Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

Monday
December 15, 2025

Sign In
Subscribe
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
MONDAY, DECEMBER 15, 2025
গোলাম কাসেমের পুনর্জন্ম

ইজেল

দীন মোহাম্মদ শিবলী
23 November, 2025, 03:20 pm
Last modified: 23 November, 2025, 03:23 pm

Related News

  • ইভি, সৌরবিদ্যুতের পর ভবিষ্যতে যেসব ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করবে চীন
  • আলোকচিত্রী শহিদুলের মামলা বাতিল হাইকোর্টের; আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বহু মামলা বাতিলের সুযোগ
  • মিডিয়া ফ্লোটিলায় গাজায় যাচ্ছেন শহিদুল আলম
  • বেক্সিমকোর পর নাসা গ্রুপকেও সহায়তার সিদ্ধান্ত সরকারের, কারখানা সচল রাখতে উদ্যোগ
  • ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র’: প্রজন্ম পেরোনো শিল্পযাত্রায় অনন্য যারা

গোলাম কাসেমের পুনর্জন্ম

দীন মোহাম্মদ শিবলী
23 November, 2025, 03:20 pm
Last modified: 23 November, 2025, 03:23 pm

গোলাম কাসেম (১৮৯৪-১৯৯৮)। গ্লাসপ্লেট নেগেটিভ, পশ্চিম বাংলা, ব্রিটিশ ভারত, ১৯২২। সম্ভবত এটি তাঁর প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি বা সেলফ পোর্ট্রেট। আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ফটোজিয়ামের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ছবিটি।

বাংলাদেশের আলোকচিত্রণের বিবর্তনের ইতিহাস অধ্যায়ন সাবলীল নয়। অনেক লেখকের দ্বারা নানান ধরনের খণ্ড খণ্ড লিপিবদ্ধ বয়ান জোড়া দিয়ে দিয়ে সমগ্র চিত্রের অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়ে। পাশাপাশি এই ইতিহাসটি শব্দে লিপিবদ্ধ হওয়ার চাইতে বেশি রয়েছে ওরাল বা মৌখিকভাবে। নিজ মুখে আলোকচিত্রণের ইতিহাসকে বলতে ও ব্যাখ্যা করতে পারতেন যে মানুষগুলো, ২০২৫-এ এসে তাদের অধিকাংশকেই আমরা এখন আর পাব না। তারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কেউ কেউ! যার অধিকাংশই এখনো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে এখনো কিছুটা আশা রয়েছে এই অঞ্চলের আলোকচিত্রণের ইতিহাসকে বড় ও তথ্যসমৃদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করার। ইতিহাস সংকলনের এই ধারায় সচেতন ও নির্মোহ হতে না পারলে বিপত্তি সৃষ্টি হতে বাধ্য। অধুনা কিছু আগ্রহী সংকলকের কাজ লক্ষ করা যায়, যারা চেষ্টা করছেন কিছুটা বড় ক্যানভাসে আলোকচিত্রণের ইতিহাসের মুখ্য কুশীলবদের চিত্রিত করার। নির্মোহ হতে না পারার কারণে কিছু কিছু বিপত্তি ঘটে গেছে। তার কিছুটা সত্যানুসন্ধান এই নিবন্ধে করার চেষ্টা আছে। প্রথমেই একটি উল্লেখ করলাম, 'ড্যাডি যখন ছবি তোলা শুরু করেন, তখন ইংরেজদের মধ্যে যারা উঁচু পদে ছিলেন, তারা শখ করে ছবি তুলতেন। ফটোগ্রাফি তখন সাধারণের নাগালের বাইরে। সে সময় একজন বাঙালি মুসলমান কিশোর মনকে ভালো রাখতে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতেনÑভাবা যায়! ১৯১২ সালে এলসি নামের এক খ্রিষ্টান তরুণীর মন পেতে ক্যামেরা হাতে নেন ড্যাডি, বয়স তখন ১৮। কালক্রমে এই প্রেমিক কিশোরটিই বাংলাদেশের আলোকচিত্রের পথিকৃৎ হয়ে উঠলেন। হয়ে উঠলেন আলোকচিত্রীদের পিতাস্বরূপ "ড্যাডি" (আলোকবিহারী ড্যাডি, সাহাদাত পারভেজ, দৈনিক দেশ রূপান্তর, জানুয়ারি ৯, ২০২১)। ঠিক একই রকম তথ্যগত বিপত্তি দেখা যায় আরফান আহমেদের লেখাতেও, '...বাঙালি মুসলমান, সে সময়ে আলোকচিত্রে তিনিই প্রধান। প্রথমও হবেন হয়তো সৌখিন দুনিয়ার। আচার্য মনজুর আলম বেগ তাই নাম ধরে দেন ড্যাডি। তার ইন্দিরা রোডের সেই বাড়িটায়, বাঙালির আলোকচিত্রের প্রথম নায়কেরা গুলজার করে রাখতেন। সেই ভাবুক কিশোর কবেই হাত ধরে বাঙালির আলোকচিত্রের যৌবন টেনে এনেছেন। বেঁচেও ছিলেন এক শতক। প্রথম বাঙালি মুসলমান গল্পকার, সওগাত পত্রিকায় তার খোঁজ পেয়ে যাবেন। তারপর তো অই কালো কামরার নেশায় আর কিছু হয়ে ওঠা হলো না। ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব, এই সবই তাঁর গড়া। কী অদ্ভুত মানস অভিযানে কেটে গেল জীবন (গোলাম কাশেম: নিরুদ্দেশ ভাবনার চোখ, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের ফেসবুক পোস্ট, ২০২০)।

শততম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এম এ বেগ, গোলাম কাসেম ড্যাডি এবং কবি সুফিয়া কামাল। ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব, ইন্দিরা রোড, ঢাকা। আলোকচিত্র: মীর শামছুল আলম বাবু, নভেম্বর ৫, ১৯৯৩

ব্রিটিশ কলোনিয়াল ভারতে ক্যামেরা এসে পৌঁছায় এটির জন্মের এক বছর পরে ১৮৪০ সালে। ক্যামেরা দ্বারা আলোকচিত্র নির্মাণের পদ্ধতিগত সফল যাত্রা ও চর্চা তখন ঠিকমতো শুরুই হয়নি। আলোকচিত্র তৈরির দাগেরোটাইপের যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতির কারণে পরবর্তী চার বছর এর বিস্তৃতির কোনো লক্ষণ ভারতবর্ষে দেখা যায়নি। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দাগেরের ক্যামেরা আবিষ্কারের একই সময়ে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হেনরি ফক্স ট্যাবলেটের ক্যালোটাইপের উন্নত সংস্করণ ১৮৪৪ সালে ভারতে এসে পৌঁছালে তবেই আলোকচিত্রণের পথচলায় গতি আসে। ক্যামেরা আসার ৫৪ বছর পরে গোলাম কাসেম (তাঁর প্রকৃত নাম গোলাম কাসেম আল্লারাখা) ভারতের জলপাইগুড়িতে ১৮৯৪ সালের ৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তারও ১৮ বছর পর ১৯১২ সালে তিনি দৈবৎ ক্যামেরার সামনে হাজির হন। ১৮৪০ থেকে ১৯১২ সাল, এই ৭২ বছরে তৎকালীন বাংলার রাজধানী কলকাতার পথে-ঘাটে শত শত আলোকচিত্রীদের পদচারণা ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে গোলাম কাসেমের পথচলা বা তাঁর ছবির উপস্থিতি ইতিহাসের বয়ানের মূলস্রোতে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে এলসির কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ছিলেন গোলাম কাসেমের বন্ধুর ভাগনি এবং তাঁর থেকে বয়সে এক বছরের বড় একজন নারী। গোলাম কাসেমের বয়ানে উঠে আসা তাঁর নিজের জীবনের স্মৃতিকথা থেকে প্রেমের কোনো ঘটনা উল্লেখ না থাকলেও মূলত ছিল বয়ঃসন্ধিকালীন এক কিশোরের জেদের গল্প। এই জেদই গোলাম কাসেমকে ফটোগ্রাফিতে টেনে আনে। তাঁর ড্যাডি নামটি তাঁকে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক আলোচিত্রণের জনক আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ। কেননা গোলাম কাসেম ছিলেন নিঃসন্তান। সবাই তাঁকে বিভিন্ন সম্বোধন করে ডাকতেন। প্রবীণতম মানুষটিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় দেয়া এই ড্যাডি নামটি তাঁকে পুনর্জন্ম দিয়েছিল। তাই জনকসংক্রান্ত আলোচনাটিতে একটি 'দাঁড়ি' যতিচিহ্ন টানা দরকার এখনই। আর ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফির প্রতিষ্ঠাকালের অবস্থা, কর্মপরিধি ও স্থায়িত্ব নিয়ে আলোচনা ছাড়া শুধু প্রথম হওয়া নিয়ে আলোচনা গোটা বিষয়টিকে অর্থবহ করে তোলে না। ইতিহাসের ব্যাখ্যায় প্রথম হওয়া এবং স্বার্থক হওয়া দুটিকে এক কাতারে আলোচনা করা অন্যায্য। অন্যদিকে ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রত্যক্ষ হাত ছিল এম এ বেগসহ অন্যদের। গোলাম কাসেমের নিজের বয়ানেই জানা যায়, তিনি তাঁর বাড়ির বাইরে গিয়ে সমাজের জন্য বড় কিছু করতে আগ্রহী ছিলেন না। একাকী, নিঃসন্তান, সংসারবিমুখ মানুষটি চেয়েছিলেন অবসরের সময়টিতে আনন্দে, আড্ডায়, গানবাজনা করে ও ফটোগ্রাফি নিয়ে থাকতে। 

নিজের শততম জন্মদিনে গান গাচ্ছেন গোলাম কাসেম ড্যাডি। ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব, ইন্দিরা রোড, ঢাকা। আলোকচিত্র: মীর শামছুল আলম বাবু, নভেম্বর ৫, ১৯৯৩

আবার দৃষ্টি ফেরাই আলোকচিত্রণের অতীত ইতিহাসের দিকে। পূর্ব বাংলায় আলোকচিত্রণের ইতিহাসের মুখ্য কুশীলবদের মধ্যে হীরালাল সেনের নাম আসে সর্বাগ্রে। আলোকচিত্রণ এবং চলচ্চিত্রে হীরালাল সেনের নাম আলোচনায় এলেই মূলত তা গড়িয়ে যায় চলচ্চিত্রের দিকে। কিন্তু চলচ্চিত্রের আগে আলোকচিত্রণে তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তৎকালীন সময়ের ইংরেজ বাবু এবং নবাব-জমিদারদের আয়েশি আলোকচিত্রণ চর্চার মধ্যে হীরালাল সেন ছিলেন ব্যতিক্রম এবং একটি দুর্লভ রত্ন। তাঁর তোলা ছবি সকলের মধ্যে সেরা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। হীরালাল সেন বিষয়ে নাসির আলী মামুন লিখেন, '...১৮৯০ সালে হীরালাল সেন ও তাঁর ভাই মতিলাল সেন "অমরাবতী ফাইন আর্ট অ্যাসোসিয়েশন" নাম দিয়ে ফটোগ্রাফির স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তাঁরা "হীরালাল সেন অ্যান্ড ব্রাদার্স" নামে কলকাতার ১৫১ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে কমার্শিয়াল স্টুডিও স্থাপন করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে "বেঙ্গল স্টুডিও" নামে একটি স্টুডিওর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। স্টুডিওটির প্রতিষ্ঠাকাল ও ঠিকানা এখনো বিশদভাবে জানা যায়নি। অনুপম হায়াৎ উল্লেখ করেছেন, পুরান ঢাকার ৩০/৫ জিন্দাবাহার লেনে চৌধুরী পরিবারের একটি অ্যালবামে লেমিনেটিং করা দুটি ছবিতে এই স্টুডিওর নাম পাওয়া যায়। "ল্যাব ঢাকা" নামে আরেকটি স্টুডিওর নাম জানা গেছে। এই স্টুডিওর জীবৎকাল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ছিল বলে জানা যায়। ১৯১০ সালে "আর সি দাস অ্যান্ড সন্স" নামে একটি স্টুডিও ঢাকার ১৬ নম্বর নবাবপুর রোডে অবস্থিত ছিল। ওয়াজেদ আলী ছিলেন ফটোগ্রাফার। মুনশী সুরু আলীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ফটোগ্রাফ পাওয়া গেলে তাঁর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। 

ইতিহাসে হীরালাল সেনের আলোকচিত্রণের পথে চলা অন্য কুশীলবদের মধ্যে একজন হলেন এই অঞ্চলের প্রবীণতম (১০৪ বছর) আলোকচিত্রশিল্পী ও ছোট গল্পকার গোলাম কাসেম। তিনি গোলাম কাসেম ওরফে 'ড্যাডি' নামে এখন বেশি পরিচিত ও আলোচিত। এটি গোলাম কাসেমের জীবনের বেশ চমকপ্রদ একটি অধ্যায়। 

বাংলাদেশের আলোকচিত্রণের ইতিহাস ও বিবর্তন চিত্রিত করতে হাতে গোনা কিছু উৎসাহী মানুষ অতীতে চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রাজ্ঞ ও গুণী আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন অন্যতম। তিনি এ দেশের প্রবীণতম আলোকচিত্রশিল্পী গোলাম কাসেমকে (ড্যাডি) আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এটি ছিল গোলাম কাসেমের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। যেখানে গোলাম কাসেম তাঁর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা ও আত্মস্মৃতিমূলক অনুধাবনকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন প্রশ্নের ভিত্তিতে। পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি, নাসির আলী মামুন, আদর্শ প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০২০, ঢাকা।

গোলাম কাসেম সৃজনশীল শিল্পজগতের দুটি ধারায় একসাথে বসবাস করেছেন। দীর্ঘ সময় ছোট গল্পকার হিসেবে এবং পাশাপাশি আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর পথচলা ট্রেন লাইনের মতো সমান্তরাল। কিন্তু কলম হাতে গল্পকার হিসেবে তাঁর পথচলা ধীর বা প্রায় থেমে গেলেও ক্যামেরা হাতে আলোকচিত্রের দ্বারা শিল্প সৃষ্টির পথচলা প্রায় আট দশকের মতো সচল থেকেছে। এ এক বিস্তৃত ও বর্ণিল সৃষ্টিশীল যাত্রার স্পষ্ট ট্রেইল! এই অঞ্চলে আলোকচিত্রণের যাত্রায় গোলাম কাসেমকে অধ্যায়ন করতে গিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, তাঁর জীবনে বারবার পুনর্জন্ম ঘটেছে। 

প্রায় সকল স্তরের লেখক ও সংকলকের লেখায় বা আলোচনায় গোলাম কাসেমকে নিয়ে কথা বলার বা লেখার শুরুতে তাঁর জন্মক্ষণকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঘটনাটি ছিল মারাত্মক বিপজ্জনক একটি সময়ের, যেখানে জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর জীবন শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তিনি বেঁচে রইলেন; আর হারালেন জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ মাকে। তাঁর মা জামেদা খাতুনের মৃত্যু হয় রাস্তাতেই। গোলাম কাসেম নিজ হাতে স্বল্প শব্দ চয়নে তাঁর জন্ম ও প্রথম পুনর্জন্মকে এভাবে উদ্ধৃত করেন:

 'হিমালয়। পৃথিবীর বৃহত্তম ও সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয়। হিমালয়ের হিম ভান্ডার হইতে হিমের তীক্ষ্ম ধারা পর্বতের চতুষ্পার্শে বহুদূর পর্যন্ত বহিয়া চলিয়াছে। তুষার প্রবাহ শুভ্র তুলার ন্যায় প্রবাহিত হইতেছে। আর সেই তুষার সমুদ্রের ভিতর দিয়া তিনটি গরুর গাড়ি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ শব্দে দুর্গম পার্বত্য পথে মন্থর গতিতে অগ্রসর হইতেছে। একটি গাড়ি হইতে নারীকণ্ঠে যাতনাব্যঞ্জক স্বরে আর্তনাদ উঠিল, "ওঃ, মাগো! গাড়ি থামাও।' তিনটি গাড়িই থামিল, কিছুক্ষণ পরে নবজাত শিশুর ক্রন্দনধ্বনি উঠিল, "ট্যা-ট্যা, ওয়াও-ওয়াও!" অর্থাৎ "তোমরা সকলে শোন, আমি আসিয়াছি, আমি আসিয়াছি।" হিমালয়ের পাদদেশে নির্জন, নিস্তব্ধ, লোকালয়বর্জিত একস্থানে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করিল। সময়টা ছিল ৫ই নভেম্বর ১৮৯৪ সন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ভারতীয় সেনাদের তাঁবু, গ্লাসপ্লেট নেগেটিভ, বাঁকুড়া, পশ্চিম বাংলা, ব্রিটিশ ভারত। আলোকচিত্র: গোলাম কাসেম ১৯১৮/ফটোজিয়াম

'শিশু তো জন্মগ্রহণ করিল, কিন্তু সেবাযত্ন শুশ্রƒষার অভাবে মাতা শিশুটিকে জন্ম দিবার কিছুক্ষণ পরেই পরলোক গমন করিলেন। এখন শিশুটির কী অবস্থা? মাতৃহীন শিশু, তুষার হিমলির তীক্ষè দংশন, এ সকল প্রচণ্ড নির্যাতন, কী রূপে সহ্য করিয়া অনাহারে সে বাঁচিবে? শিশুর মর্মাহত পিতা বলিলেন, "ওটাকে রেখে আর কী হবে? ও তো বাঁচবে না। ওকে ফেলে দাও। যাক্, ও ওর মায়ের কাছে চলে যাক।" কিন্তু শিশুকে ফেলা হইল না। সে রহিয়া গেল এবং শুধু রহিয়া গেল না, নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছিবার পরই, অতি অপ্রত্যাশিতভাবে, তাহার আহারেরও সংস্থান হইয়া গেল। সৃষ্টির বিচিত্র কার্যকলাপ মানুষের বুদ্ধির অতীত। মৃত মাতার এক আত্মীয়ার সবেমাত্র শিশুপুত্রটি মারা যাওয়ায়, তাহার বক্ষ শূন্য হইয়াছিল। স্বহৃদয়া আত্মাটি এই শিশুটিকে আপন বক্ষে টানিয়া লইল। অবহেলা, অযত্ন, নির্যাতনÑএই সকলের মধ্য দিয়া শিশুটি তাহার জীবনপথে অগ্রসর হইতে লাগিল। কালক্রমে সে একজন সুন্দর স্বাস্থ্যবান তরুণে পরিণত হইল। তখন তাহার বয়স অষ্ঠাদশ। সে ম্যাট্রিক ক্লাশের ছাত্র।' (স্মৃতিকথা, গোলাম কাশেম ড্যাডি, ফটোগ্রাফি, বর্ষ ৩, সংখ্যা ১, জানুয়ারি ১৯৯৪)। 

গোলাম কাসেমের সাথে ক্যামেরার দেখা হয় ১৯১২ সালে ১৮ বছর বয়সে। আগেই বলেছি ভারতবর্ষে তত দিনে ফটোগ্রাফির বয়স ৭২ পেরিয়ে গেছে। ইতিহাসের অধ্যায়নে এখনো অন্তত আমার চোখে পড়েনি, গোলাম কাসেম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তুলেছিলেন স্টুডিওতে বা অন্য কোথাও। গোলাম কাসেম তাঁর স্মৃতিকথায় আলোকচিত্রণের সাথে তাঁর সূচনা পর্বটি লিখেছেন বেশ মজা করেই, 'ক্লাশের ছুটির পর আমি রথিনদের বাসায় বেড়াতে গেলাম। রথিন আমার সহপাঠি, তারা ক্রিশ্চিয়ান। ওর পড়ার ঘরে ঢুকে দেখি টেবিলের ওপর একটা ছোট্ট কালো রঙের বাক্স। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওটা একটা ক্যামেরা। এনসাইনের কোয়াটার সাইজের বক্স ক্যামেরা। একবারে ছয়খানা করে প্লেট লোড করা হয় ছবি তোলার জন্য। আমি অবাক হয়ে রথিনকে বললাম, "তুমি ছবি তুলবে? তুমি কি ফটোগ্রাফার?" রথিন হেসে বললে, "আরে না না, আমি ফটোগ্রাফার নই। তবুও আমি ছবি তুলব।" কয়েক দিন পর সে কয়েকখানি ছবি তুলল, তার পরিবারের সকলের ও আমারও। কিন্তু ছবিগুলো হলো না। কী গোলমাল হয়ে ওগুলি সব নষ্ট হয়ে গেছে। রথিন আর একবার চেষ্টা করল, সেবারও সে অকৃতকার্য হলো। দ্বিতীয়বার সে যখন ডার্করুমে প্লেট রেখে নেগেটিভ করছিল, তখন আমি উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম, ডেভেলপারে প্লেটে ছবি ফুটে উঠল কালো কালো। কিন্তু একটু পরেই প্লেটের মসলা গলে গিয়ে পড়ে যেতে লাগল। ছবিগুলি না হওয়ায় রথিন বেশ হতাশ হয়ে পড়ল। কোথায় কী ভুল হচ্ছে, সে ধরতে পারল না। তাকে বেশ বিমর্ষ দেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, "মন খারাপ কোরো না, আমি ঠিক ছবি তুলব।" ঠিক এই সময় রথিনের ভাগনি এলিস যেখানে উপস্থিত ছিল। সে আমার কথা শুনে বিদ্রƒপের সুরে বললে, "অ্যা, কাসেম ফটো তুলবে? এটা সম্ভব নাকি? তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?" এলিস আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের বড়। কিন্তু সেই একটি বছর বড় হওয়ার সুযোগ নিয়ে যে সব সময়ই আমার ওপর মাতব্বরি করত। তার বিদ্রƒপে আমিও জিদ করে দৃঢ়স্বরে বললাম, "নিশ্চয়ই ছবি তুলব এবং সে ছবি তৈয়ার করে তোমাদের দেব।' এলসি ব্যঙ্গস্বরে "বেশ দেখা যাবে" বলে তাচ্ছিল্যভাবে চলে গেল। রাগের মাথায় এলসিকে তো ফটো করবার প্রতিশ্রুতি দিলাম। কিন্তু তার পরই মনে হলো, এটা কেমন হলো? আমি ফটোগ্রাফির কিছুই জানি না। আমি কেমন করে ফটো তৈয়ার করব? কিন্তু তখন আর অনুতাপ করে কোনো লাভ নেই। যেমন করেই হোক আমার কথা রাখতেই হবে।

আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ বলেন, ‘তাঁর (গোলাম কাসেম) বাসায় আমি, গোলাম মুস্তাফা, বিজন সরকার, মাহবুব হোসেন, সাজেদা বেগমসহ আরও কয়েকজন তাঁকে একটি ক্লাব গঠন করার প্রস্তাব দেই। সে অনুযায়ী ১৯৬২ সালের ১২ আগস্ট একটি সভার আয়োজন করা হয় এবং ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব গঠিত হয়।’ আলোকচিত্র: ওবায়েদুল্লাহ মামুন ১৯৮৮, ইন্দিরা রোড, ঢাকা

'তারপরের দিনই ছুটলাম ধর্মতলা ও চৌরঙ্গির ফটোর দোকানগুলিতে। তাদের আমার অসুবিধার কথা জানালাম। কিন্তু সকলেরই ঐ একই কথা, "আরে ভাই, আপনারা এ কাজ করবেন তো আমরা আছি কেন? প্লেট ফিল্মে ছবি তুলুন। তা আমাদের কাছে আনুন। আমরা তা থেকে ছবি বানিয়ে দেব। ওদের কথায় মনটা বেশ দমে গেল। এলসির বিদ্রƒপ মূর্তিটা সামনে জেগে উঠল। হতাশ হবার পরই এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ওষুধের দোকানের কথা মনে হতে, সেখানে ছুটে গেলাম। সেখানে একটা অল্প বয়েসী অ্যাংলোর সাথে আমার কিছুটা পরিচয় ছিল। তাকে আমার বিপদের কথা জানাতে সে বলল, "ভীষণ গরম পড়েছে। টেম্পারেচার ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর। প্লেট ফিকস্ করতে অ্যালার্ম ব্যবহার করতে হবে; না হলে ইমালশন গলে যাবে।" সে আমায় ফিকস্ করার জন্য একটা কেমিক্যাল দিল আমি যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলাম। অ্যাংলো ছেলেটার কথামতো কাজ করায় আমি ছয়খানি সুন্দর প্লেট নেগেটিভ পেলাম। তা থেকে প্রিন্টিং কাগজের উপদেশমতো প্রিন্ট করে কয়েকখানি চমৎকার ছবি তৈয়ার করে, এলসির হাতে দিলাম। সে ছবিগুলি দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল, "এসব তুমি করেছ? আমি তাকে সম্মতি জানাতে সে আমায় কনগ্রাচুলেশন জানাল। দেখলাম আমার প্রতি তার আর কোনো অভিযোগ নেই।

'যেদিন আমি নিজের হাতে ছবি তৈয়ার করলাম, সেদিন যে আমি কত খুশি হয়েছিলাম, তা বলতে পারব না। আমার মনে হলো, আমি একটা নতুন জীবন পেয়েছি। আর এই জীবনেই আমার আয়ু কাটবে। আমি বুঝলাম, সেই দিনই আমি ফটোগ্রাফার হয়ে গেছি, আর এই ফটোগ্রাফিই আমার জীবনের একটা অংশ হিসেবে চলতে থাকবে। এই সময়টা ছিল ইং ১৯১২ সন। ফটোগ্রাফি তো হাতে নিলাম কিন্তু সেকালে ফটোগ্রাফি শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। এ ব্যাপারে কেউ উৎসাহ দিত না। কোনো সাহায্যও পাওয়া যেত না। কলেজে যাবার ট্রামভাড়া, বাসভাড়া ও জলযোগের পয়সা বাঁচিয়ে আলোকচিত্রণের খরচ জোগাড় করতে হতো। ফটোগ্রাফিতে হাত দেওয়া সাপের ছুঁচা গেলার মতো হলো, সে না পারে তা গিলতে, না পারে তা ছাড়তে। কিন্তু ঊাবৎু পষড়ঁফ যধং রঃং ংরষাবৎ ষরহরহম, আমার ফটোগ্রাফি জীবনেও তা-ই হলো। অসুবিধার মধ্যেও মাঝে মাঝে হঠাৎ করে সুবিধা এসে পড়ত। আসল জিনিসটা হলো চেষ্টা। এটা থাকলে অনেক বাধাবিঘ্নই কাটিয়ে ওঠা যায়। ফটোগ্রাফি আরম্ভ করার পর নিজের চেষ্টায় ও অনেক ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে গিয়েছিলাম। সে এক অন্য কাহিনি। ...প্রবন্ধ শেষ করার আগে দু-একটা কথা আরও বলতে চাই। সেটা হচ্ছে রথিনের ভাগনি এলসির কথা। এই মেয়েটির দাম্ভিকতার জন্যই আমি আমার জীবন ফটোগ্রাফিতে উৎসর্গ করতে পেরেছি। এ জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। আজ সে নাই, বহুদিন পূর্বেই সে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তবে সে চলে গেলেও তার স্মৃতি আমার মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে  (স্মৃতিকথা, গোলাম কাশেম ড্যাডি, ফটোগ্রাফি, বর্ষ ৩, সংখ্যা ১, জানুয়ারি ১৯৯৪)।' আর এভাবেই গোলাম কাসেমের আরেকবার পুনর্জন্ম হলো। আর এই জীবনকেই তিনি তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন।

গোলাম কাসেমের (ড্যাডি) বাড়িটিই ছিল ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবের ঠিকানা। আলোকচিত্র: ওবায়েদুল্লাহ মামুন ১৯৮৮, ইন্দিরা রোড, ঢাকা

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রবীণ আলোকচিত্রশিল্পী গোলাম কাসেমের দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন, ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে। ১৯৯৮ সালে গোলাম কাসেমের মৃত্যুর ১৩ বছর পর ২০১১ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদসংখ্যায় নাসির আলী মামুন 'পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি' শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধটি মূলত গোলাম কাসেমকে বাংলাদেশি মানুষের সামনে নতুনভাবে উপস্থাপিত করেছে। সেখানে ঐ সাক্ষাৎকারটি ছিল না; কিন্তু সেটিকে কেন্দ্র করেই তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইতিহাসের বয়ান লিপিবদ্ধ করেন। অবিভক্ত ভারত ও পূর্ব বাংলায় আলোকচিত্রণশিল্পের বিবর্তনের দীর্ঘ আলোচনায় তিনি গোলাম কাসেমকে প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। এই নিবন্ধ গোলাম কাসেমকে নতুনভাবে জীবন দান করে। 

গোলাম কাসেমের সেই সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোর মুখ দেখে দৈনিক ইত্তেফাকের ২০১৭ সালের ঈদসংখ্যায়। 'অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার: গোলাম কাসেম ড্যাডি' শিরোনামে ২৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রচনায় নাসির আলী মামুন গোলাম কাসেমকে একটি অবয়ব দান করেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে গোলাম কাসেমের জীবনের নানান চড়াই-উতরাইকে ফুটিয়ে তোলেন বাংলাদেশের মানুষের সামনে। এখন পর্যন্ত এটিই মূলত গোলাম কাসেমকে অধ্যায়নের প্রথম এবং সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ প্রাথমিক উৎস হিসেবে স্বীকৃত। এখান থেকেই অন্যান্য সংকলকেরা তথ্য নিয়ে নিজেদের গবেষণার ফল বলার চেষ্টা করে থাকেন! কিন্তু বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো গবেষক এটি সহজেই ধরতে পারবেন। এটি প্রকাশের তিন বছর পর নাসির আলী মামুন ২০১১ ও ২০১৭ সালে প্রকাশিত দুটি রচনাকে একত্র করে আদর্শ প্রকাশনীর মাধ্যমে ২০২০ সালে 'পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি' নামে একটি বই প্রকাশ করেন। আমার অধ্যায়নে যত ধরনের লেখা আমি পড়েছি, তার প্রায়ই সব তথ্যই এখান থেকে উৎসরিত। কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে; তার মধ্যে অন্যতম হলো গোলাম কাসেম নিজেই বিভিন্ন মাধ্যমে ছোট ছোট সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন।

নিজ শয়নকক্ষে গোলাম কাসেম (ড্যাডি)। আলোকচিত্র: ওবায়েদুল্লাহ মামুন ১৯৮৮, ইন্দিরা রোড, ঢাকা

টগবগে রক্তের তরুণ গোলাম কাসেম প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়ে প্রাচীন পদ্ধতির ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু আরও বিচক্ষণ মানুষটি আরও নতুন প্রযুক্তির ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও কেন তুললেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছবি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ কলোনিগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভাঙতে শুরু করল। এই সময়ে ভারতবর্ষে ঘটেছিল দুর্ভিক্ষ। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাতি বিধ্বংসী ও ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলো রাতারাতি এই ভারতে। এই সময়ে কেন নীরব থাকল গোলাম কাসেমের ক্যামেরা? নাসির আলী মামুনের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমি তো ব্রিটিশদের সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি করতাম। খুব ব্যস্ত থাকতে হতো অফিসের কাজে। তা ছাড়া রাজনীতির গন্ডগোল থেকে দূরে থাকতাম আমি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন জায়গায় গেছি, ইমনিকের ট্রেনিং নিয়েছিÑএসব কিছু আমার ছবিতে আছে। আমার তো মনে হয় না, কোনো বাঙালি মুসলমান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষে এত ছবি তুলেছে। চাকরির সিংহভাগ টাকাই আমি ফটোগ্রাফিতে খরচ করেছি। তুমি দাঙ্গার কথা বলছ, তার সরাসরি কোনো ছবি আমি তুলতে পারিনি। কিন্তু ওই সময়টা আছে আমার ছবিতে। নাসির আলী মামুন আবার প্রশ্ন করেন, 'আপনি আসলে কিসের ফটোগ্রাফার? মানে কী নিয়ে আপনি ছবি তুলতে চেয়েছেন?' গোলাম কাসেম বলেন, 'প্রকৃতিই আমার বেশি ভালো লাগত। আবার মানুষের ছবিও তুলেছি। আমি খুব সচেতনভাবে ফটোসাংবাদিকতা করিনি। ওটা আমার সাবজেক্ট ছিল না। প্রাকৃতিক দৃশ্য গভীরভাবে আমাকে আকৃষ্ট করত। আমি যখন ছবি তোলা আরম্ভ করি, তখন মুসলমানরা ছবিই তুলত না। হিন্দুরা এতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আমার আশপাশে তখন কোনো মুসলমান ফটোগ্রাফার পাইনি। কোনো বাঙালি মুসলমানকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ক্যামেরা হাতে দেখিনি। তখন কোনো বইপত্তর নাই, দিকনির্দেশনা নাই আমার সামনে। কী ছবি তুলব, কোথায় কীভাবে তুলবÑনিজে নিজেই সব করেছি। আমার কোনো শিক্ষক ছিল না। তুমি যদি ওই সময় আর ঘটনাগুলো দেখো অবাক হয়ে যাবে। কীভাবে প্রতিকূল অবস্থায় একজন তরুণ ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আজকাল কে বুঝবে। রাজনৈতিক হানাহানি-মারামারির মধ্যে আমি ফটোগ্রাফি করিনি। ওগুলো আমাকে আকর্ষণ করেনি। প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাকে টেনেছে। আমি তাতেই মুগ্ধ হয়েছি। ঢাকায় এসেও আমি প্রকৃতিকে খুঁজেছি। ও আরেকটা কথা, আমার ফটোগ্রাফির শুরুর দিকে যন্ত্রের নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেছি। তারপরে এমন কাউকে পাইনি, যিনি ছবি বোঝেন বা সমালোচনা করতে পারেন। কাজেই আমি ছিলাম একা।' (পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি, নাসির আলী মামুন, পৃষ্ঠা: ৬১)।

বিশ্ব ফটোগ্রাফির ইতিহাসে গোলাম কাসেমের মতো এত দীর্ঘ সময় ধরে ফটোগ্রাফি করার সুযোগ কম আলোকচিত্রশিল্পীর ভাগ্যে জুটেছে। ইউরোপের যে সমস্ত মাস্টার ফটোগ্রাফারদের কাজ আমরা একাডেমিতে আলোচনা করি, তাঁদের কাজের ধারাবাহিকতা ও গভীরতা বেশ বিস্তৃত সময় জুড়ে। এবং তাঁরা ঐ সময়কালে ঐ অঞ্চলের ঘটনাবলিকে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। সেই একই সময়কালে গোলাম কাসেমের আলোকচিত্রণ চর্চা ছিল অত্যন্ত সীমিত ও সাধারণ ধরনের। গোলাম কাসেমের যে ছবিগুলো প্রকাশ্যে এসেছে, তাদের বিশ্লেষণে সহজেই অনুমেয়, আলোকচিত্রণের ক্ষেত্রে তার কোনো নির্দিষ্ট শৈলী দাঁড়ায়নি। তার ছবিসমূহকে আলোকচিত্রণের কোনো একটি জনরায় রেখে আলোচনা করা সম্ভব হয় না। 

আর গোলাম কাসেমের ফটোগ্রাফি চর্চা ও তাঁর ছবির বিশ্লেষণ নিয়ে কথাবার্তা নেই বললেই চলে। পাঠশালার একজন শিক্ষক ও আমার প্রাক্তন ছাত্র আরফান আহমেদ গোলাম কাসেমের একটি ছবির ছোট্ট একটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে বেশ কয়েক বছর আগে। গোলাম কাসেমের জন্ম ও মৃত্যুদিনে পাঠশালা থেকে তাঁকে স্মরণ করতে আরফান আহমেদের লেখাটি প্রতিবছর শেয়ার করে থাকে। তিনি লেখেন, 'গ্লাসপ্লেট নেগেটিভের ছোট্ট একটা ছবি। নরম আলোর সময়ে বেতের চেয়ারে বসা এক কিশোরী। বসবার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। চেয়ারের পেছনের দিকে হাতের ওপর হাত রেখে তার ওপরে থুতনি, তারও ওপরে কিশোরীর নিরুদ্দেশ ভাবনার চোখ। পাটের মতো চুল মাঝখানে সিঁথি তার ওপারে ফুল এবং গুল্মের বাগান, বাগানে স্বাবলম্বী ঘাস ইচ্ছে খুশি বেয়াড়া। তার ওপারে ছোট বাংলা ঘর, বাঁশের বেড়া, আর ঢেউ খেলানো ইস্পাতের ছাদ। তারও ওপারে কিছু গাছ তারপর আকাশের ছোট্ট নিশান।

'কিশোরীর স্বযতনে উদাসী মুখের ভাব। ফ্রেম ভেদ করে বেরিয়ে যায় তার চোখের দৃষ্টি। কালো মণিটা কার সাথে যেন কথা বলে, আমাদের মুখ ছাপিয়ে। বুঝতে পারি, ফটোগ্রাফার, এই সবই মিলে সাজিয়েছেন ছবি। একটা মিষ্টি ছবি। কৈশোর যেমন মিঠা হয়, যত্ন করে যেমন ঠিক আকুল হয়। কিশোরী, নজরের এমন সামনে, তাই ডিফোকাসড হয়ে আসে। এই যে কৈশোরের মায়া, তারে ঠিক ধরে ওঠা যায় না। আর আমরা যা দেখি, তা অতি সাধারণ। আর যা দেখতে গিয়েও ধরতে পারি না, তা অসাধারণ। ঠিক এই ছবিতেই জয়নুলের পেইন্টিং, লাল শাড়ি পরা নারী, যার পায়ের কাছে আয়নাটা উল্টো করে রাখা, চোখ বুঁজে, কোন গহিনে, কি যেন সে খোঁজে। গোলাম কাশেম দেখেছেন কত কিছু। বেবিব্রাউনি কামরার অন্ধকারের ভেতর কত মণিমানিক আলোক সাজিয়ে, কাগজের দ্বিতলে এমন ইশারার ভার, ফটোগ্রাফের সীমানা পেরিয়ে চোখের সামনে হুহু করে আসে অবিভক্ত বাংলার দেশ'। ১৯১৮ সালে গ্লাসপ্লেটের দুর্বল ইমালসনে এবং হয়তো লেন্সের আউট অব ফোকাসে থাকা বিপরীত আলোয় তোলা একটি 'ফাজি' ছবির ব্যাখ্যা সরাসরি করা আসলেই মুশকিল। আমি ধারণা করি, আরফান আহমেদ (২০২০) সে জন্যই শব্দের গোলকধাঁধায় আমাদের নিক্ষেপ করেছেন! তার এই ভাসা ভাসা অর্থবোধক বাক্যগুলো শেষ পর্যন্ত সম্যক যোগাযোগ না ঘটিয়ে একটি অস্পষ্ট অনুধাবনের জন্ম দেয়। এটিই হয়তো শিল্প!

বাংলাদেশে একজন আলোকচিত্রশিল্পীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার অধিকাংশ কাজই কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে তাদের জীবদ্দশাতেই তারা তাদের কাজ হারিয়ে ফেলেন! কোনোভাবেই সেই কাজগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আলোকচিত্র সাংবাদিক ও সংকলক সাহাদাত পারভেজের নেতৃত্বে জাহরা জাহান পার্লিয়া ও অন্যরা বিভিন্নভাবে খুঁজে খুঁজে গোলাম কাসেমের গল্প, প্রবন্ধ, চিঠি, আলোকচিত্র এবং অন্যান্য নানান ডকুমেন্ট একত্র করেছিলেন দীর্ঘ চেষ্টার মাধ্যমে। সেগুলো একত্র করে ২০২১ সালে চার খণ্ডে 'ড্যাডিসমগ্র' নামে প্রকাশ করে প্রকাশনী সংস্থা পাঠক সমাবেশ। গোলাম কাসেমের জীবন ও কর্মকে বাংলাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে এটি মূলত প্রাথমিক কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এখন প্রয়োজন গবেষণার। 

আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগ বয়সে গোলাম কাসেমের থেকে ৩৭ বছরের ছোট ছিলেন। বয়সের এই দীর্ঘ পার্থক্য থাকলেও তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ও ভালোবাসার। লক্ষণীয় যে, ১৯৪৯ সালে রাজশাহীতে কর্মরত থেকে যখন গোলাম কাসেম অবসরে যান, তখন এম এ বেগের বয়স ১৮ বছর। এই বয়সে গোলাম কাশেম ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন। একই সালে এম এ বেগ পাকিস্তান এয়ারফোর্সের টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে ফটোগ্রাফি বিষয়ে করাচিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কাকতালীয়ভাবে দুইজনই তাঁদের সময়কালে ১৮ বছর বয়সে ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন। আপনি কী হতে চেয়েছিলেন? নাসির আলী মামুনের প্রশ্নের উত্তরে গোলাম কাসেম বলেন, 'ফটোর দিকে একটা ঝোঁক হয়েছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে শেষ পর্যন্ত কী হতে পারব, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তবে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফির দিকে আমার কখনো ঝোঁক ছিল না। ব্যবসা করব বা টাকা করব, এটা আমার মনে হয়নি। অ্যামেচার ফটোগ্রাফার হিসেবেই জীবনটা কাটাবÑএইটা কিন্তু মনে হয়েছিল। রিটায়ার করার পরেও মনে করলাম, দোকান করব, স্টুডিও করব, আমি ওদিকে যাইনি। ওটা মনে কখনো হয়নি। আমার বরাবর মনে ছিল, আমি রিটায়ার করে এমনভাবে থাকব, পরকে শিক্ষা দেব যেন লোকে শেখে। আমি বহু কষ্ট করেছি ফটোগ্রাফি শিখতে। আমি যদি দশটা লোককেও শেখাতে পারি, মানসিক প্রশান্তি পাব, যে কটা লোককে আমি ফটোগ্রাফি শেখালাম। এইটার জন্যই ট্রপিক্যাল ফটোগ্রাফি, আমি কিছু করে খাব, এটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার ছেলেবেলায় তো ছিলই না। একটা কিছু করে যেতে হবে, দরকারও আমার। আমি সেটার ওয়ান্টটা ফিল করিনি। হয়তো ওয়ান্ট হলে আমি এদিকে যেতাম। ব্যবসার দিকে যেতাম, কিন্তু ওয়ান্টটা আমার হয়নি (পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি, নাসির আলী মামুন, আদর্শ প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০২০, ঢাকা)।' 

গোলাম কাসেম পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ফটোগ্রাফি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৫১ সালে; ভাষা আন্দোলনের এক বছর পূর্বে। প্রতিষ্ঠানটি মাত্র দুই বছর টিকে ছিল। ইনস্টিটিউটের আদল সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় গোলাম কাসেমের জবান থেকেই। তিনি উল্লেখ করেন, 'ইনস্টিটিউটটা ছিল, আবার স্টুডিও হিসেবে কাজ করতাম। কেউ যদি এসে বলত ছবি তুলে দেন, তাদের ছবিও তোলা হতো। আবার ট্রেনিং দিতাম। কেউ যদি ফটোগ্রাফি শিখতে চাইত, শেখানো হতো। তার নাম ছিল ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি।' তিনি প্রতিষ্ঠানের আয় বিষয়ে বলেন, 'এটা কোনো দিন হয়নি। অনেকে ছবি তুলতে আসত। কেউ প্রিন্টের পয়সা দিত, কেউ ছবি পেয়ে খুশি মনে চলে যেত, পয়সা দিত না। ওরা খুশি হলে আমিও খুশি হতাম। আর ট্রেনিং দিতাম অত্যন্ত নগণ্য টাকায়। ছাত্রদের নিয়ে চা-নাশতা খাওয়ার পয়সাই হতো না। আমার উদ্দেশ্য ছিল আয় করা নয়, তোমাদের মতো তরুণদের ফটোগ্রাফির ট্রেনিং দেয়া, যাতে শিল্প হিসেবে বা পেশা হিসেবে এটাকে তারা গ্রহণ করে। কেউ ছবি তোলা শিখতে পারলেই আমার আনন্দ। এর চাইতে বড় শিল্প আর কী হতে পারে? (পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফি: রাজসাক্ষী গোলাম কাসেম ড্যাডি, নাসির আলী মামুন, আদর্শ প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০২০, ঢাকা)।'

ঢাকায় যে সময়ে ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি বন্ধ হয়ে যায়, তখন এম এ বেগ পশ্চিম পাকিস্তানে বিমানবাহিনীতে কর্মরত। পরে এম এ বেগ কর্মস্থল পরিবর্তন করে প্যান্সডকে যোগ দেন এবং ফটোগ্রাফির আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে থাকেন দেশে-বিদেশে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। ১৯৫৭-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন করাচিতে সিএসআইআরের অধীনে প্যান্সডকে। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় যখন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে প্যান্সডকের শাখা অফিস খোলা হয়, তখন সিনিয়র রিপ্রোগ্রাফিক অফিসার পদে যোগ দেন। এই সময়কালের মধ্যে নানা সময়ে ঢাকায় অবস্থানকালে এম এ বেগ গোলাম কাসেমের খোঁজ পান। এই অঞ্চলের ফটোগ্রাফির ইতিহাস লিখতে গিয়ে প্রথম পর্বে তিনি উল্লেখ করেন, '১৯৬১ সালে আমরা একটি ফটো-ক্লাব করার কথা ভাবতে থাকি। এ সময় একজন প্রবীণ সৌখিন আলোকচিত্রশিল্পী তার বাসায় মাঝে মাঝে ফটোগ্রাফি বিষয়ে আলোচনা সভা করেন জেনে একদিন দলবলসহ সেখানে আমরা উপস্থিত হই। এ প্রবীণ আলোকচিত্রশিল্পীর নাম গোলাম কাসেম, যিনি পরবর্তীকালে আলোকচিত্র মহলে গোলাম কাসেম ড্যাডি নামে পরিচিত হয়েছেন। গোলাম কাসেম ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। ফটোগ্রাফিতে তার হাতেখড়ি কলকাতায়। ১৯৪৯ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করে ঢাকায় ৭৩ নং ইন্দিরা রোডে নিজ বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তাঁর বাসায় আমি, গোলাম মুস্তাফা, বিজন সরকার, মাহবুব হোসেন, সাজেদা বেগমসহ আরও কয়েকজন তাকে একটি ক্লাব গঠন করার প্রস্তাব দিই। সে অনুযায়ী ১৯৬২ সালের ১২ আগস্ট একটি সভার আয়োজন করা হয় এবং ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব গঠিত হয়। সে সভায় আমাদের পরিচয় হয় বার্মা শেলে চাকরিরত ই এম প্যাটেলের সাথে। তিনি বয়সে আমার চেয়েও বড় ছিলেন। ৩৫ মিমি ফিল্ম ব্যবহারকারীদের প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ...প্যাটেল সাহেব ব্যবহার করতেন রেঞ্জ ফাইভার লাইকা ক্যামেরা এবং তাঁর ফিল্ম প্রসেসিং সম্বন্ধে ধারণাও ভালো ছিল। তাঁকেই ক্লাবের প্রথম সভাপতি করা হলো। ধীরে ধীরে এ ক্লাবের সদস্য সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। ৪০-৫০ জনের সভা হতো ড্যাডির শয়নকক্ষে। আর বিশেষ সভা করার সময় তাঁর বাড়ির লনে।

গোলাম কাসেম ড্যাডি হলেন অঘোষিত আজীবন সাধারণ সম্পাদক। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন বিধায় আমি তাকে 'ড্যাডি' বলে সম্বোধন করি। পরবর্তী সময়ে তিনি আলোকচিত্রশিল্পীদের 'ড্যাডি' হয়ে গেলেন। দুই বছর পর ইউসুফ প্যাটেল মারা যান। তারপর আমাকে সভাপতি করা হয়। এ সময় ১৯৬৪ সালে 'ক্যামেরা' নামে ড্যাডির সম্পাদিত বইটি ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ বইটি সম্ভবত বাংলাদেশে প্রকাশিত আলোকচিত্রবিষয়ক প্রথম বই (বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির ইতিহাস - গোড়ার কথাঃ আমার স্মৃতি থেকে, মনজুর আলম বেগ, ফটোগ্রাফি, বর্ষ ০১, সংখ্যা ০২, ডিসেম্বর ১৯৯২, ঢাকা)।' 

১৯৬৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছরের সম্পর্ক ছিল এই দুজন গুণী মানুষের মধ্যে। ১৯৯৮ সালে দুজনই ইহলোক ত্যাগ করেন; কিন্তু বাংলাদেশের আলোকচিত্রণের বিকাশ ও উন্নয়নে তাঁরা যে অবদান রেখে গেছেন, তার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এবং তাঁদের নাম বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে। গোলাম কাসেম ও আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগের মধ্যে বিদ্যমান শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসে উল্লেখ থাকবে 'ওল্ড ইজ গোল্ড' যৌথ আলোকচিত্র প্রদর্শনীটির কথা। গোলাম কাসেমের ১০০তম জন্মদিন উপলক্ষে ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে ১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রদর্শনীটি।

বাংলাদেশের আরেকজন গুণী আলোকচিত্রশিল্পী বিজন সরকার। তিনি ছিলেন আলোকচিত্রণ আন্দোলন ও শিক্ষা প্রসারে আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগের অন্যতম সহচর। তিনিও এ দেশের আলোকচিত্রণের বিবর্তনকে খুব কাছ থেকে চাক্ষুষ করেছেন। তিনি মূলত এই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তিনি 'ফটোগ্রাফি' পত্রিকায় প্রকাশিত এক আত্মজীবনীমূলক রচনায় লেখেন:

 '১৯৬৩ সাল। আমি তখন বেগ সাহেবের সঙ্গে কাজ করি। দোকানের নামটা তখনো রক্সি সায়েন্টিফিক ষ্টোর্স; রক্সি ফটোগ্রাফার্স তখনো হয়নি। কাফেলা ফটোগ্রাফার্সের মালিক কফিল ভাই তখনো জার্মানি যাননি। এরই মধ্যে একদিন ইন্দিরা রোডে গোলাম কাসেম সাহেবের ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফির রুমেই ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব প্রতিষ্ঠা লাভ করল। ...বেগ সাহেব, মুস্তাফা সাহেব, প্যাটেল সাহেব এবং আরও সবাই আমরা ক্লাবের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকলাম। কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল মাসিক প্রতিযোগিতা, বাৎসরিক প্রতিযোগিতা, আউটিং ইত্যাদি। বাৎসরিক অনুষ্ঠানে নাচ-গান আবশ্যিক ছিল। ড্যাডি এ অনুষ্ঠান প্রাণভরে উপভোগ করতেন। ড্যাডি নামটা তখনো বেশ প্রসার লাভ করেনি। এ নামের উদ্যোক্তা বেগ সাহেব। বেগ সাহেব ড্যাডিকে বললেন, কাসেম সাহেব, আপনার তো ছেলেমেয়ে নেই। আজ আমরাই আপনার ছেলে, আপনাকে ড্যাডি বলে ডাকব। বোঝা গেল, কাসেম সাহেব প্রীতই হয়েছেন। এরপর শুরু হলো ড্যাডির পথ পরিক্রমা। আজ অনেকেই ড্যাডির আসল নাম জানেন না।

'অনুষ্ঠানে ছোট বড় ছেলে-মেয়েরা এলে ড্যাডি তাদের আদর করতেন। কাছে টেনে নিতেন। বুকে জড়িয়ে ধরতেন। আমরা তাঁর ব্যথাটা বুঝতাম। ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ড্যাডির গান গাওয়া অবধারিত। এ থেকে আমরা বুঝতে পারতাম, ড্যাডি কতখানি সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৭০-এর বেশি। নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা ছেড়ে কি আনন্দে গাইতেন। সময় জ্ঞান তাঁর অত্যধিক। সভা চলাকালীন হঠাৎ করে ড্যাডি বলে উঠতেন, এক্সকিউজ মি বলেই ভেতরে চলে যেতেন। ৬-৭ মিনিট পর ফিরে আসতেন মুখ মুছতে মুছতে। আমরা বুঝতে পারতাম, উনি দই চিড়া খেয়ে এলেন। অর্থাৎ নাশতা করে এলেন। ওনার সারা দিনের প্রোগ্রাম ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়। উনি নিজেই বাজারে যেতেন, নিজেই রান্না করতেন। ...আউটিংয়ে গিয়ে ড্যাডি আমাদের সঙ্গেই হাঁটতেন। কখনো ক্লান্ত হয়েছেন বলে মনে পড়ে না। অনেক দিন পর জেনেছিলাম ড্যাডির একটা পা ভাঙা এবং স্টেইনলেস স্টিলের পাত দিয়ে জোড়া লাগানো। এ জন্য কোনো অসুবিধার কথা ড্যাডির মুখে শুনিনি। প্রাণোচ্ছ্বল ড্যাডির কাছে একদিন প্রস্তাব রাখলাম, কিছুটা জায়গা যদি আপনি ফটোগ্রাফির জন্য দান করে যান, তাহলে গোলাম কাসেম ক্যামেরা ক্লাব নামে আপনাকে চিরঞ্জীব করে রাখব। মনে হলো ড্যাডি একটু আলোকিত হলেন। তারপর চুপ করেই রইলেন। কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম, উনার স্বাধীনতা নেই। অতঃপর আস্তে আস্তে আমি ড্যাডি থেকে দূরে চলে এলাম। আমি আর কোনো দিনই এ ব্যাপারে ড্যাডিকে কোনো প্রশ্ন করিনি। কিছুদিন আগে বিপিএসের মাসিক সভায় জানতে পারলাম, ড্যাডি একট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেছেন। ফটোগ্রাফির জন্য কিছু একটা তিনি করতে চান। ট্রাস্টি বোর্ডের সভা কত দিন চলবে, এ সম্পর্কে আমি আর কিছু জানি না (ড্যাডি, বিজন সরকার, ফটোগ্রাফি, বর্ষ ৭, সংখ্যা ১-৪, জানুয়ারি-এপ্রিল ১৯৯৮)।' এভাবেই অগ্রজ আলোকচিত্রশিল্পীদের স্মৃতি থেকে লেখা খণ্ড খণ্ড ইতিহাসকে জোড়া দিতে শুরু করলে শুধু গোলাম কাসেমই নন, বাংলাদেশের সব আলোকচিত্রশিল্পীর পুনর্জন্ম ঘটানো সম্ভব। শুধু একটু নির্মোহ হতে হবে তথ্য বিশ্লেষণে এবং পাশাপাশি ইতিহাসকে পড়তে হবে শিক্ষকের উদারতায়, শিক্ষার্থীর মতো তৃষ্ণাতে।


 

  • লেখক:আলোকচিত্রী, প্রিন্সিপাল, ছায়া ইনস্টিটিউট অব কমিউনিকেশন আ্যান্ড ফটোগ্রাফি, সম্পাদক, আলো (আলোকচিত্রবিষয়ক পত্রিকা)

Related Topics

টপ নিউজ

গোলাম কাসেম ড্যাডি / আলোকচিত্রী / শিল্প

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • ছবি: এএফপি
    ৭,৮০০ কোটি গাছ লাগিয়েছে চীন; তাতেই নষ্ট করেছে নিজেদের পানিচক্রের ভারসাম্য
  • ছবি: সংগৃহীত
    বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর ৫৭,৫৭৬ কোটি টাকা লোকসান দেখাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
  • ছবি: সংগৃহীত
    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাম আযম-নিজামীদের প্রতিকৃতি মুছে দিল প্রশাসন, 'জানেন না' প্রক্টর
  • ছবি: সংগৃহীত
    হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক
  • ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট
    ‘মামলা’ এড়াতে ট্রাফিক কর্মীকে কয়েকশো মিটার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে পালালেন সিএনজি চালক
  • পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ছবি: বাসস
    ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

Related News

  • ইভি, সৌরবিদ্যুতের পর ভবিষ্যতে যেসব ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করবে চীন
  • আলোকচিত্রী শহিদুলের মামলা বাতিল হাইকোর্টের; আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বহু মামলা বাতিলের সুযোগ
  • মিডিয়া ফ্লোটিলায় গাজায় যাচ্ছেন শহিদুল আলম
  • বেক্সিমকোর পর নাসা গ্রুপকেও সহায়তার সিদ্ধান্ত সরকারের, কারখানা সচল রাখতে উদ্যোগ
  • ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র’: প্রজন্ম পেরোনো শিল্পযাত্রায় অনন্য যারা

Most Read

1
ছবি: এএফপি
আন্তর্জাতিক

৭,৮০০ কোটি গাছ লাগিয়েছে চীন; তাতেই নষ্ট করেছে নিজেদের পানিচক্রের ভারসাম্য

2
ছবি: সংগৃহীত
অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর ৫৭,৫৭৬ কোটি টাকা লোকসান দেখাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

3
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাম আযম-নিজামীদের প্রতিকৃতি মুছে দিল প্রশাসন, 'জানেন না' প্রক্টর

4
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ

হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

5
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট
বাংলাদেশ

‘মামলা’ এড়াতে ট্রাফিক কর্মীকে কয়েকশো মিটার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে পালালেন সিএনজি চালক

6
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ছবি: বাসস
বাংলাদেশ

ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

EMAIL US
contact@tbsnews.net
FOLLOW US
WHATSAPP
+880 1847416158
The Business Standard
  • About Us
  • Contact us
  • Sitemap
  • Privacy Policy
  • Comment Policy
Copyright © 2025
The Business Standard All rights reserved
Technical Partner: RSI Lab

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net