বিখ্যাত চিত্রকর্মের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আটটি রহস্যময় প্রতিকৃতির গল্প

সম্প্রতি কিছু বিখ্যাত চিত্রকর্মের নিচে লুকানো রহস্যময় প্রতিকৃতি ও হারিয়ে যাওয়া মুখাবয়বের অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। গত মাসেই জানা যায়, টিশিয়ান ও পিকাসোর কয়েকটি চিত্রকর্মের নিচে গোপন প্রতিকৃতি অঙ্কিত রয়েছে। খবর বিবিসি'র।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে সাইপ্রাস ইনস্টিটিউটের 'আন্দ্রেয়াস পিটাস আর্ট ক্যারেক্টারাইজেশন ল্যাবরেটরি'র গবেষকেরা উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তি ও মাল্টি-মোডাল স্ক্যানারের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, টিশিয়ানের ১৫৭০-৭৫ সালের 'একস হোমো' চিত্রকর্মের নিচে এক উল্টো হয়ে থাকা গোঁফওয়ালা ব্যক্তির প্রতিকৃতি রয়েছে।
মূল চিত্রটিতে দেখা যায়, হাতে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন যিশু। তার পাশে রয়েছেন রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলাত, যিনি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। কিন্তু এই মুছে ফেলা রহস্যময় ব্যক্তি এখানে কী করছেন? কী বলতে চাইছেন তিনি আমাদের?

প্রখ্যাত শিল্প-ইতিহাসবিদ পল জোয়ানিদেস প্রথম পুরোনো মাস্টারপিসটির চিত্রফলকে তৈরি হওয়া সূক্ষ্ম ফাটলের মধ্যে এই লুকানো প্রতিকৃতির অস্তিত্ব শনাক্ত করেন। যদিও প্রতিকৃতির পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি চিত্রকর্মের চূড়ান্ত বিন্যাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ওই ব্যক্তির মুখাবয়বের রেখাচিত্রই যিশুর বাঁধা হাতের দড়ির বাঁক ঠিক করে দিয়েছে। ফলে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা চিত্রের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত সংযোগ।
এ ধরনের লুকানো সংযোগের আরেকটি চমকপ্রদ উদাহরণ পাওয়া গেছে পিকাসোর 'ব্লু পিরিয়ড'-এর একটি চিত্রকর্মে। লন্ডনের কোর্টোল্ড ইনস্টিটিউট অভ আর্টের সংরক্ষণবিদেরা ইনফ্রারেড ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে আবিষ্কার করেছেন, শিল্পীর বন্ধু ও ভাস্কর মাতেও ফের্নান্দেজ দে সোটোর প্রতিকৃতির নিচে লুকিয়ে আছে এক অজ্ঞাত নারীর মুখ। তুলনামূলকভাবে এটি বেশি ইম্প্রেশনিস্টিক শৈলীতে আঁকা। প্রতিকৃতিটি সামনে আনা হলে মনে হয়, ওই নারী দে সোটোর কানে ফিসফিস করে কিছু বলছেন।

আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এখন গবেষকেরা চিত্রকর্মের কোনো ক্ষতি না করেই এই লুকানো স্তরগুলো উন্মোচন করতে পারছেন। এক্স-রে স্ক্যান গোপনে আঁকা রেখাচিত্র প্রকাশ করে, আর ইনফ্রারেড রিফ্লেক্টোগ্রাফি পুরোনো বার্নিশের নিচে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম বিবরণ ফুটিয়ে তোলে।
বিভিন্ন মাস্টারপিসের নিচে এমন আরও কিছু অদ্ভুত ও রহস্যময় প্রতিকৃতির সন্ধান মিলেছে, যেগুলোর অধিকাংশই আত্মপ্রতিকৃতি। এগুলো যেন সুপরিচিত শিল্পকর্মের নিচে চাপা পড়া এক অস্থির অস্তিত্বের দূরবর্তী ইঙ্গিত।
রেমব্রান্টের 'ওল্ড ম্যান ইন মিলিটারি'
রেমব্রান্টের চিত্রকর্ম মানেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক গম্ভীর, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, যেখানে তার মডেলরা সময়ের বাইরে বসে আছেন।

কিন্তু গবেষকেরা যখন 'অ্যান ওল্ড ম্যান ইন মিলিটারি কস্টিউম' চিত্রকর্মে ম্যাক্রো এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স ইমেজিং ও ইনফ্রারেড রিফ্লেক্টোগ্রাফি প্রয়োগ করেন, তখন এক উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত যুবকের প্রতিকৃতি আবিষ্কৃত হয়। চকচকে সবুজ ও উজ্জ্বল লাল রঙে সজ্জিত এই যুবক যেন জীবন ও উচ্ছ্বাসের প্রতিচ্ছবি। এটি রেমব্রান্টের চূড়ান্ত শিল্পকর্মের গাম্ভীর্যকে আরও গভীরভাবে স্পষ্ট করে, তার অন্তর্নিহিত চঞ্চল আত্মার ইঙ্গিত দেয়।
আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেসকির 'সেন্ট ক্যাথরিন অব আলেক্সান্দ্রিয়া'

কিছু চিত্রকর্ম আছে, যেগুলো যত বেশি দেখা হয়, ততই রহস্য গভীর হয়। তেমনই এক চিত্রকর্ম আর্টেমিসিয়া জেন্টিলেসকির ১৬১৯ সালের 'সেন্ট ক্যাথরিন অব আলেক্সান্দ্রিয়া'। ২০১৯ সালে এক্স-রে বিশ্লেষণে জানা যায়, ইতালিয়ান এই ব্যারোক শিল্পী প্রথমে এটিকে নিজের আত্মপ্রতিকৃতি হিসেবে এঁকেছিলেন। চূড়ান্ত চিত্রকর্মে শিল্পীর নিজস্ব মুখাবয়বের সঙ্গে ক্যাথরিনা দে মেডিচির মুখাবয়বের সংমিশ্রণ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
কারাভাজ্জোর 'বাক্কাস'

কারাভাজ্জো জীবদ্দশায় মাত্র একবার নিজের চিত্রকর্মে স্বাক্ষর করেছিলেন। ১৬০৮ সালের 'দ্য বিহেডিং অভ সেন্ট জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট'-এর নিচে লাল কালি দিয়ে এক অদ্ভুত উপায়ে এই স্বাক্ষর করা হয়। ২০০৯ সালে উন্নত প্রতিফলন প্রযুক্তির মাধ্যমে গবেষকেরা তার 'বাক্কাস' চিত্রকর্মের রং-এর স্তর ভেদ করে এক ক্ষুদ্র আত্মপ্রতিকৃতি খুঁজে পান, যা তিনি একটি স্ফটিকের ক্যারাফের প্রতিফলনে গোপন করেছিলেন।
সেরার 'ইয়াং ওম্যান পাউডারিং হারসেলফ'

এই চিত্রকর্মে জর্জ সেরা তার পরিপূর্ণ বিন্দু-শৈলী (পয়েন্টিলিজম) ব্যবহার করেছেন। ছবির সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, এতে লুকিয়ে থাকা সেরার একমাত্র আত্মপ্রতিকৃতি। এটি তিনি একটি জানালার কাচে প্রতিফলিত করেছিলেন, পরে তা ফুলের টবের বিন্দুযুক্ত রঙের স্তর দিয়ে ঢেকে দেন।
মোদিগলিয়ানি, ম্যাগ্রিট ও তাদের লুকানো গল্প

আমেদেও মোদিগলিয়ানির ১৯১৭ সালের 'পোর্ট্রেট অব আ গার্ল' চিত্রকর্মের নিচে আরও একটি সম্পূর্ণ প্রতিকৃতি রয়েছে। ২০২১ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় গবেষকেরা এই লুকানো ছবিটি পুনর্গঠন করেন, যা শিল্পীর এক প্রাক্তন প্রেমিকা বিট্রিস হেস্টিংসের সঙ্গে মিলে যায়।
রেনে ম্যাগ্রিটের 'লা সিনকিয়েম সিজন'

রেনে ম্যাগ্রিটের 'লা সিনকিয়েম সিজন' চিত্রকর্মেও ইনফ্রারেড স্ক্যানের মাধ্যমে পাওয়া গেছে এক রহস্যময় নারীর প্রতিকৃতি, যা ম্যাগ্রিটের স্ত্রী জর্জেটের সঙ্গে কিছুটা মিল রাখে।