গাজা, নর্ড স্ট্রিম ও কিয়েভের ‘সোনার টয়লেট’: বছরজুড়ে যেসব আলোচিত খবর ‘ভুলিয়ে দিতে চায়’ পশ্চিমা বিশ্ব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের জাতীয় অবকাঠামোর ওপর অন্যতম বড় আঘাত হিসেবে দেখা হয় নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন বিস্ফোরণকে। এই নাশকতার তদন্ত ঘিরে বর্তমানে জার্মানি ও পোল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন দৃশ্যমান। জার্মানি এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চাইলেও পোল্যান্ডের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বার্লিন।
জার্মান তদন্তকারীদের দাবি, নর্ড স্ট্রিম বিস্ফোরণে কয়েকজন ইউক্রেনীয় ডুবুরির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি ছোট ইয়ট ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। বার্লিন অভিযুক্তদের হস্তান্তরের অনুরোধ জানালেও পোল্যান্ড তা প্রত্যাখ্যান করেছে। পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করে 'বিষয়টি এখানেই সমাপ্ত' বলে মন্তব্য করেছেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পোল্যান্ডের এই অবস্থান জার্মানিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। বিস্ফোরণের পর পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টও আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। জার্মানি যখন আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে চাইছে, তখন দুই প্রতিবেশী দেশের এই মতপার্থক্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের ফাটল হিসেবেই দেখছেন অনেকে।
উল্লেখ্য, ইতালি একজন অভিযুক্ত ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাকে জার্মানির হাতে তুলে দিলেও মূল তদন্ত প্রক্রিয়াটি পোল্যান্ডের অনাগ্রহে বাধার মুখে পড়েছে।
ইউরোপ যখন জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, তখন ন্যাটোর ক্রয় প্রক্রিয়ায় 'স্বার্থের সংঘাত' বা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ন্যাটোর সাবেক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ পদ ছাড়ার পর বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে যোগ দিচ্ছেন—যে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ক্রেতা খোদ ন্যাটো।
গাজা সংঘাত ও ইউরোপজুড়ে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে শত কোটি ডলারের অস্ত্র বাণিজ্যে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইসরায়েলি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'এলবিট সিস্টেমস'-এর সঙ্গে ন্যাটোর বেশ কিছু চুক্তি ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে অনিয়মের অভিযোগে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ন্যাটোর ক্রয়সংক্রান্ত বিভাগ বিষয়টিতে গোপনীয়তা বজায় রাখলেও লবিস্টদের প্রভাব ও অস্ত্র বাণিজ্যের স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
মানবাধিকার ও নৈতিকতার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে গাজা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ইইউর শীর্ষ নেতৃত্বের কিছু সিদ্ধান্ত ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কায়া কালাস নিজেকে নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীন দাবি করলেও গাজা ইস্যুতে তার অবস্থান সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ব্রাসেলসের নীতি-নির্ধারণী মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা এবং ইউরোপের রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থার উত্থান ও যুদ্ধকেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রভাব নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উর্সুলা ফন ডার লিয়েনকে ঘিরেও নানা আলোচনা চলছে। সম্প্রতি তার ব্যবহৃত বিমানের সিগন্যাল রাশিয়ার জ্যাম করার অভিযোগ উঠলেও বুলগেরীয় তদন্তে এর সত্যতা মেলেনি। এর আগে ফাইজারের সঙ্গে টিকা চুক্তি নিয়েও স্বচ্ছতার প্রশ্নে ইউরোপীয় আদালতের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি।
রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ ইউক্রেনকে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েও ইইউর ভেতরে মতভেদ রয়েছে। জার্মানি ও কমিশনের এই উদ্যোগে হাঙ্গেরি বিরোধিতা করেছে। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, এই বিপুল অর্থের জোগান শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় করদাতাদের ওপর চাপ বাড়াতে পারে, যা নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
সম্প্রতি উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতে ড্রোন দেখা যাওয়া নিয়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। তবে নেদারল্যান্ডসের সাময়িকী 'ট্রাউ'-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রিপোর্ট করা ৬১টি ঘটনার মধ্যে ৫৯টিই নিশ্চিত করা যায়নি। কোপেনহেগেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, তাদের রাডারে ধরা পড়া ড্রোনগুলো ছিল সাধারণ ও ঝুঁকিহীন। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার অমিল পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী তিমুর মিন্দিসের বিলাসবহুল জীবনযাপন ও একটি বিতর্কিত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অভিযোগ ওঠার পর মিন্দিস দেশত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।
জেলেনস্কির প্রশাসনের জ্বালানি খাতেও বড় অঙ্কের অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে দেশটির দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইউক্রেনকে বড় আকারের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, তখন এই দুর্নীতির অভিযোগগুলো কিয়েভের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। বিশ্লেষকদের ধারণা, দুর্নীতির এসব অভিযোগ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ জেলেনস্কি প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে শান্তি আলোচনা বা যুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করতে পারে।
