খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে পারে কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্যে

মোট বকেয়া ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার ফলে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে প্রভিশনিং বাড়াতে হবে। এতে ব্যবসায়ীদের নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কঠোর ঋণশ্রেণিকরণ নীতিমালা বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিয়েছে। পাশাপাশি সরকার আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে আরও ঋণ নিতে চায়। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, ব্যাংকগুলো যদি বেসরকারি খাতের ঋণ চাহিদা পূরণ করতে না পারে, তবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। মার্চ ২০২৫ শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে খেলাপি ৮ লাখ কোটি টাকা ছুঁতে পারে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ শ্রেণিকরণে কঠোর মানদণ্ড অনুসরণ করছে। পাশাপাশি বেশ কিছু বড় ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থাও অবনতির দিকে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি ব্যাংকের তারল্য ও ঋণদানের সক্ষমতা কমাচ্ছে।
'ফলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে একদিকে যেমন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া কঠিন হয়, অন্যদিকে তাদের নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে। এই ঋণ বা বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমলে তা কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। অবশ্য বর্তমানে বেসরকারি খাতে ব্যবসা করার খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঋণের চাহিদাও কম,' বলেন তিনি।
২০২৫ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে ৩.৪২ লাখ কোটি টাকা—৮১ শতাংশের বেশি—মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকৃত, যার জন্য সম্পূর্ণ প্রভিশনিং বাধ্যতামূলক। এরকম প্রভিশনিংয়ে ব্যাংকের বাড়তি মূলধন এবং নতুন ব্যবসায়িক ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে সতর্ক করা হয়েছে, মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত খেলাপিতে পরিণত হতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, দেশের পুঁজিবাজার শক্ত অবস্থানে না থাকার কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যাংকনির্ভর।
'ক্রমাগত খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোতে তারল্য চাপ বাড়ছে। সরকারও নতুন অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১.০৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। এটা তারল্য চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে,' বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম হলেও তা আগামী বছরখানেকের মধ্যে বাড়তে পারে। তখন ব্যাংকগুলোকে এই বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। আর বেসরকারি খাতে চাহিদামতো ঋণ দেওয়া না গেলে উৎপাদন কমে যাবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে—জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যেসব বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা মূলত সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়।
'ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করতে শুরু করায় ব্যাংকগুলো বিদেশি ব্যাংকগুলো থেকে যে অনৈতিক সুবিধা পেত, তা পাবে না। সাকুল্যে খুব বেশি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। কারণ, স্বল্পমেয়াদে হয়তো কিছু ব্যাংক সমস্যায় পড়বে, তবে দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে আমাদের এখানকার ব্যাংক ও তথ্য নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে,' বলেন তিনি।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ঋণ শ্রেণিকরণে কড়াকড়ি—বিশেষত ওভারডিউ পিরিয়ডের সীমা ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা—প্রভাব ফেলেছে এবং নতুন করে শ্রেণিকৃত খেলাপির সংখ্যা বেড়ে গেছে।
তিনি ধারণা করেন, সেপ্টেম্বর নাগাদ মোট খেলাপি ঋণ ৮ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত বছরের জুনে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত, অবলোপনকৃত বা মামলায় আটকে থাকা ঋণ দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬.৭৫ লাখ কোটি টাকা। ধীরে ধীরে অবলোপনকৃত বা মামলায় আটকে থাকা ঋণ বাদে প্রায় পুরোটাই খেলাপি ঋণের তালিকায় যুক্ত হতে পারে।
সরকারের ঋণগ্রহণ চাপ বাড়াচ্ছে
২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ১.০৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে—যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত ৯৯ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। এটি আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির ৪৭ শতাংশ পূরণ করবে, যেখানে চলতি অর্থবছরে এই হার ছিল ৪৪ শতাংশ।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ধার বাড়ানোর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রাপ্যতা কমবে। এমনকি মূল্যস্ফীতি ও সুদহার কিছুটা কমলেও তারল্য সংকটের কারণে ঋণের সুদহার চড়াই থাকবে, যা ব্যবসার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাতে বছরে গড়ে ১.৪৫ লাখ কোটি টাকা আমানতে প্রবৃদ্ধি হলে এর মধ্যে সরকারই যদি ১.০৪ লাখ কোটি টাকা নিয়ে নেয়, তবে বেসরকারি খাতের জন্য সামান্যই অবশিষ্ট থাকবে। 'বাস্তবে ঋণগ্রহণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম থাকলেও এই ধারা উদ্বেগজনক,' বলেন তিনি।
মোস্তফা কে মুজেরীও প্রায় একই সুরে বলেন সরকারের ধারাবাহিক ব্যাংকনির্ভরতা ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের সক্ষমতা কমিয়ে দেবে।
বেসরকারি খাতে বাড়ছে উৎকণ্ঠা
ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বার অভ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশের মজুরি হারের তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ায় এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকের তারল্য সংকট আরও তীব্র হবে এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, ডলার সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেকদিন ধরে শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই উৎপাদন সক্ষমতার আংশিক ব্যবহার করে টিকে আছে। দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় ভোক্তার চাহিদাও কমে গেছে। ফলে আগামীতে আরও অনেক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপিতে পরিণত হতে পারে।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ''ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এজন্য সবার আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। আগামী নির্বাচনের আগপর্যন্ত খেলাপি ঋণ বাড়তেই থাকবে। নির্বাচিত সরকার ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে পারলে স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে খেলাপি ঋণ কমা শুরু করবে'।'
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ঋণখেলাপি বেড়ে যাওয়ায় পোশাক খাতে ঋণপ্রাপ্তি ইতিমধ্যেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি 'ব্যাংকগুলোতে এমনিতেই তারল্য সংকট রয়েছে। খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। আমরা খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করার প্রস্তাব করেছি। এখন তিন মাস কিস্তি না দিলে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, এটাকে ছয় মাস করার প্রস্তাব দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে যে, আইএমএফের শর্তের কারণে এটা করা যাচ্ছে না।'
বিজিএমইএ সভাপতি জানান, ঋণপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ঋণ শ্রেণিকরণের শর্ত শিথিল করার দাবিতে বিজিএমইএ শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় বসবে।