ফিদা হুসেনের চিত্রকর্ম নিলামে বিক্রি হলো ১৩.৭ মিলিয়ন ডলারে

প্রয়াত ভারতীয় শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের চিত্রকর্ম নিলামে রেকর্ড দামে বিক্রি হওয়ার পর শিল্প জগতে বড় আলোড়ন তৈরি হয়েছে। আধুনিক ভারতীয় শিল্পীর কোনো কাজ এত বেশী দামে নিলামে বিক্রি হওয়ারও রেকর্ড এটি। চিত্রকর্মটি অনুমানকৃত মূল্যের চেয়েও চার গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে এবং এটি বর্তমানে ২০২৫ সালের সবচেয়ে দামি শিল্পকর্ম।
১৯৫৪ সালে ১৩টি প্যানেলে আঁকা আধুনিক দক্ষিণ এশীয় শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্মটি গত মাসে নিউ ইয়র্কে রেকর্ড ১৩.৭ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে। অথচ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এই মাস্টারপিসটি নরওয়ের একটি হাসপাতালের করিডরে ধুলো জমা অবস্থায় ঝুলছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পীরা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা শিল্পীদের সমান স্বীকৃতি পায়নি। বিশ্ববিখ্যাত গ্যালারি এবং সংগ্রহশালা গুলোতে তাদের কাজ খুব কম প্রদর্শিত হয়েছে, তাদের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীগুলোর সংখ্যা ছিল সীমিত এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প মেলাগুলোতে তাদের উপস্থিতি ছিল কম।
তবে সম্প্রতি এমন কিছু সংকেত পাওয়া যাচ্ছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এবং ভারতীয় শিল্প, বিশেষত আধুনিক এবং সমকালীন শিল্প এখন একটি 'গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত' উপভোগ করছে।
গত কয়েক বছরে ২০ শতাব্দীর প্রধান ভারতীয় শিল্পীদের চিত্রকর্ম নিলামে রেকর্ড মূল্যে বিক্রি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অনলাইন আর্ট ব্রোকার আর্টসি-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতীয় শিল্পীদের প্রতি চাহিদা অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি ছিল।
ক্রিস্টি'স নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ এশীয় আধুনিক এবং সমকালীন শিল্প বিভাগের প্রধান নিশাদ আভারি বলেন, 'মার্চ মাসে হুসেনের চিত্রকর্মটি রেকর্ড দামে বিক্রি হওয়া, যা আয়োজন করতে দশকেরও বেশি সময় লেগেছে, ভারতীয় শিল্পীদের স্বীকৃতি এবং গতিবিধির বড় পরিবর্তনের প্রতিফলন।
তিনি বলেন, 'গত দুই বছর ধরে ভারতীয় শিল্পের পরিবেশ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। অনেক নতুন অংশগ্রহণকারী এসেছে এবং নতুন এক আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, যা চাহিদাকে উৎসাহিত করছে। এইসব আলোচনাগুলো অনেক নতুন জায়গায় শুরু হয়েছে, যা অনেক দেরিতে হলেও ঘটছে।'

'বিশ্ব কখনো আমাদের গুরুত্বের সাথে নেয়নি'
ভারতে এক সময় শিল্পের উত্থান ঘটেছিল, বিশেষত ২০০০-এর দশকের প্রথমভাগে। তখন আধুনিক ভারতীয় শিল্পকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা শুরু হয় এবং দামের ঊর্ধ্বগতি ঘটেছিল। তবে অনেকেই এটিকে একটি অনুমান হিসেবে দেখছিলেন, যেহেতু কিছু ব্যক্তিরা দ্রুত বিভিন্ন শিল্পকর্ম কিনে সেগুলো বিক্রি করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তবে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর তা ধ্বংস হয়ে যায়।
এখনকার পরিস্থিতি একেবারে আলাদা বলে জানিয়েছেন শিল্পী, কিউরেটর এবং গ্যালারির মালিকরা। ভারতের অন্যতম প্রধান গ্যালারি নেচার মোর্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অপরাজিতা জৈন জানান, এবার ভারতের আধুনিক শিল্পীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে এবং সমকালীন শিল্প স্বীকৃতি পাচ্ছে। তিনি বলেন, শিল্পকর্মগুলো মানুষ কেনার পর দেয়ালে ঝুলানোর জন্য সংগ্রহ করছে, 'শুধু লাভের জন্য বিক্রি করার উদ্দেশ্যে' নয়।
ভারতে দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত অর্থায়ন না থাকার কারণে জাদুঘর ও গ্যালারিগুলোতে প্রভাব পড়েছে। এবং তা থেকে শুধু কিছু নির্বাচিত আধুনিক শিল্পী সুবিধা পেয়েছেন।
তবে, ভারতীয়দের মধ্যে ধনসম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে। অপরাজিতা জৈন বলেন, 'প্রধান সমস্যা ছিল, কেউ ভারতীয় প্রদর্শনীগুলোকে অর্থায়ন করত না। কিন্তু এখন ভারতীয়রা ধনী হওয়ার সাথে সাথে তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, শুধু পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।'
সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাইভেট গ্যালারি এবং মিউজিয়ামের সংখ্যা বেড়েছে, যা ২০ শতকের ভারতীয় আধুনিক মাস্টারদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের সমকালীন শিল্পীদেরও সমর্থন করছে। দিল্লিতে প্রতিবছর একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্ট ফেয়ার অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং নতুন প্রজন্মের ভারতীয় শিল্প সংগ্রাহকরা সমকালীন শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
২০২৩ সালে বেঙ্গালুরুতে একটি নতুন আর্ট অ্যান্ড ফটোগ্রাফি জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়েছে। আধুনিক ও সমকালীন শিল্পের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষক কিরণ নাদার আগামী বছরে দিল্লিতে একটি বড় জাদুঘর খুলবেন। এছাড়া, দেশের বড় বড় শিল্পপতিরা সম্প্রতি মুম্বাই এবং হামপিতে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং জয়পুর রাজপরিবার সম্প্রতি সিটি প্যালেসে একটি শিল্পকেন্দ্র খুলেছে।
ভারতের আধুনিক শিল্পী সম্প্রদায় এই মুহূর্তটিকে দেশটির শিল্পাঙ্গনের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দিল্লির বহুমুখী শিল্পী তারিনী শেঠী বলেন, 'তিন-চার বছর আগে পর্যন্ত ভারতের শিল্প বাজার, ক্ষমতাসীনরা, প্রতিষ্ঠানগুলো, গ্যালারি এবং সংগ্রাহকরা ভারতীয় শিল্পীদের আন্তর্জাতিক শিল্পীদের মতো গুরুত্ব দিত না। এর মানে ছিল, বিশ্বের কাছে আমাদের গুরুত্ব ছিল না।'
তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। এখন আমাদের শিল্পীদের পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ এবং প্রচারণা হচ্ছে, হোক সেটা ভারত কিংবা বিদেশে গ্যালারি প্রদর্শনী। প্রথমবারের মতো সংগ্রাহক এবং গ্যালারিগুলো নতুন শিল্পীদের পেছনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।'
ভারত শুধু 'গরু-গান্ধীর চিত্রকর্ম' দিয়ে পরিচিত, এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসা
বর্তমানে অনেক আধুনিক ভারতীয় শিল্পী গ্যালারি ও পৃষ্ঠপোষকদের সমর্থন পাচ্ছেন এবং আন্তর্জাতিক গ্যালারি ও আর্ট ফেয়ারে তাদের কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে। শেঠি বলেন, এর ফলে পুরোনো ধারণা ভেঙ্গে যাচ্ছে যে, ভারত শুধু 'লোকশিল্প ও গরু-গান্ধীর চিত্রকর্ম' দিয়ে পরিচিত।
তিনি বলেন, 'এখনও অনেক পথ বাকি'। তিনি সম্প্রতি মিয়ামির আর্ট বাসেল ফেয়ারে তার কাজ প্রদর্শন করেন। কিন্তু হতাশ হন, কারণ সেখানে শুধু দুটি ভারতীয় গ্যালারি ছিল। তবে তিনি মনে করেন, 'অন্তত আমরা এখন প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নিচ্ছি।'
এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেখা যাচ্ছে। গত বছর লন্ডন, নিউইয়র্ক, এবং প্যারিসের বড় গ্যালারিগুলোতে ভারতীয় শিল্পীদের প্রদর্শনী হয়েছে। ২০২৩ ফ্রিজ আর্ট ফেয়ারে কলকাতার এক্সপেরিমেন্টার গ্যালারি সাতজন নারী শিল্পীর কাজ প্রদর্শন করে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আর্ট গ্যালারিস্ট রাজীব মেনন ভারতীয় শিল্পীদের পশ্চিমে না দেখা যাওয়ার কারণে লস অ্যাঞ্জেলেসে একটি গ্যালারি খুলেছেন। তার প্রদর্শনীতে পাকিস্তানি শিল্পী নূরমাহ জামালের কাজ রয়েছে। মেনন বলেন, শেঠির কাজসহ অন্যান্য প্রদর্শনীর প্রতিক্রিয়া খুব ভালো। এবং কয়েকটি কাজ যাদুঘরে সংগ্রহ করা হয়েছে।
মেনন বলেন, 'এই প্রদর্শনীগুলোর থিম– জলবায়ু, অভিবাসন, রাজনৈতিক অস্থিরতা– বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য হলেও এটি সবার জন্য প্রাসঙ্গিক।'
তিনি আরও বলেন, 'এই শিল্পীরা পশ্চিমে প্রদর্শনীর সুযোগ পেলে, দ্রুত একটি দর্শক মহল পাবেন। এটি কেবল শুরু।'