন সংশোধন করে নিকট আত্মীয়ের পরিধি বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। এতে কিডনি দাতার তালিকায় নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছেন আপন ভাতিজা-ভাতিজি ও ভাগ্নে-ভাগ্নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ফেব্রুয়ারিতে এবং সর্বশেষ গতকাল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দুটি বৈঠক করেছে। বৈঠকগুলোর মূল বিষয় ছিল কিডনি দাতার তালিকায় নিকট আত্মীয়ের পরিধি বাড়ানো। আগামী সপ্তাহে আরেকটি বৈঠকের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। আগামী জুনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের আশা করছে সরকার।
কিডনি এওয়ারনেস, মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন নামের সংগঠনের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, দেশে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত, আর প্রতি বছর ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার রোগী পার্মানেন্ট কিডনি ফেইলারে ভোগেন। বছরে ৫ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলেও হয় মাত্র প্রায় ৪০০টি। মূলত দাতার সংকটের কারণেই এ ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন–২০১৮ অনুযায়ী, বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীসহ ২২ ধরনের নিকট আত্মীয় কিডনি দান করতে পারেন। তালিকায় আছে আপন চাচা-ফুফু, মামা-খালা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনিসহ আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই-বোন। এবার এতে যুক্ত করা হচ্ছেন আপন ভাতিজা-ভাতিজি ও ভাগ্নে-ভাগ্নি।
সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে এক সভা হয়। সেখানে বিশেষজ্ঞরা আপন ভাতিজা-ভাতিজি এবং ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিকট আত্মীয়ের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেন। তবে প্রতারণা ঠেকাতে দাতাদের পরিচয় যাচাইয়ের নির্ভরযোগ্য প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম খুরশিদ আলম। তিনি বলেন, "আপন ভাতিজা-ভাতিজি ও ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিকট আত্মীয়ের তালিকায় যুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তাদের পরিচয় প্রমাণের উপায় নিয়ে মতামত নেওয়া হয়েছে, কারণ ভাই-বোন মারা গেলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেও সরাসরি প্রমাণ কঠিন হয়।"
তিনি জানান, সরকার সোয়াপ ট্রান্সপ্লান্ট চালুর কথাও ভাবছে। এতে নিকট আত্মীয় না থাকলেও কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে।
'কিডনি সোয়াপ' মূলত তখন ঘটে যখন একজন জীবিত কিডনি দাতা তার নির্ধারিত প্রাপকের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হন, কিন্তু অপেক্ষমাণ তালিকার থাকা অন্য কারও সঙ্গে মিল পান। ফলে, দুজন জীবিত দাতার কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়।
পূর্ববর্তী বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, এজন্য একটি সরকারি তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে, যেখানে দাতা ও গ্রহীতারা নিবন্ধিত থাকবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেখানে থেকে উপযুক্ত দুইটি জুটি খুঁজে বের করবে এবং উভয় পক্ষের অস্ত্রোপচার একই দিনে, একই হাসপাতালে সম্পন্ন করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. এ কে এম খুরশিদ আলম বলেন, "তবে সোয়াপ ট্রান্সপ্লান্টের সফল বাস্তবায়নে একসঙ্গে ১২-১৫টি চিকিৎসক দল প্রয়োজন হবে। এছাড়া টিস্যু ও ব্লাড গ্রুপ মেলে না—এমন নিকট আত্মীয়ের ক্ষেত্রে সোয়াপের মাধ্যমে প্রতিস্থাপনের হার বাড়ানো সম্ভব হবে।"
আত্মীয়দের মধ্যে কিডনি সোয়াপ ট্রান্সপ্লান্টের পাশাপাশি ক্যাডাভেরিক কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট (ব্রেন ডেথ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন) বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
ডা. এ কে এম খুরশিদ আলম বলেন, "ব্রেন ডেথ রোগীর অঙ্গ দান উৎসাহিত করতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন, বিশেষ দিবসে স্মরণ, গণমাধ্যমে প্রচার এবং সফল ট্রান্সপ্লান্ট গ্রহণকারীদের গল্প প্রকাশের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন।"
কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়াতে আইনে জীবিত দাতাদের জন্য সম্মাননা ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধাসহ নানা উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে, যা ৬০ দিনের মধ্যে দেওয়া হবে। জীবদ্দশায় কেউ অঙ্গ দানের অঙ্গীকার করলে, মৃত্যুর পরে তার উত্তরাধিকারীর সম্মতি নেওয়ার বিধানও আইনে যুক্ত করা হবে। ক্যাডাভেরিক দাতাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার কথাও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের পাশাপাশি ব্যোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বাড়াতেও উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এজন্য নীতিমালা সংশোধন করা হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. এম এ খান বলেন, "যেসব কেন্দ্রে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়, সেখানে নীতিমালার সংশোধন করা হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোতেও মান বজায় রাখতে মনিটরিং জোরদার করা হবে। ব্যোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বাড়াতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হবে।"