ছয় বছর আগে জাতিসংঘে ট্রাম্পের বক্তব্যে শ্রোতারা হেসেছিলেন, এ বছর নীরব

জাতিসংঘে এবারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া ভাষণ ছিল বিশ্বের প্রতি তার দর্শনের অন্যতম স্পষ্ট প্রকাশ। সেখানে তিনি তার মতাদর্শকে সবচেয়ে খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছেন বলা যায়।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, তার সমর্থকদের কাছে এটি ছিল 'ট্রাম্পিজম আনপ্লাগড'; আর সমালোচকদের কাছে এটি ছিল 'ট্রাম্পিজম আনহিঞ্জড'।
প্রায় এক ঘণ্টার এই ভাষণে তিনি তার প্রতিপক্ষ ও তাদের ধারণাকে একে একে আক্রমণ করেছেন। নিজের ঘর থেকে শুরু করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও নিজের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন স্বর্ণযুগ চলছে। এসময় তিনি তার সেই বিতর্কিত দাবির আবারও পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, তিনি নিজে সাতটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন। তার মতে এগুলোর জন্যই তিনি শান্তিতে নোবেল পাওয়ার দাবিদার।
কিন্তু এরপর প্রেসিডেন্ট আয়োজকদের দিকে আঙুল তুলেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘ তার শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় কোনো সহায়তাই করেনি। তিনি সংস্থাটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার ভাষায়, জাতিসংঘের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু তা কাজে লাগানো হচ্ছে না। তিনি দাবি করেন, জাতিসংঘ যা করে তা হলো শক্তিশালী ভাষায় চিঠি লেখা, যার কোনো বাস্তবায়ন নেই। তিনি মন্তব্য করেন, 'ফাঁকা কথায় যুদ্ধ থামে না।'
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়প্রার্থীদের দেওয়া জাতিসংঘের সহায়তারও সমালোচনা করেন তিনি। তার মতে, 'জাতিসংঘের কাজ আক্রমণ ঠেকানো, তা সৃষ্টি করা বা তার অর্থায়ন করা নয়।' এমনকি তিনি ভ্রমণ ও ভাষণ চলাকালে ঘটে যাওয়া জাতিসংঘের ভাঙা এস্কালেটর ও বিকল টেলিপ্রম্পটার নিয়েও কটাক্ষ করেন।
তবে এক দিক থেকে তার বক্তব্যে যুক্তি ছিল। অনেক বিশ্লেষকও বর্তমান সময়ে সংঘাত সমাধানে জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা ও সংস্থার অকার্যকর আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে ইঙ্গিত করেন।
তবে অন্য দিক থেকে দেখা যায়, জাতিসংঘের অকার্যকারিতার একটি কারণ এবং উপসর্গ দুটিই যেন ট্রাম্প নিজেই। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, বৈশ্বিক সংকটের সমাধান বহুপাক্ষিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘের মাধ্যমে নয়, বরং তার মতো শক্তিশালী নেতাদের সরাসরি বসে চুক্তি করার মাধ্যমেই সম্ভব।
ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের বড় অংশের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয়, ফলে সংস্থাটিকে বিশ্বজুড়ে তার মানবিক কার্যক্রম কমিয়ে আনতে বাধ্য হতে হয়েছে।
এদিকে ট্রাম্পের সম্ভবত সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল ইউরোপীয় মিত্রদের উদ্দেশে। তিনি ইউরোপকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করা এবং অভিবাসনের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার কারণে সমালোচনা করেন।
ট্রাম্প বলেন, 'ইউরোপ ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছে। তারা অবৈধ অভিবাসীদের এমন এক শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, যা আগে কেউ কখনও দেখেনি… অভিবাসন ও আত্মঘাতী জ্বালানি নীতিই পশ্চিম ইউরোপের মৃত্যু ডেকে আনবে।'
তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শ্রোতাদের বলেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি হচ্ছে 'পৃথিবীর সঙ্গে সংঘটিত সবচেয়ে বড় প্রতারণা'। তার দাবি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো ব্যয়বহুল বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছে। তিনি বিশেষভাবে যুক্তরাজ্য সরকারকে সমালোচনা করেন উত্তর সাগরের তেলের ওপর নতুন কর আরোপের জন্য।
ট্রাম্প সতর্ক করে বলেন, 'তোমরা যদি সবুজ জ্বালানির এই প্রতারণা থেকে বেরিয়ে না আসো, তবে তোমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি ইউরোপকে ভালোবাসি। আমি ইউরোপের মানুষকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি ঘৃণা করি একে অভিবাসন ও জ্বালানির কারণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখতে। এই দ্বিমুখী দানব তার পথে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়… তোমরা রাজনৈতিকভাবে সঠিক হতে চাইছ, অথচ নিজের ঐতিহ্যকেই ধ্বংস করছ।'
শেষ মন্তব্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি প্রতিধ্বনিত করে যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় সফরে তার দেওয়া বক্তব্যকে, যেখানে তিনি 'ইংরেজিভাষী বিশ্ব'-এর মূল্যবোধ রক্ষার গুরুত্বের কথা বলেছিলেন।
ইউরোপের প্রতি ট্রাম্পের সমালোচনায় ছিল সাংস্কৃতিক দিকও। তার ধারণা, নিয়ন্ত্রণহীন অভিবাসন ইউরোপের 'জুডেও-খ্রিস্টান ঐতিহ্যকে' হুমকির মুখে ফেলছে। আশ্চর্যের কিছু নয় যে, ট্রাম্প এমন এক প্রশাসনের নেতা, যারা প্রকাশ্যেই ধর্মকে নিজেদের নীতির কেন্দ্রে রাখে।
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, 'চলুন আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করি—বিশেষ করে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ধর্মের জন্য। এ ধর্মের নাম খ্রিস্টান ধর্ম।'
নীতিগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তাটি ট্রাম্প দেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। তিনি বলেন, সংঘাত শেষ করতে অস্বীকৃতি জানানো প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য 'রাশিয়ার ভাবমূর্তিকে ভালো দেখাচ্ছে না'।
ট্রাম্প সতর্ক করেন, রক্তপাত বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র 'খুব শক্তিশালী শুল্কের নতুন একটি বড় দফা' আরোপের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তবে তিনি দাবি করেন, ইউরোপীয় দেশগুলোকে রুশ জ্বালানি কেনা বন্ধ করতে হবে। তার কথায়, তিনি মাত্র দুই সপ্তাহ আগে জেনেছেন যে কিছু দেশ এখনো তা করছে।
বাস্তবে, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়াই একমাত্র উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় দেশ যারা এখনো রুশ তেল কিনছে। কূটনীতিকদের মতে, ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে ইউরোপকে দায়ী করছেন, যাতে তাকে ভারত ও চীনের বিরুদ্ধে মাধ্যমিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে না হয়। ট্রাম্প তার বক্তব্যে দুই দেশের নামই উল্লেখ করেন।
তবে তার জাতিসংঘ ভাষণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল অল্প কিছুক্ষণ পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্ট। সেখানে প্রথমবারের মতো তিনি দাবি করেন, ইউক্রেন হয়তো তার সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হতে পারে।
রাশিয়াকে 'কাগুজে বাঘ' এবং 'আসল সামরিক শক্তি নয়' বলে অবজ্ঞা করেন ট্রাম্প। এটি নিঃসন্দেহে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আঘাত করবে, যিনি তার দেশকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে না দেখার যেকোনো ইঙ্গিতেই সংবেদনশীল। কূটনীতিকদের মতে, এটি রাশিয়া বিষয়ে ট্রাম্পের আরও সমালোচনামূলক অবস্থানের সাম্প্রতিক উদাহরণ।
তবে ট্রাম্পের বক্তব্যকে সব সময়ই কিছুটা সংশয়ে নেওয়া উচিত। তিনি এই আশাবাদী সুর তোলেন জাতিসংঘে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাতের পরপরই।
এছাড়া তিনি বলেন, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সহায়তায় তার ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে পারে; তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কোনো কথা উল্লেখ করেননি তিনি। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, এটি এক ধরনের ধীর গতির ক্ষয়যুদ্ধ, আর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে রাশিয়ার দখলকৃত ভূমি পুনর্দখল করা সম্ভব নয়।
এটাই ছিল খাঁটি ট্রাম্প—আমেরিকা ও জাতীয়তাবাদের পক্ষসমর্থন, বহুপাক্ষিকতা ও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে আক্রমণ, আর সন্দেহজনক দাবিতে ভরা এক ধরনের বিক্ষিপ্ত বক্তব্য।
ছয় বছর আগে জাতিসংঘে দেওয়া তার বক্তব্যে যখন তিনি নানা ভিত্তিহীন দাবি করেছিলেন, তখন শ্রোতারা হাসাহাসি করেছিলেন। কিন্তু এ বছর তারা বেশিরভাগই নীরবে শুনেছেন।
বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেন, 'আমি এসব বিষয়ে সত্যিই খুব ভালো। তোমাদের দেশগুলো ধ্বংসের পথে যাচ্ছে।'