রাশিয়ায় নেপোলিয়নের সেনাদের মৃত্যুর কারণ কী ছিল? মৃত সৈন্যদের দাঁত থেকে জানা গেল কারণ
১৮১২ সালের ঘটনা। ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রায় পাঁচ লক্ষ সেনা নিয়ে রাশিয়া আক্রমণে নেমেছিলেন। রুশ বাহিনী সরাসরি যুদ্ধ না করে পিছু হটতে শুরু করে, কিন্তু যাওয়ার সময় তারা তাদের গ্রাম ও ফসলের খেত পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
এই 'পোড়ামাটি নীতি'র ফলে নেপোলিয়নের সৈন্যরা যখন মস্কোয় পৌঁছায়, তখন তা ছিল এক ধ্বংসস্তূপ। শরতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নেপোলিয়নের ভাগ্য বিপর্যয়। তীব্র শীত, খাদ্যের অভাব, ক্লান্তি আর মরণব্যাধিতে বিপর্যস্ত হয়ে তার প্রায় তিন লাখ সৈন্য রুশ সীমান্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সামরিক শক্তি নয়, বরং প্রকৃতি ও রোগের কাছেই হার মানতে হয়েছিল দুর্ধর্ষ নেপোলিয়নকে।
ঐতিহাসিক বিবরণগুলিতে এতদিন এই ব্যাপক প্রাণহানির প্রধান কারণ হিসেবে 'লাইস-বাহিত' টাইফাস জ্বরকেই দায়ী করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি ১৩ জন সৈন্যের দাঁত থেকে প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে নতুন এক গবেষণায় আরও দুটি ভয়ংকর রোগের সন্ধান মিলেছে—প্যারাটাইফয়েড জ্বর এবং রিল্যাপ্সিং ফিভার।
শুক্রবার 'কারেন্ট বায়োলজি' জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, মৃত সৈন্যদের দাঁতের মধ্যে বিজ্ঞানীরা সালমোনেলা এন্টারিকা (যা দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়) এবং বোরেলিয়া রিকারেন্টিস (যা উকুন দ্বারা বাহিত হয়) নামক অণুজীবের ডিএনএ খুঁজে পেয়েছেন।
এই নতুন গবেষণাটিতে দেখানো হয় যে, আধুনিক জিন-সিকোয়েন্সিং পদ্ধতি কীভাবে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক অভিবাসন, পূর্বপুরুষ এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসের বড় ঘটনাগুলির বোঝাপড়া নতুন করে লিখছে।
'দ্য ইলাস্ট্রিয়াস ডেড: দ্য টেরিফাইং স্টোরি অফ হাউ টাইফাস কিলড নেপোলিয়নস গ্রেটেস্ট আর্মি' বইয়ের লেখক স্টিফেন টালটি এক ইমেইলে লিখেছেন, 'বিষয়টি দারুণ রোমান্টিকও। টাইফাস যেন এককভাবে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছে, সেটি যেন তার অহংকারের প্রতি এক প্রাকৃতিক বিচার ছিল, এমন এক প্রাকৃতিক শত্রু যাকে তাঁর মেধা দিয়েও পরাজিত করা যায়নি।'
টালটি আরও বলেন, 'যদিও নমুনার সংখ্যা সীমিত, নতুন প্রমাণ দেখাচ্ছে যে আরও অন্যান্য সংক্রমণও কাজ করেছিল। এত বড় সেনাবাহিনী, এত বিস্তৃত এলাকা অতিক্রম করে, এমন কঠিন পরিস্থিতিতে অন্যান্য রোগের সংক্রমণ হওয়াই স্বাভাবিক।'
২০০১ সাল। লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একটি প্রাক্তন সেনাছাউনির নির্মাণকাজ চলছিল। কাজ চলাকালীন সময়েই নির্মাণকর্মীরা হঠাৎ নেপোলিয়নের ৩ হাজারেরও বেশি সৈন্যের দেহাবশেষ সহ একটি গণকবর খুঁজে পান।
খননকার্য থেকে তাদের তড়িঘড়ি দাফনের ভয়াবহ চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষের দেহের সঙ্গেই পাওয়া গিয়েছিল ঘোড়ার কঙ্কাল। মনে হচ্ছিল যেন দেহগুলো পাশ থেকে গর্তে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল, আর মাঝের দেহগুলো একে অপরের ওপর গড়িয়ে পড়েছিল।
২০০৪ সালে একটি গবেষক দল জানিয়েছিল, কঙ্কালগুলোর অবস্থান দেখে মনে হয়েছিল 'তীব্র ঠান্ডায় নিহতরা মৃত্যুর যে অবস্থানে ছিল, সেভাবেই জমে গিয়েছিল।' তাদের বুট পরা অবস্থাতেই কবর দেওয়া হয়েছিল।
ঐতিহাসিকরা দীর্ঘদিন ধরেই নেপোলিয়নের সৈন্যদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে টাইফাস মহামারীর কথা বলে আসছেন। দুই দশক আগে, একদল বিজ্ঞানী অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাইফাস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া Rickettsia prowazekii-এর প্রমাণ খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন।
যখন কোনো ব্যক্তি সিস্টেমিক সংক্রমণে আক্রান্ত হয় এবং তা রক্তে প্রবেশ করে, তখন তাদের দাঁতের ভেতরের ডেন্টাল পাল্পে অণুজীবের ডিএনএ অবশেষ শনাক্ত করা যায়। সেই দলটি টাইফাস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ খণ্ড খুঁজে পেয়েছিল, পাশাপাশি Bartonella quintana নামক ব্যাকটেরিয়ারও সন্ধান পায়, যা ট্রেঞ্চ ফিভারের কারণ।
ইনস্টিটিউট পাস্তুরের পোস্টডক্টরাল গবেষক রেমি বার্বিয়েরি এই পুরনো নমুনাগুলোতে ফিরে গিয়ে আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে টাইফাস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স করার ধারণা দেন। মাইক্রোবিয়াল প্যালিওজেনোমিক্স ইউনিটের প্রধান নিকোলাস রাস্কোভানের সাথে তিনি একটি রোগজীবাণুর বিবর্তন অধ্যয়ন করার জন্য কাজ শুরু করেন।
বার্বিয়েরি, যিনি বর্তমানে এস্তোনিয়ার টার্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল গবেষক, বলেছেন, "আমরা এভাবেই শুরু করেছিলাম, কিন্তু প্রত্যাশার চেয়েও অন্য কিছু পেয়েছি।"
মাত্র দুই দশক আগেও বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্ট রোগজীবাণু শনাক্ত করার জন্য সেই জীবাণুর ডিএনএ খণ্ড খুঁজতেন, যেখানে তাদের পূর্বধারণা থাকত কী খুঁজতে হবে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে গবেষকরা এখন দাঁতের অভ্যন্তরে থাকা সমস্ত ডিএনএ খণ্ডাংশ সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হয়েছেন। এরপর সেগুলোকে পরিচিত সব অণুজীবের একটি বিশাল ডেটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ একটি পদ্ধতি।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃ-তাত্ত্বিক জিনতত্ত্ববিদ অ্যান স্টোন, যিনি এই গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন না, বলেন, 'এটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে যে এই ক্ষেত্রটি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসপ্রেমীরা এতে দারুণ আগ্রহী হবেন। প্রযুক্তিগতভাবে কাজটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে করা হয়েছে, যদিও নমুনাগুলোর সংরক্ষণ অবস্থা ভয়াবহ হওয়ায় কাজটি ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।'
গবেষকরা চারটি নমুনায় সালমোনেলা এন্টারিকার একটি সংস্করণ খুঁজে পেয়েছেন, যা প্যারাটাইফয়েড জ্বরের কারণ। এই রোগে র্যাশ, জ্বর এবং হজম সংক্রান্ত নানা সমস্যা দেখা দেয়। একটি নমুনায় এবং সম্ভবত দুইটিতেও তারা বোরেলিয়া রিকারেন্টিস এর প্রমাণ পেয়েছেন, যা উকুনবাহিত রিল্যাপ্সিং ফিভারের কারণ।
নিকোলাস রাস্কোভান বলেন, 'আধুনিক সময়ে এই রোগগুলো সাধারণত প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী ছিল চরম দুর্দশার মধ্যে। আমরা এমন একটি সেনাবাহিনীর কথা বলছি যারা ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায়—এমন একটি রোগজীবাণু সহজেই কারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারত।'
বার্বিয়েরি ও রাস্কোভান জানান, তাদের গবেষণা এটা বলছে না যে টাইফাস ছিল না; বরং এটা কেবল দেখায় যে এই গণকবরের তিন হাজারেরও বেশি মৃতদেহের মধ্যে অন্তত ১৩ জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য রোগও বিদ্যমান ছিল। এটি সেই শীতকালের ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ দুর্ভোগের চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। খাদ্যের দূষণের কারণে সৃষ্ট হজম সংক্রান্ত সমস্যার ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোর সঙ্গেও এর সঙ্গতি রয়েছে।
তালটি বলেন, 'এই নতুন গবেষণাটি আবারও প্রমাণ করে যে পুরো অভিযানটি কতটা অসম্ভব ছিল; রেলপথ এবং অ্যান্টিবায়োটিকের পূর্ববর্তী সময়ে, এই আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যর্থতার মুখে পড়েছিল।'
