শিখতে গিয়েছিলেন দিল্লি, পুরান ঢাকায় নেহারির আরেক নাম ‘মা শাহী নেহারি’
হালিম বিক্রি করে তখন বেশ নাম করেছেন সিদ্দিক মিয়া। চৌধুরী বাজারের ছোট্ট দোকানটি তখন জমজমাট—মহল্লার লোকজন বলাবলি করে, 'এই এলাকার সেরা হালিম সিদ্দিক মিয়ার!' তবু তার মনে অন্য চিন্তা দানা বাঁধছে।
"একসময় দেখি চারপাশে শুধু হালিমের দোকান। মনে হইল, এই ব্যবসা বেশি দিন টিকবো না। ভাবলাম, বাঙালিরা আর কী খায়? নেহারি তো সবার পছন্দ। তখন মনস্থির করলাম, এবার নেহারি বানামু। কিন্তু আগে তো জানতে হবে—নেহারি আইছে কোন জায়গা থেইকা!" বলছিলেন সিদ্দিক মিয়া।
২০১৪ সাল। তখন ব্যবসার বয়স ১৬ বছর। সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন সিদ্দিক—ভারতে যাবেন, নেহারির আসল কৌশল শিখতে। "আমরা ঢাকাইয়ারা ডরে গ্রামে যাই না, আর আমি একা একা ভারত গেছি গা!," হাসতে হাসতে বলেন তিনি।
ঈদের পরদিনই পাড়ি দিলেন কলকাতা হয়ে দিল্লিতে। "খানদানি খাওন সবই দিল্লির। মোগল রাজা-বাদশাদের খাবার। মানুষরে জিগাইয়া ঠিকানা লইয়া গেছি দিল্লি জামে মসজিদের পাশের গলির কারিম হোটেলে। সালাম দিয়া কইলাম—বাংলাদেশ থেইকা আইছি, নেহারি রান্না শিখতে চাই!"
সব শুনে কারিম হোটেলের বাবুর্চি তাকে এক ওস্তাদের নাম জানালেন। সিদ্দিক ছুটে গেলেন তার কাছে। প্রথমে রাজি হলেন না ওস্তাদ। কিন্তু সিদ্দিক ছিলেন নাছোড়বান্দা। সারাদিন দাঁড়িয়ে রইলেন ওস্তাদের বাড়ির সামনে। শেষে হার মানলেন ওস্তাদ—রাজি হলেন শেখাতে।
"ওনারে দেখলে বোঝা যায় উনি আসল ওস্তাদ! যা জানেন, সব খুইলা বললেন। রাতে ডাক দিয়া রান্নার পদ্ধতি দেখাইলেন। সকালে আবার গেছি, মশলার তালিকা লেইখা দিলেন। আমার মনডা খুশিতে ভইরা গেলো। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ২০ হাজার টাকা তার হাতে তুইলা দিলাম," বললেন সিদ্দিক।
"নেহারির মশলা মা-খালারা জানেন বটে, কিন্তু দিল্লির রাজা-বাদশারা যে নেহারি খাইছিল, সেইটা আমরা জানতাম না। দিল্লিতে আরও পাঁচ-ছয় দিন ছিলাম, প্রতিদিন যাইয়া শিখতাম।"
এভাবেই শেষ হয় তার দিল্লি সফরের গল্প, কিন্তু এখানেই শেষ নয় সিদ্দিক মিয়ার মূল কাহিনি।
পরের তিন বছর নিয়ম করে একবার হলেও দিল্লি গেছেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই, নেহারিকে হাতের আয়ত্ত্বে আনতে হবে। ঢাকা শহরে নেহারির কথা উঠলে যে নামটি প্রথম দিকেই আসে, সেটি সিদ্দিকের 'মা শাহী নেহারি'। এই খাবারটির পেছনে আছে তার কঠোর সাধনা।
তবুও তিনি আক্ষেপ করে বলেন, "ওস্তাদের হাতে যে নেহারি খাইছিলাম, ওই স্বাদ এখনও আমার হাতে আসে নাই। কবে আসবে তাও জানি না।"
শর্ত একটাই, যেতে হবে ভোরে
ইউরোপ–আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলেই নাকি অনেকে এখানে ছুটে আসেন। ভোর ছয়টা থেকে লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়। ভাগ্য ভালো হলে পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত খাবার—না হলে ফিরতে হয় খালি হাতে।
তবু দেশের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে এই নেহারির নাম পৌঁছায়নি। সবই হালের ফুড ভ্লগে ছড়িয়ে পড়া গল্প! ইউটিউবে সার্চ দিলেই দেখা যাবে অসংখ্য ভিডিও—যেগুলো দেখে মনে হয়, 'মা শাহী নেহারি' যেন নেহারির আরেক নামই বটে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তা জানতে হলে তো নিজে না খেয়ে উপায় নেই। শুক্রবার সকালের আলস্য ঠেলে তাই পাড়ি দিলাম সোজা বুড়িগঙ্গার তীরে।
লালবাগের চৌধুরী বাজার। সরু গলি, সড়কের নাম সুবল দাস লেন। সবার মুখে মুখে 'সিদ্দিক ভাইয়ের নেহারি'। রিকশা থেকে নামতেই বোঝা গেল, খাবার পাওয়া সহজ হবে না!
দোকান ছোট, চারটি টেবিলে মোটে বিশজনের বসার জায়গা। কিন্তু ভোর সাতটায় দোকানের সামনে গুলিস্তানের মতো ভিড়!
ওখানেই কথা হলো কয়েকজনের সঙ্গে। ইকবাল মাহমুদ এসেছেন মিরপুর থেকে। একসময় পুরান ঢাকায় থাকতেন, তখন নিয়মিত খেতেন এখানে। আজ ভোর ছয়টায় উঠে এসেছেন নেহারির টানে—নিজে খাবেন, আবার কিছু নিয়ে যাবেন বাসায়।
প্রায় একই গল্প মোহাম্মদ সাকিবের। তিনি এসেছেন স্ত্রী ও দুই ছোট মেয়েকে নিয়ে। বললেন, "ফেসবুকে অনেক শুনছি এই নেহারির কথা, এবার নিজেরাই চেখে দেখতে আসছি।"
আধঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে সুযোগ পেলাম। দোকানে ঢুকতেই এক অদ্ভুত নেশা জাগানো ঘ্রাণে ক্ষুধা যেন আরও বেড়ে গেল। দেওয়ালে ঝোলানো মেনু দেখে অর্ডার দিলাম—তন্দুর রুটি আর গরম গরম নেহারি।
কিছুক্ষণ পর গোলাকার দুটি প্লেটে হাজির হলো খাবার। একটিতে রুটি, অন্যটিতে ধোঁয়া ওঠা নেহারি। কথায় আছে—'ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজং!' আমার অর্ধেক ভোজন হয়ে গেল ঘ্রাণেই। ঘি আর মশলার গন্ধে চারপাশ ভরে গেছে। আর অপেক্ষা করা গেল না। নেহারির প্লেটে এক টুকরো রুটি ডুবিয়ে সোজা মুখে!
দেশি গরুর পায়া, নিজস্ব মশলা
ঢাকার নেহারির দুনিয়ায় সিদ্দিক মিয়ার রান্নায় যেন এক আলাদা স্বাদ। তার নেহারির ঝোল ঘন নয়, আটা বা ময়দা মেশান না তিনি। ঘ্রাণটা হালকা, কিন্তু প্রতিবারই নাকে এসে লাগে। খেতে বসলে একে একে মশলার আসল গন্ধ আলাদা করে চেনা যায়। সঙ্গে তন্দুর রুটি—যেন স্বাদের অনবদ্য সঙ্গী।
সিদ্দিক মিয়া জানালেন, দেশি গরুর পায়া দিয়েই তিনি রান্না করেন নেহারি। দিল্লিতে ওস্তাদের কাছ থেকে জানা মশলাগুলো তৈরি করেন নিজ হাতে। পায়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে ধোয়া, মশলা মাপা, রান্না—সবই নিজেই করেন।
প্রতিদিনের কাজ শুরু হয় পায়া সংগ্রহ দিয়ে। দৈনিক ৬–৭ হালি পায়ের দরকার হয়, শুক্রবারে আরও বেশি। বিকেল ৩টার দিকে শুরু হয় রান্না, তাতে যোগ হয় বিশেষ মশলা। টগবগ করে সেদ্ধ হতে থাকে হাড়িতে থাকা নেহারি টুকরো। রান্না চলে ১২–১৩ ঘণ্টা। ভোর চারটার দিকে আবার দেন ফোড়ন, আরও একটু মশলা মেশান। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই নামানো হয় হাড়ি। সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চলে বিক্রি। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন; পার্সেল হিসেবেও পাঠানো হয় খাবার।
সকালের ব্যস্ততা কাটলে খানিকটা সময় মেলে গল্পের। তখনই বলেন সিদ্দিক মিয়া—রান্না তার কাছে ব্যবসা নয়, সাধনা। "আমার নীতি একটাই," তিনি হাসেন, "আপনে খায়া গেলেন, আবার যেন আরেকজনরে কন। এইডাই ব্যবসা। আপনে খায়া আর আইলেন না, হেইডা ব্যবসা না।"
চোখে মুখে তার তৃপ্তির ছাপ। বড় বড় রেস্তোরাঁ থেকে শেফ হিসেবে কাজের প্রস্তাব পেয়েছেন বহুবার। কিন্তু পুরান ঢাকার এই মহল্লা, নিজের দোকান আর সেই ধোঁয়া ওঠা নেহারির হাঁড়ি—এগুলোর টান ছাড়তে পারেননি কোনোদিন।
তার কাছে মানুষের প্রশংসাই আসল পারিশ্রমিক।
কেমন দাম খাবারের
খাবারের দাম যেমন, স্বাদও তেমন—অনেকেই বলেন, ঢাকায় এমন ভারসাম্য আর কোথাও পাওয়া যায় না। সিদ্দিক মিয়ার দোকানে গরুর সামনের পায়ের হাঁটুর ঠিক উপরের অংশ—যাকে বলা হয় করোলি—এই বিশেষ মাংসের জন্যই নেহারির স্বাদ অনন্য। করোলির সঙ্গে ঝুরা মাংস, গরুর মগজ, রগ আর পায়া মিলিয়ে তৈরি হয় তার স্পেশাল নেহারি। এই প্লেটের দাম ৫০০ টাকা। একটু বড় আকারের পায়া চাইলে ৬০০ টাকার প্যাকেজ, যা অনায়াসে দু'–তিনজন মিলে খাওয়া যায়। এর অর্ধেক পরিমাণের 'স্পেশাল হাফ' ২৫০ টাকা। আর একটি পায়ার সঙ্গে রগের মাংস পাওয়া যায় ৩০০ টাকায়—সবই স্পেশাল কেটাগরির।
'ফুল নরমাল' নামের প্যাকেজটির দাম ৩৫০ টাকা, অর্ধেক নিলে ১৭০ টাকায় মিলবে। সঙ্গে তন্দুর রুটি, প্রতিটি ১০ টাকা।
ভোর সাতটার আগে এলে পাওয়া যায় একটি বিশেষ প্যাকেজ—দাম ১,২০০ টাকা। কেবল একটাই থাকে এই প্যাকেজ, পুরো পরিবার মিলে খাওয়ার মতো।
সিদ্দিক মিয়া বললেন, "গুলশান বা বনানীর মতো জায়গায় এই খাবার বিক্রি করলে দাম অনেক বেশি হইতো। পুরান ঢাকা বলেই মানুষ অল্প টাকায় ভালো খাবার পাইতেছে। আমরা নিত্য কামাই, নিত্য খাই। দোকান ভাঙ্গাচোরা হইবার পারে, কিন্তু মানুষরে হালাল খাওন দেই। স্বাদ কেমন লাগবে, সেইটা আল্লাহর হাতে, কিন্তু মশলা দেই একদম মনের মতো। শীতের মধ্যে একবার খাইয়া দেখুক না কেউ!"
সন্ধ্যার পর অন্য খাবার
অনেকে বিভ্রান্ত হন—'মা শাহী হালিম' না 'মা শাহী নেহারি'? সিদ্দিক মিয়া নিজেই হাসতে হাসতে বলেন, "দুইডা নামই আমার দোকানের! নিজের মেয়েদের কথা ভেবেই রাখছি।" প্রায় ২৭ বছর ধরে হালিম বিক্রি করছেন তিনি। সন্ধ্যার পর দোকানে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত 'স্পেশাল শাহী হালিম'।
"এককালে ফার্মের মুরগি কেউ খাইতো না—৪০-৫০ টাকা কেজি আছিলো। হেই মুরগি দিয়া ৫-১০ টাকায় হালিম বেচছি," হাসতে হাসতে বলেন সিদ্দিক। এখনো তার হালিমের জনপ্রিয়তা কমেনি। তিন রকম মাংস—গরু, খাসি ও মুরগি—দিয়ে হালিম তৈরি করেন তিনি। গরুর হালিম ১৪০ টাকা, খাসির ১৬০, মুরগির ১২০ টাকা। অর্ধেক দামে পাওয়া যায় 'হাফ'।
"পুরান ঢাকার মানুষগুলা সাদাসিধা, দিলডা বড়," বললেন তিনি। "আপনারে কলিজাটা কাইটা দিয়া দিবো! ঢাকার মানুষ খাইবার জানে, খিলাইবারও জানে।" নিজের জন্মস্থানে ব্যবসা করতে পারছেন—এই তৃপ্তিই তার কাছে বড় প্রাপ্তি।
মানুষের ভালোবাসাই আসল পুরস্কার
সকাল–সন্ধ্যা দুই বেলাতে দোকানে বিক্রি হয় মাত্র দুটি খাবার—নেহারি আর হালিম। তবু এই দুই আইটেম দিয়েই ঢাকার নামকরা রেস্তোরাঁগুলোকে টেক্কা দিচ্ছেন সিদ্দিক মিয়া, বলছেন স্থানীয়রা। প্রতিদিনই দোকানের সামনে থাকে লম্বা লাইন, একই দৃশ্য বছরের পর বছর।
আবুল হোসেন নামের এক নিয়মিত ক্রেতা জানালেন, "সকালের নাস্তায় এই নেহারির জুড়ি নেই। পায়া এত নরম হয় যে মুখেই গলে যায়। একবার খেলে বারবার আসতে হয়। আর সিদ্দিক ভাইয়ের ব্যবহার—একদম আপনজনের মতো।"
এই ভালোবাসাই সিদ্দিক মিয়ার আসল প্রেরণা। যারা দূর থেকে আসেন, তাদের জন্য রাখেন বিশেষ ব্যবস্থা—আগে ফোনে জানালে যত রাতই হোক, খাবার রেখে দেন। বলেন, "দোকানে কেউ আমার মুখ দেইখা আসে না, আসে খাবারের টানে। আমি চেষ্টা করি, সবাই যেন ভালো খাইতে পারে।"
অর্থাভাবে কেউ খেতে না পারুক, এটা তার পছন্দ নয়। তাই অনেকে সামান্য টাকা দিয়েই খেয়ে যান তার দোকানে। মানুষকে ভালো খাবার খাওয়ানোই তার সবচেয়ে বড় সুখ।
স্বপ্ন দেখেন সিদ্দিক মিয়া
বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বেশি—তাই চাইলেও অনেক সময় সর্বোচ্চটা দেওয়া যায় না, স্বীকার করলেন এই রন্ধনশিল্পী। তবু তার চোখে একটিই স্বপ্ন—দিল্লিতে ওস্তাদের হাতে খাওয়া সেই নেহারির স্বাদ একদিন যেন নিজের হাতের রান্নায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
"ভারতে গরুর মাংস সস্তা। এক ডেগে তিন কেজি করে ঘি দেয়, আমি তো বেশি হইলে আধা কেজি দিতে পারি," বললেন সিদ্দিক মিয়া। "আমার যতটুকু আওকাত (সাধ্য), তার মধ্যেই করছি। মানুষ যখন আমার প্রশংসা করে, মনে মনে হাসি। এখনো আমার হাতে সেই স্বাদ আসে নাই। যেদিন আইবো, হয়তো তার আগেই মইরা যামু গা। তয় মনে হয়, হাতে আইতাছে।"
শুক্রবারের ভিড় দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। একদিন ওস্তাদের মতোই রান্না করতে পারবেন—এই বিশ্বাসই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। "এখান থেইকা শেখ শাহ বাজার পর্যন্ত যদি লাইন ধরাইবার পারতাম—কমপক্ষে তিনশ মানুষ—তাহলেই আমার স্বপ্ন পূরণ হইতো। তয় ওইডা হইবো না, প্রতিদিন নতুন নতুন খাবার বাইর হইতাছে। তয় আমার হাতে আইয়া পড়লে মানুষ বুঝবো নেহারি কী জিনিস!"
তার কথায় একদিকে ক্লান্তি, অন্যদিকে গর্ব। "আমার আটজন কর্মচারি। এগোরে বেতন দিয়া, খিলাইয়া, বাসা ভাড়া দিয়া তারপর যা থাকে, তাই দিয়া ব্যবসা চালাই। সহজ না।" একটু থেমে আবার বলেন, "তবু একদিন এমন একটা দোকান করমু—একদম পরিপাটি, এসি লাগানো, মানুষ আরামে বইয়া তৃপ্তি নিয়া খাইবো।"
সেই দিনের অপেক্ষায় আছেন সিদ্দিক মিয়া।
ছবি: জুনায়েত রাসেল