ঢাকায় এক কুয়া আছে, কুয়ায় পানিও আছে, সে পানি ওয়াসার চেয়ে ভালো!
ঢাকার নারিন্দার শরৎ গুপ্ত রোড। শেষ মাথায় যে বাড়িটি, তার নম্বর চুয়াল্লিশ। ওই বাড়িতে যে কুয়াটি আছে, তা পাতকুয়া নয়, ইঁদারা। পাতকুয়া আর ইঁদারার মধ্যে ফারাক কী?
প্রথমে পাতকুয়ার কথায় আসা যাক। বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান মতে, পাতকুয়া মানে কাঁচা কুয়া। কুমারকুল মাটি পুড়িয়ে একরকম রিং বানান। এগুলোকে মাটির পাট বলা হয়। এমন একাধিক পাট একের ওপর আরেক বসিয়ে যে কুয়া তৈরি হতো, তার নাম পাটকুয়া—ক্ষয়ে ক্ষয়ে যা হয়েছে পাতকুয়া।
তবে সর্বত্র কিন্তু মাটির পাট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ত না, বিশেষ করে লালমাটির অঞ্চলে। সেখানে ঘেরাও দেওয়া লাগত না, কারণ সেগুলোতে সহসা মাটি ভেঙে পড়ত না। এগুলোকে সোজা ভাষায় বলে মাইট্যাকুয়া। আমাদের দেশে অল্প খুঁড়লেই পাতালে পৌঁছানো যায়—সে অর্থে পানি হাতের নাগালে, ৪০-৫০ ফুট খুঁড়লেই পানি।
ইঁদারায় কিন্তু পয়সা খরচ বেশি হয়। এর নিচ থেকে ওপরে পর্যন্ত থাকত ইটের রিং। ইঁদারার ওপরে চাকা লাগানো হতো, যা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পানি তুলতে কপিকল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। রশিতে বালতি বেঁধে ইঁদারা থেকে পানি তুলতে হতো। রশি পচে ইঁদারায় পড়ে গেলে তা ওঠানোর জন্য বড়শির মতো কাঁটাওয়ালা লোহার হুক ব্যবহৃত হতো। পুরোনো দিনে জমিদার, রাজা-বাদশারা প্রজার হিতার্থে কুয়া খনন করে দিতেন, আর নিজেদের বাড়িতে গড়তেন ইঁদারা। কুয়া বা ইঁদারার বয়স শত শত বছর।

অতীতকালে পানির উৎস ছিল পুকুর, খাল, বিল, নদী-নালা। গ্রীষ্মকালে এগুলো সব শুকিয়ে যেত। তখন এসবের পানি নোংরা হয়ে যেত, আর পান করার মতো থাকত না। তাই ভরসার নাম হয়ে উঠত কুয়া বা ইঁদারা। কুয়ায় পড়ে যাওয়া ঘটি-বাটি, আংটি-চুড়ি তুলে দেওয়ার জন্য 'কুয়া তোলা' বলে এক শ্রেণির পেশাজীবী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। কুয়ার কাঁদা সাফ করে চুন মাখিয়ে দেওয়ার জন্যও কিছু লোক কাজ করত। তারা 'কুয়া সাফ, কুয়া সাফ' বলে চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলত।
আমাদের দেশে কুয়াকাটা নামে এক জায়গা আছে সমুদ্রের পারে। সাগরের জল লোনা বলে সেখানে কুয়া খোড়া জরুরি ছিল। টেকনাফের একটি কুয়াও নামকরা—সেটি মাথিনের কূপ নামে পরিচিত। কলকাতার পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য ও রাখাইন কন্যা মাথিনের প্রেমের করুণ পরিণতির সাক্ষী এই মাথিনের কূপ।
ঢাকায় কূপের সংখ্যা ছিল অগণিত। আশির দশকেও ঢাকায় কূপের ভালো ব্যবহার ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে এটি কমতে থাকে। তবে এখনো ঢাকার শাখারিবাজার, ফরাসগঞ্জ, গোয়ালনগর, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, ঠাটারিবাজারে দু-চারটি সচল ও নিত্য ব্যবহার্য কূপ রয়েছে বলে জানা যায়।
নারিন্দার ওই চুয়াল্লিশ নম্বর শরৎ গুপ্ত রোডের ইঁদারাটিও সচল ও নিত্যদিন ব্যবহৃত হয়। বাড়িতে বাইশটি পরিবারের বাস। বোঝাই যাচ্ছে, পেল্লায় সে বাড়ি। বাড়িটিও যেনতেন লোকের নয়। সে কথায় আসছি পরে। বাইশ পরিবারের লোকসংখ্যা একশর বেশি। তবে সবাই যে ইঁদারার ওপর নির্ভরশীল, তা নয়। ইঁদারা ঘিরে যে চারটি পরিবার বাস করে, তাদের সদস্যসংখ্যা ত্রিশ—এরা পুরোপুরি গোসল ও রান্নাবান্নার পানির জন্য ইঁদারাটির ওপর নির্ভরশীল।

সেদিন তেতে ছিল সূর্য, রাস্তা একটুকুও ফাঁকা ছিল না। নওয়াবপুর থেকে হেঁটে মহাজনপুর ধরে টিপু সুলতান রোডে উঠলাম। তারপর নারিন্দা পৌঁছে শরৎ গুপ্ত রোডের মুখে এক পান দোকানে কুয়ার কথা বললাম। একজন বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, সম্ভবত শক্তি ঔষধালয়ের বাড়িটিতেই থাকবে কুয়াটি।
বাড়ির সদর দরজা দেখেই আন্দাজ হলো, এটি সম্পন্ন ব্যক্তির বাড়ি ছিল। সদর দরজার ওপরে সম্ভবত প্রহরীকক্ষ বা নহবতখানা ছিল। এখন শ্যাওলা আর সময় অনেক কিছু বোঝার সুযোগ দেয় না। দরজার পর চিলতে পথ, তারপরই খোলা চৌকোনা উঠান। মেঝেটা বাঁধানো। উঠানের পর নারায়ণ মন্দির। মন্দিরের গায়ে প্রতিষ্ঠার সাল লেখা ১৩০৮—ইংরেজি অব্দে দাঁড়ায় ১৯০১।
ওই বছরই অধ্যক্ষ মথুরামোহন চক্রবর্ত্তী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আয়ুর্বেদীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান শক্তি ঔষধালয়।
উঠানের বাঁ ধারে মূল ভবন। চওড়া ছাতির তালগাছের মতো লম্বা, দ্বিতল উচ্চ থামের ওপর ভবনের ভার রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত। থামের মাথায় কারুকাজ, তার ওপর আবার গ্রিক প্রাচীন মন্দিরগুলোর মতো একটি ত্রিভুজ। বাড়ির ডান পাশে নাকি রংমহল ছিল! সেকালে ঢাকাবাসীর কাছে বাড়িটি যে খুব আকর্ষণীয় ছিল, তা বোঝাই যায়। বহু টাকা খরচ করে কলকাতা থেকে নকশা করিয়ে এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল।

এখন অনেক জায়গাতেই প্লাস্টার খসে গিয়ে ইটগুলো দাঁত দেখিয়ে হাসছে। দোতলার বারান্দার দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা—'শ্রী লালমোহন চক্রবর্ত্তী (শক্তি ঔষধালয়ের মালিক)'। এইবার তাহলে সাফ হয়ে গেল, বাড়িটি কার ছিল।
তবে লালমোহন চক্রবর্ত্তী ছিলেন না শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন শক্তির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মথুরামোহন চক্রবর্ত্তীর ভাইপো। মথুরামোহন নিঃসন্তান ছিলেন বলে লালমোহন মালিকানা পেয়েছিলেন।
মথুরামোহন যখন শক্তি ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তখন বাংলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল মারাত্মক—যেমন তীব্রতায়, তেমনি পরিমাণে। অন্যদিকে কুইনাইনের বেহাল দশা—আগে যতটা কাজ করত, এখন আর তা করে না। এমন সময় মথুরামোহন আনলেন অমৃতারিষ্ট, বিজ্ঞাপনে যাকে বলা হতো 'ম্যালেরিয়ার অমোঘ মহৌষধ'।
শক্তির আরও যেসব ওষুধের নাম ও গুণাগুণ বিজ্ঞাপনে বর্ণিত হতো, সেগুলো হলো—দশন সংস্কারচূর্ণ (সর্ববিধ দন্তরোগের মহৌষধ), ছাগলাদ্য ঘৃত (মেধা-স্মৃতি বর্ধক ও ছাত্রগণের সহায়ক), মরিচাদি মলম (খুজলি ও পাঁচড়ার মহৌষধ), বহরের ননী (নালীঘা, পৃষ্ঠঘাত প্রভৃতির মহৌষধ) ইত্যাদি।

শক্তি ঔষধালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে এক আশ্চর্য কাহিনি রয়েছে। উনিশ শতকের শেষভাগে মথুরামোহন ছিলেন জুবিলী স্কুলের শিক্ষক। হঠাৎ এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। ঢাকা-কলকাতার নামীদামী চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হয়েও ফল মেলেনি। শেষমেশ তিনি গিয়ে উঠলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে, বারদীতে। দিনে দিনে ব্রহ্মচারীর চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
শোনা যায়, ব্রহ্মচারীর নির্দেশেই মথুরামোহন শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে আয়ুর্বেদ চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ব্রহ্মচারী তাকে বলেছিলেন, 'বনে-জঙ্গলে যাও। গাছগাছড়া দিয়ে মানুষের সেবা করো।' সেই ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় শক্তি ঔষধালয়।
চ্যবনপ্রাশ ও স্বর্ণসিন্দুর ছিল মথুরবাবুর উদ্ভাবিত প্রথম দুটি ওষুধ, যার মধ্যে চ্যবনপ্রাশ তৈরি হতো আমলকীর ক্বাথ দিয়ে। তরল টনিক, বড়ি, হালুয়া, চূর্ণ আর তেলজাতীয়—এই পাঁচ রকমের মোট ৩০৫টি ওষুধ প্রস্তুত করতেন মথুরবাবু। বর্তমানে টিকে আছে প্রায় একশটি। বন ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং ওষধি গাছ চেনার দক্ষ লোক কমে যাওয়ার কারণে সব ধরনের ওষুধ আর তৈরি করা যাচ্ছে না।

আধুনিক কালে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন—রোদের বদলে উপকরণ শুকানো হচ্ছে ড্রায়ারে, ট্যাবলেট তৈরি হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে। তবে প্রক্রিয়া আধুনিক হলেও ফর্মুলায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। কম খরচে মানসম্মত ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়াই ছিল মথুরামোহনের লক্ষ্য।
মথুরবাবু ঢাকার পাটুয়াটুলিতে শক্তির প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠা করেন, এবং গোড়াতে সেটিই ছিল প্রধান শাখা। ১৯০১ সালে পাটুয়াটুলি ছাড়াও শক্তির শাখা ছিল কলকাতার বড়বাজার, শিয়ালদহ, ভবানীপুর, রংপুর ও বেনারসে। ব্রহ্মচারীর নির্দেশে মথুরামোহন শক্তির আয়ের সিংহভাগই দান করতেন। যখন তিনি স্বামীবাগে কারখানা স্থাপন করেন, পাশেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রহ্মচারীর একটি আশ্রম।
ফিরে আসি ইঁদারায়, যেটি এখনো সচল। বাড়ির পেছন দিকে ইঁদারাটি অবস্থিত। গোলাকার মুখ, চওড়ায় প্রায় দশ ফুট, কিছু জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে। মেঝে থেকে মুখ পর্যন্ত উচ্চতা কোমর সমান। দুপাশে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন রয়েছে। সংলগ্ন একটি ছোট ঘর দেখে মনে হলো কাপড় বদলানোর জায়গা হতে পারে, কিংবা রান্নাঘরও হতে পারে। এখন আগাছায় ঢাকা বলে বোঝার উপায় নেই আসলে কী ছিল।
এক শিশুকে দেখলাম ইঁদারা থেকে পানি তুলে স্নান করতে। জানাল, প্রতিদিন সে এই পানিতেই স্নান করে। পানি নাকি বেশ ঠান্ডা। জানতে চাইলাম, এই পানি কি তোমরা খাও? উত্তরে সে বলল, 'না'।

ততক্ষণে দুজন নারী এসে পৌঁছালেন, দুজনের হাতেই দুটি করে ঢাউস পানির বোতল। ওয়াসার এটিএম বুথ থেকে তারা পানি নিয়ে ফিরছেন। জানতে চাইলাম, বুথটি কত দূরে? তারা জানালেন, 'দয়াগঞ্জের বড় রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়, ৭–৮ মিনিট লাগে।'
বাড়িতে ওয়াসার লাইন থাকলেও সেই পানিতে গন্ধ থাকে, মাঝে মাঝে পোকাও দেখা যায়। তাই তারা সে পানি ব্যবহার করেন না। গোসল ও রান্নার কাজে ইঁদারার পানি ব্যবহার করেন, আর খাওয়ার পানি আনেন এটিএম বুথ থেকে—প্রতিদিন দুইবার।
বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক বাসিন্দা রবিচরণ দাস। বয়স জানালেন ৯০ বছর। বললেন, তার জন্ম এ বাড়িতেই। তখন বাড়িটির জাঁকজমক ছিল চোখে পড়ার মতো। সন্ধ্যায় সদর দরজায় কেরোসিনের বাতি জ্বলত, ভেতরবাড়িতে কুপি আর হারিকেনের আলো। পেছনে ছিল কলাবাগান। বিরাট এই বাড়িটায় আরও ইঁদারাও ছিল। পেছনের অংশে শক্তি ঔষধালয়ের কারখানার কর্মচারীরাই থাকতেন বেশি।
রবিচরণ এখনো সেই কারখানায় কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। তখন সপ্তাহে পেতেন ১২ টাকা, এখন দিনে পান ৩৮০ টাকা। সবদিন অবশ্য কাজ থাকে না। যেদিন গাছগাছড়া আসে, সেদিন কিছুটা বেশি কাজ হয়—যেমন নির্দিষ্ট গাছ আলাদা করা, জ্বাল দেওয়া ইত্যাদি।

তিনি বললেন, 'আগে এই কুয়ার পানি ছিল ডালিমের রসের মতো টলটলে। খেলে শরীরে বল পাওয়া যেত।' জানালেন, শীতকালে ইঁদারার তলদেশ দুই–তিন বছরে একবার কাটা হতো, চুন মাখানো হতো—তাতে পানি আরও স্বচ্ছ হয়ে উঠত। এতে কপিকল ছিল, ছিল টিনের ঢাকনাও। কমপক্ষে ৪০ ফুট গভীর এই ইঁদারা। রবিচরণের নাতিরাও এখন এই বাড়িতেই থাকেন।
এই বাড়িতেই গাজীপুর থেকে বধূ হয়ে এসেছেন প্রিয়াংকা ঘোষ। বয়স ২৩ বা ২৪। আগে কখনো ইঁদারা দেখেননি। এখানেই প্রথম দেখেছেন—অবাক হয়েছিলেন, তবে খারাপ লাগেনি।
যখন ভারী বৃষ্টি হয়, তখন ইঁদারার পানি প্রায় উপচে পড়ে। তার সাত বছরের মেয়ে পিয়াসা তখন ইঁদারায় নেমে গোসল করে, সাঁতারও কাটে। প্রিয়াংকার দেবর লিখন ঘোষ সোহরাওয়ার্দী কলেজে পড়েন। সকালে ইঁদারার পানিতে স্নান করাটা এখন তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
শক্তি ঔষধালয়ের সেই আগের শক্তি আর নেই, নেই বাড়িটির জৌলুসও। কিন্তু এর মধ্যেও ইঁদারাটি এখনো সচল, মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগছে। বোতলের পানির এই আমলে এটা কম কথা নয়। দেখার বিষয় কতদিন আর পারে…