ব্রিটিশ আমলে শুরু যার, এখনো সগৌরবে টিকে আছে ঢাকার সেই কল্যাণী আলতা!

দিনটা ফুল বানুর বিয়ের। বানুর হাতভর্তি চুড়ি, পরনে টকটকে লাল শাড়ি, আর আলতা রাঙা দুটো পা। 'আলতার রং যত গাঢ়, বৈবাহিক জীবন তত সুন্দর হবে'—এমন বিশ্বাসই ছিল সে সময়ে। তাই বাজারের সেরা আলতা পরানো হতো কনেকে।
'কল্যাণী' আর 'রক্তরেখা' ছিল তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম। তবে কালের পরিক্রমায় রক্তরেখা আলতার বাজার থেকে হারিয়ে গেলেও 'কল্যাণী' এখনো টিকে আছে।
যে সময়কার কথা বলছি, তখন 'আলতা বউ' ছাড়া পাড়া-মহল্লা বা মফস্বলে বিয়ে যেন ভাবাই যেত না। কনের গায়ে গয়না থাক বা না থাক, লাল টুকটুকে বউয়ের সাজ আলতা ছাড়া অসম্পূর্ণ মনে করা হতো। হাতে মেহেদি আর পায়ে আলতারঙা না হলে কনের সাজকে পূর্ণ ধরা হতো না। এমনকি আলতার উজ্জ্বল লাল রঙ বিবাহিত নারীর প্রতীক বলেও বিবেচিত হতো।
তবে সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে আলতার আবেদন অনেকটাই ম্লান হয়েছে। এখন বাঙালি নারী আলতা পরেন নববর্ষে, পূজোর দিনে কিংবা বিশেষ কোনো উপলক্ষে—সেটিও খুব একটা নিয়মিত নয়। টিভি বা সংবাদপত্রে আলতার বিজ্ঞাপন ভাবাই যায় না। অনেকটা অগোচরেই বেঁচে আছে এই ঐতিহ্য।
কিন্তু আলতা কি তবে একেবারেই হারিয়ে গেছে?
না, মোটেও তা নয়।
পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে গেলেই চোখে পড়বে নয়-দশ রকম আলতার নাম। অলিগলি ঘুরে মিলবে ইন্দিরা, খুকুমণি, সতী, সোহাগান, ভাগ্যশ্রী, কেয়াশেঠ, সোহাগ, কাবেরি আর কল্যাণীর মতো আলতা।
এরমধ্যে দেশীয় ব্র্যান্ড কল্যাণী আলতার সুনাম সবচেয়ে বেশি। যুগের পর যুগ ধরে ক্রেতাদের ভরসা জিতে নিয়েছে এটি। দেবীকে আলতা উৎসর্গ করা হোক বা লাল টুকটুকে বউ সাজা—অনেকের কাছেই কল্যাণীর বিকল্প নেই।
এই সাফল্যের পেছনে যে নাম উঠে আসে তিনি পিওলাল দেবনাথ। বয়স এখন ৭৭। পেশায় হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হলেও তার বড় পরিচিতি কল্যাণীর সঙ্গেই জড়ানো। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এর হাল ধরেছেন। তবে শুরুটা হয়েছিল অন্য কারও হাতে।

তিন পুরুষের ব্যবসা
পিওলালের মতে, কল্যাণী আলতার সূচনা ব্রিটিশ আমল থেকেই। তখন থেকেই এটি ছিল বেশ জনপ্রিয়। ব্যবসাটি ছিল সাহা পরিবারের। রজনীকান্ত সাহা থেকে শুরু হয়ে দায়িত্ব গিয়েছিল গোপালচন্দ্র সাহা পর্যন্ত।
ঢাকার ফরিদাবাদে ছিল তাদের বসবাস। ধনাঢ্য ও অভিজাত এই পরিবারকে এলাকায় সবাই চিনতো। সাবান ফ্যাক্টরি, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার পাশাপাশি ছিল আলতার কারখানা।
"আমি শুনেছি, কল্যাণী আলতা তৈরি হতো রজনীকান্ত সাহার সময় থেকে। তারপর তার ছেলে বিহারীলাল এই ব্যবসার দায়িত্ব নেন। পরে বিহারীলালের ছেলে গোবিন্দচন্দ্র সাহা মালিকানা দেখতেন। আমি ৫৭ বছর ধরে এই ব্যবসা দেখছি, আর নিজে চালাচ্ছি ৩২ বছর। আমার আগের দুই পুরুষকেও চোখে দেখেছি এই ব্যবসা করতে। তাই বলতে পারি, কল্যাণীর ইতিহাস অন্তত ১০০ বছরের," বললেন পিওলাল।
কিন্তু পিওলালের সঙ্গে সাহা পরিবারের সম্পর্ক হলো কীভাবে?
সময়ের ঘড়ি ঘুরে যায় ১৯৬৭ সালের ১২ জানুয়ারিতে। লক্ষ্মীপুর থেকে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় আসেন পিওলাল দেবনাথ। সদ্য এসএসসি পাস করেছেন তিনি, উচ্চশিক্ষার ইচ্ছায় পাড়ি জমান ঢাকায়। তবে এর জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। এক পরিচিতজনের মাধ্যমে সাহা পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয় তার।
বাড়ির কর্তা বিহারীলাল সাহা তার সৌম্য চেহারায় মুগ্ধ হয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর প্রস্তাব দেন পিওলালকে। তিনিও রাজি হয়ে যান।

এরপর ১৯৬৮ সালে সাহা পরিবারের বাড়িতে পড়ানো শুরু করেন তিনি। সুযোগে বিহারীলালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে। তখন থেকেই আলতা তৈরির পুরো প্রক্রিয়া কাছ থেকে দেখতেন তিনি। যদিও তখনো ভাবেননি একদিন এর মালিকানা এসে পড়বে তার হাতেই।
"তারা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অমায়িক মানুষ ছিলেন সবাই। কীভাবে ব্যবসা চালাতেন, কীভাবে আলতা বানাতেন—সবই কাছ থেকে দেখতাম," বলছিলেন পিওলাল।
মুক্তিযুদ্ধের পর সাহা পরিবারের অনেকেই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। ১৯৯৪ সালের দিকে তারা বাড়িঘর বিক্রি করে দেন। তখনই ব্যবসাটি কিনে নেন পিওলাল।
তবে এর জন্য তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।
"মনে করেন বাবা-দাদা চলে গেলেও নাতিরা ব্যবসা চালাতেন। আমি তাদের কাছ থেকে কিনে নিই। আমাকে চিনতেন বলে খুব সামান্য টাকায়, নামমাত্র দামে বিক্রি করেছিলেন। ধরতে গেলে আমি তেমন কিছুই দিইনি," জানালেন তিনি।
পুরোনো ফর্মুলায় নতুন মোড়ক
মালিকানা পেয়ে গেলেও নাম পরিবর্তনের ইচ্ছে কখনো জাগেনি পিওলালের। কারণ 'কল্যাণী' নামটি তার মনে খুবই মনে ধরেছিল।
একদিকে, কল্যাণী নামটি মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, অন্যদিকে তার স্ত্রীর নামও ছিল কল্যাণী। তাই মালিকানা বদল হলেও নাম অপরিবর্তিত থাকে। তবে হ্যাঁ, মোড়ক বদলানো হয়েছে, ব্র্যান্ডটিকে বাজারে নতুন আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
ফরিদাবাদে অবস্থিত পিওলালের ছোট কারখানায় ৩২ বছর ধরে তৈরি হচ্ছে এই জনপ্রিয় প্রসাধনী। তিনি মোড়ক বদলালেও পুরোনো ফর্মুলা অপরিবর্তিত রেখেছেন।

পিওলাল বলেন, "যে কেমিস্ট আগে আলতা বানাতেন, তার কাছ থেকেই কাজ শিখেছি। তার সহযোগিতাতেই প্রথমে কাজ শুরু করি।"
কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি। ব্যবসার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিসিক থেকে উদ্যোক্তা ট্রেনিং নিয়েছেন। পরে বিসিকের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানেও পরিণত করেন।
"আগে কোনো কাগজপত্র ছিল না। আমি এসে সব লাইসেন্স করি। ট্রেড লাইসেন্সও নিই," বললেন তিনি।
এককালে একাই মালামাল আনা-নেওয়ার কাজ সামলাতেন। এখন কাঁচামাল আনা-নেওয়ার দায়িত্ব কর্মচারীদের। আলতা তৈরির সমস্ত কাঁচামাল আসে চকবাজার, মৌলভীবাজার, নয়া বাজার ও জিন্দাবাহার থেকে। পিওলালের ছোট কারখানায় ছয়জন কর্মী এই কাজ সারেন।
কাঁচের শিশি থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের বোতল—বিভিন্ন মোড়কে কল্যাণী আলতা পাওয়া যায় বাজারে। একই আলতা ভিন্ন বোতল ও মোড়কে সাজিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার কৌশল নিয়েছেন পিওলাল। দামও রেখেছেন সহজলভ্য। পাইকারি ক্রেতারা ২০–৩০ টাকায় ছোট ও বড় আলতা কিনে নেন। বাজারে বিক্রি হয় ৩০ ও ৫০ টাকায়।
শাঁখারীবাজারজুড়ে ছড়িয়ে আছে কল্যাণী আলতার সরবরাহ। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী—সারাদেশে এর চাহিদা।
পিওলাল হাসিমুখে বললেন, "আলতার বিক্রি আগের চেয়ে অনেক ভালো। মানুষ আগে যতটা কিনতো, এখন তার চেয়েও বেশি কিনছে। আগে এক ডজন আলতার দাম ছিল ৭২ টাকা। একটার দাম ৬ টাকা। তবুও এখন বিক্রি বেশি।"

সেরা স্থানীয় ব্র্যান্ড
শাঁখারীবাজারে তাক ভরা ঝলমলে ভারতীয় আলতা। নাম শুনলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়—কোনো আলতার রঙ টকটকে লাল, আবার কোনোটা 'দীর্ঘস্থায়ী'। কিন্তু শেষমেষ ক্রেতার ব্যাগে জায়গা করে নেয় সেই পুরোনো চেনা দেশীয় কল্যাণী।
বিক্রেতা অশোক মুচকি হেসে বললেন, "মেয়েরা দোকানে ঢুকেই বলে ওঠেন—'একটা কল্যাণী দেন তো!' এত বিদেশি ব্র্যান্ডের ভিড়েও তারা নাম উল্লেখ করে চান। বোঝাই যায়, কল্যাণীর জনপ্রিয়তা!"
অশোক জানান, 'খুকুমণি' নামের আরেকটি আলতাও বেশ জনপ্রিয়। মানও ভালো। তবু বিক্রির হিসাবে কল্যাণীর জনপ্রিয়তা সবার ওপরে। "ভারতীয় ব্র্যান্ড যতই থাকুক, আলতার বাজারে আসল রাজত্ব করছে কল্যাণী। বলতে পারেন সেরা স্থানীয় ব্র্যান্ড," যোগ করেন তিনি।
দোকানী রাজীব নাগও একই কোঠা জানালেন। ২০০০ সাল থেকে শাঁখারীবাজারে আলতা বিক্রি করছেন। শুরুটা করেছিলেন তার বাবা, আরও ১৫ বছর আগে।
রাজীব বলেন, "গত ৪০ বছরে দুটি আলতা সমান জনপ্রিয় ছিল—'রক্তরেখা' আর কল্যাণী। গত ২৪ বছরে দেখেছি দেশীয় কল্যাণীর বিক্রি শুধু বেড়েছে। লোকাল ব্র্যান্ড বলতে এখন কল্যাণীই চলে। ভারতের অনেক ভালো আলতাও এটির মতো বিক্রি হয় না।"

আলতা ছিল সবার
আগে আলতা ছিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান—সব ধর্মের মানুষের। এখানে যতটা না ধর্মীয় অনুষঙ্গ, তার চেয়ে বেশি ছিল সংস্কৃতি। তাই মুসলিম বিয়েতেও আলতা পরা চলত।
'ওই রাঙা পায়ে রাঙা আলতা প্রথম যেদিন পরেছিলে,
সেদিন তুমি আমায় কি গো ভুলেও মনে করেছিলে –
আলতা যেদিন পরেছিলে?'
—কবি কাজী নজরুল ইসলামের আলতা স্মৃতি কবিতা থেকে সেকালের প্রেমিকের প্রেয়সীর আলতার প্রতি যে অনুরাগ, তা ফুটে ওঠে দারুণভাবে।
এছাড়া, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গান, 'আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়ায়' কিংবা আশির দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা, শাবানা-রাজ্জাক অভিনীত 'দুই পয়সার আলতা' থেকে বোঝা যায় আলতা বাঙালি সংস্কৃতিতে মিশে আছে কতখানি। কল্যাণী আলতা যেন সে সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে ছিল আষ্টেপৃষ্টে। তবে পিওলালের অবর্তমানে দেশীয় এই জনপ্রিয় ব্র্যান্ড কি হারিয়ে যাবে?

এই একই চিন্তা ভর করেছে পিওলালেরও মাথায়। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে এবং এক ছেলে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। বড় ছেলে থাকেন ঢাকার উত্তরায়। সেখানে নিজের ব্যবসার দেখভাল করেন।
আলতা ব্যবসার ভার এখনও পুরোপুরি পিওলালের হাতেই। হাল ছাড়তে রাজি নন তিনি। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তারও বারবার মনে হয়, এই উত্তরাধিকার কার হাতে যাবে? তাই আক্ষেপের সুরে বলেই ফেললেন, "আমি জানি না আমার পর এই ব্যবসার হাল কে ধরবে। ভাগ্যের লিখনই বুঝি শেষ কথা।"
- ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড