ছাত্রলীগ কর্মী থেকে ‘সমন্বয়ক’, রিয়াদের বাড়িতে পাকা ভবন দেখে বিস্মিত এলাকাবাসী

রাজধানী ঢাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এক সংসদ সদস্যের কাছে চাঁদাবাজির সময় চারজন সহযোগীসহ হাতেনাতে আটক হন ছাত্রলীগ কর্মী থেকে 'সমন্বয়ক' বনে যাওয়া আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার পর সংশ্লিষ্ট সংগঠন থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়।
রিয়াদের চাঁদাবাজির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর শুধু রাজধানী নয়, তার নিজ জেলা নোয়াখালীতেও শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা।
জানা গেছে, চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া রিয়াদের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে, নবীপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে। তার আচমকা উত্থানে বিস্মিত স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিয়াদের দাদা ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন রিকশাচালক। তার বাবা আবু রায়হানও প্রায় আট বছর আগে পর্যন্ত রিকশা চালাতেন। বর্তমানে তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও দিনমজুরের কাজ করে যা আয় করতেন, তাই দিয়েই চলতো সংসার।
ছেলেকে লেখাপড়া করাতে বাবাকে করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম। স্বপ্ন ছিল, রিয়াদ একদিন বড় চাকরি করে সংসারের হাল ধরবেন, মুক্তি মিলবে দীর্ঘদিনের অভাব-অনটন থেকে।
রিয়াদের মা নাজমুন নাহার একজন গৃহিণী। একসময় সংসার চালাতে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। দারিদ্র্য ও টানাপোড়েন ছিল পরিবারে নিত্যসঙ্গী। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রিয়াদ। বড় ভাই একটি ফিশারিজ কোম্পানিতে চাকরি করেন চট্টগ্রামে।
সহপাঠীরা জানান, স্থানীয় নবীপুর হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর রিয়াদ ভর্তি হন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সরকারি মুজিব মহাবিদ্যালয়ে। সেখানেই তিনি যুক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার হাতে ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন সংগঠনে। এরপর যুক্ত হন তার ঘনিষ্ঠ ক্যাডার বাহিনীতেও।
সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় গিয়ে ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে তিনি কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এবং হয়ে ওঠেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা।
তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন চাঁদাবাজিতে।
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নে রিয়াদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বদলে গেছে আগের চিত্র। নেই আগের ভাঙাচোরা ঘরদোর। পুরনো ঘরের পাশেই নির্মিত হচ্ছে একাধিক পাকা ভবন। শুধু ঘরই নয়, রিয়াদ কিনেছেন একটি দামি গাড়িও—যা দেখে বিস্মিত এলাকাবাসী।
এদিকে, ছেলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ কিছুতেই মানতে পারছেন না রিয়াদের মা-বাবা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিয়াদের মা সামসুন্নাহার বলেন, "আমরা না খেয়ে ওকে শহরে পাঠাইছি। ছেলেটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, ভালোই ছিল। টিভিতে দেখি আমার ছেলেকে পুলিশে ধরেছে। শুনছি, সে নাকি চাঁদাবাজি করছে। এটা আমার বিশ্বাস হয় না। আমার ছেলেকে কেউ ষড়যন্ত্র করে চাঁদাবাজ বানিয়েছে।"
পাশের বাড়ির এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "যে পরিবার রিকশা চালিয়ে দিন এনে দিন খেত, তাদের ছেলে ৫ আগস্টের পর হঠাৎ করে বিলাসী জীবনযাপন শুরু করল। ছাদ ঢালাই দিয়ে পাকা বাড়ি করছে—দেখে আমরা চমকে গেছি।"
জানা গেছে, রিয়াদ ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। গত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর 'সমন্বয়ক' পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন চাঁদাবাজিতে। গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান কীভাবে সমন্বয়কের পরিচয়ে এত বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করল, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলছেন এলাকাবাসী। যদিও এতদিন রিয়াদের প্রভাব ও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেননি।
নবীপুর হাই স্কুলের সাবেক সভাপতি শিহাব উদ্দিন বলেন, "আমার স্কুলের এই ছাত্রকে সবাই দান-খয়রাত করে পড়াশোনা করিয়েছে, কারণ তার দরিদ্র রিকশাচালক বাবার পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। সে কীভাবে এমন ভয়ংকর চাঁদাবাজ হয়ে উঠল, তা ভেবে কষ্ট হয়।"
স্থানীয়রা বলছেন, সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে 'সমন্বয়ক' পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া এমন আরও অনেক রিয়াদ সমাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে। তারা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, এদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার।
এদিকে, চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া রিয়াদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ছবি পাওয়া গেছে। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এসব ছবি পোস্ট করে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও প্রভাবের জানান দিতেন তিনি। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গেও রিয়াদের ছবি পাওয়া গেছে—যা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে।