ব্যাংকখাতে সমস্যাপূর্ণ ঋণ ১১ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে: সিটি ব্যাংকের এমডি

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ (ডিট্রেসড) অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন।
গত বছরের ডিসেম্বরেও ব্যাংক খাতে সমস্যাপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৫ শতাংশ। এ তথ্য দেশের আর্থিক ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থাকেই তুলে ধরছে।
আজ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) 'ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ' শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় এসব মন্তব্য করেন মাসরুর আরেফিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ-ওয়েইডেন যৌথভাবে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
প্যানেল আলোচনায় মাসরুর আরেফিন বলেন, সমস্যাপূর্ণ সম্পদের মধ্যে ৪ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ (এনপিএল) হিসেবে চিহ্নিত। বাকিগুলো হলো পুনঃতফসিলকৃত ঋণ, রাইট-অফ করা ঋণ এবং এমন কিছু ঋণ যা আপাতত সচল থাকলেও খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে।
অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাতে করপোরেট গভর্ন্যান্স, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং সংস্কারের জরুরি প্রয়োজন নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। এ সময় আলোচনার মূল প্রবন্ধে এক খসড়া গবেষণাপত্র উপস্থাপনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ও ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বক্তব্য দেন। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মাসরুর আরেফিন বলেন, দেশের মোট ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ৭–৯টিকে আন্তর্জাতিক মানের হিসেবে ধরা যায়। প্রায় ৪০টি ব্যাংক মানসম্মত নয় এবং ১৫টি ব্যাংক দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত "লুটপাটের" কারণে তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে।
তিনি জানান, এসব সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকে আমানতকারীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন—বড় অঙ্কের আমানত থেকেও মাসে কেবল নামমাত্র অর্থ ফেরত পাচ্ছেন। কার্যত, এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাংক-রান ঘটেছে। তবে শক্তিশালী ব্যাংকগুলো এখনো সুরক্ষিত এবং বিদেশি অংশীদারদের আস্থা ধরে রেখেছে।
ব্যাংকখাত নিয়ে তিনি সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেন, বিদেশি মুদ্রার সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। টাকার মূল্য স্থিতিশীল হয়েছে, বাণিজ্য ও চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত এসেছে। ইতোমধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের কাজ চলছে, এবং কিছু সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক তাদের শক্তিশালী ব্র্যান্ড সুনামের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
নতুন অধ্যাদেশ আকারে প্রণীত ব্যাংক রেজুল্যেশন আইন-কে তিনি আরেকটি বড় মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন। এ আইন ব্যাংক একীভূতকরণ, খারাপ ঋণ শোষণে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন এবং ব্যর্থ ব্যাংকগুলোতে সরকারের কাঠামোবদ্ধ হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেবে বলে মনে করেন তিনি।
প্যানেল আলোচনায় সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার কথা বলা হয়েছে। ভালো ব্যাংকেও কেন এ নিয়ম মানতে হবে? নতুন খসড়ায় আরও বলা হয়, একটি পরিবার একটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার রাখতে পারবে। তবে পরিবারের সংজ্ঞায় বিভিন্ন ধরনের আত্মীয়স্বজনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবে দেশের ব্যাংক খাতে বড় লুটপাট হয়েছে বেনামি নামে, বৈধ শেয়ার মালিকানার কারণে নয়।
তার মতে, এতে ভালো ব্যাংকগুলোকেও শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, অথচ মূল সমস্যার জায়গা—ব্যক্তিগত পর্যায়ের দুর্নীতির জায়গাটি অমীমাংসিত রয়ে যাচ্ছে।
ব্যাংক এশিয়ার এমডি সোহেল আর কে হোসেন বলেন, ব্যাংকের মূলধনের ৯৫ শতাংশ আসে আমানতকারীদের কাছ থেকে, আর মাত্র ৫ শতাংশ পরিচালকদের কাছ থেকে। তবুও অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে পরিচালকরা নিজেদের মতো করে ব্যাংক চালান। তিনি কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে এ ধরনের অনিয়ম বন্ধ করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেন।
তার মতে, বাংলাদেশ এখন ব্যাংক খাতের ইতিহাসে অন্যতম গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার মোট ঋণের ৩০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, যা আদায় করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি আরও বলেন, এ সংকটের মূলে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি শাসন ব্যর্থতা, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ— সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের প্রভাব এখানে কাজ করেছে।
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, গত ৭–৮ বছরে ব্যাংক খাতের প্রচলিত তদারকি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পারস্পরিক ভারসাম্য, নিরীক্ষক ও রেটিং এজেন্সির ভূমিকা, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কার্যকারিতা, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিও কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, কিছু ইসলামী ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে গত সরকারের আমলে দুর্নীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়েছিল।
তার মতে, ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও স্বাধীনতা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।