ছাপ্পান্নটি গবেষণা কেন্দ্র! নিজের ‘কীর্তি’ নিয়ে দিশেহারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মাইক্রোচিপকে বলা হচ্ছে বিশ্বের নতুন তেল সম্পদ। একুশ শতকের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প। ২০৩০ সালের মধ্যে এর বাজার ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ২০৩০ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর চিপ বা ডিভাইস রপ্তানি করার পথরেখা (রোডম্যাপ) প্রকাশ করেছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন ১০ হাজার প্রকৌশলী, যারা সেমিকন্ডাক্টর নকশা করতে পারদর্শী।
'ত্রিশ বছর আগে এ স্বপ্ন দেখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক সুলতান আহমেদ। তিনি সেমিকন্ডাক্টর চিপের বৈশ্বিক সম্ভাবনাও বুঝতে পেরেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেমিকন্ডাক্টর রিসার্চ সেন্টার,' বললেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। তিনি যোগ করলেন, '১৯৮৫ সালে সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার কথা কেউ ভাবতে পেরেছিল? তখন তো শব্দটিই বেশি পরিচিত ছিল না। সুলতান আহমেদ ছিলেন দূরদর্শী এবং একনিষ্ঠ গবেষক।'
যদি সেন্টারটি প্রয়োজনীয় সহায়তা—মানে যন্ত্রপাতি, তহবিল, পোস্ট-ডক ফেলো, পিএইচডি ফেলো এবং নিবেদিত পরিচালক পেত, তবে গত চল্লিশ বছরে কয়েক হাজার প্রকৌশলী তৈরি হওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও নানা সীমাবদ্ধতায় খুব কম কেন্দ্রই সক্রিয় আছে। অথচ এত গবেষণা কেন্দ্র বিশ্বখ্যাত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই, জানালেন অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।
কিছুকাল হলো অধ্যাপক মামুন বোস সেন্টারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস সেন্টারের পরিচালক পদটি বিজ্ঞানের যেকোনো নিমগ্ন গবেষকের জন্যই মহার্ঘ। অধ্যাপক মামুন পদটি ছাড়লেন, কারণ এখানে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। জানা যাক তার নিজের লেখনী থেকে, 'বোস সেন্টারের বয়স একান্ন বছর। এর আউটপুট কী? তার আগে জানিম এর আছে কী? বিজ্ঞান কারখানায় এক রুমের একটি অফিস, আর সেখানে আছে দুজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এবং একজন পরিচালক। কিছু ছাত্রকে ফেলোশিপ দিয়ে মাসে মাসে তাদের টাকার চেক দেওয়া আর প্রতিদিন একগাদা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়া পরিচালকের কাজ। এখানে না আছে ইন-হাউজ পোস্ট-ডক ফেলো, পিএইচডি ফেলো, না আছে নিজস্ব গবেষক। যাদের ফেলোশিপ দেওয়া হয়, তারা নিজ নিজ বিভাগে থেকেই গবেষণা করে। টাকা দেওয়া ছাড়া বোস সেন্টারের কোনোই কাজ নেই। অথচ এই কাজ তো রেজিস্ট্রার ভবনের কর্মকর্তারাই করতে পারেন। এর জন্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে একটি সেন্টার (বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল সায়েন্সেস) করার কোনো মানে আছে?'
কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকসের সূতিকাগার
অধ্যাপক মামুনকে যখন দায়িত্ব নিতে বলা হলো, তিনি উৎসাহ বোধ করেছিলেন। মৃতপ্রায় গবেষণাকেন্দ্রটিকে সক্রিয় করে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯২৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক সত্যেন বসু কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকস তত্ত্ব আবিষ্কার করে চমকে দিয়েছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইনকে। পরবর্তীকালে বোস-আইনস্টাইন থিওরি সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
তাই গবেষণা কেন্দ্রটির পুনরুজ্জীবন জরুরি, নইলে যে সত্যেন বসুকে অসম্মান করা হয়। অধ্যাপক মামুন কলকাতার এসএন বোস সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সের কর্মচাঞ্চল্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। সেখানে বিজ্ঞানীরা রাত-দিন গবেষণায় মগ্ন থাকেন, কারণ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও যন্ত্রপাতি সেখানে আছে। তাই অধ্যাপক মামুন বোস সেন্টারের জন্য এক বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন। কর্তৃপক্ষ তার কিছুটা বুঝেছে, অনেকটাই বোঝেনি অথবা সবটাই উপেক্ষা করেছে। কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন ভোট অথবা দলবাজি, যার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন থাকা যায়, সেখানে বোস সেন্টারের উন্নতি-অবনতি খুবই গৌণ বিষয়। একটি জরাজীর্ণ কক্ষে বোস সেন্টার, অথচ এর থেকে ভালো ফল পেতে চাইলে কার্জন হলের পুরো একটি ভবন প্রয়োজন। তাই পদত্যাগ করেছেন অধ্যাপক মামুন।
অনেক সেন্টারের ঘরও নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে ১০টির বেশি সক্রিয় নেই। অথচ নিয়মানুসারে বরাদ্দ আছে সবার জন্য। এতগুলো সেন্টার গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে ব্যক্তিস্বার্থ নয়তো ভোট সংগ্রহ। সামাজিক বিজ্ঞান হোক বা মানবিক—প্রায় সব অনুষদ থেকেই জার্নাল প্রকাশের নিয়ম আছে। বছরে এক বা দুটি জার্নাল প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক গবেষণাপত্রও দরকার, তা সেটির স্ট্যান্ডার্ড যেমনই হোক। ডিন অফিস বা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পিছপা হন না। তারা তাদের অনুগত সহকারী অধ্যাপককে সহযোগী অধ্যাপকে উন্নীত হতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গবেষণাপত্র জার্নালগুলোতে প্রকাশ করে দেন।
অধ্যাপক মামুন বললেন, 'অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের গবেষণা কেন্দ্রগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হস্তক্ষেপ বা নজরদারির সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতগুলো গবেষণা কেন্দ্র হওয়ার বড় কারণ কাউকে খুশি করা। খুশি করার নানা ফর্মুলা আছে, গবেষণা কেন্দ্রকে এই কাজে ব্যবহার করা শাস্তিযোগ্য কাজ বলে মনে করা যায়। গবেষণা কার্যক্রম যত ভালো, একটা দেশ তত উন্নত। আর এর জন্য প্রয়োজন গবেষকের জন্য সুসংহত গবেষণা কাঠামো বা ইকোসিস্টেম। গবেষকের চলাফেরা, ওঠাবসাও ইকোসিস্টেমের অংশ। আমাদের দেশ থেকে গত এক বছরে সতেরো হাজার মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থী উন্নত দেশগুলোয় চলে গেছেন, কারণ এখানে কোনো ইকোসিস্টেমই গড়ে ওঠেনি। এখানকার গবেষণাকেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, অনেক সেন্টারের কোনো ঘর নেই, বরাদ্দ নিতান্ত নগণ্য। এক লাখ টাকা করে একটি গবেষণায় বরাদ্দ করা হলে গবেষকের কাছ থেকে আপনি কিছুই আশা করতে পারেন না, চাইতেও পারেন না।'
পাকিস্তান যা করেছিল
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোমোজোম সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে অধ্যাপক শেখ শামীম উল আলমের একান্ত আগ্রহে। সেন্টারের আলাদা কোনো ঠিকানা নেই, পরিচালকের কার্যালয়ই এর ঠিকানা। চলতি বছরে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে এ সেন্টার। আনুষঙ্গিক খরচ (কর্মচারীর বেতন ও অন্যান্য) বাদ দিয়ে ৮ লাখ টাকা গবেষণা কাজে বরাদ্দ করা যায়। দুই লাখ টাকা করে চারজন গবেষককে (বেশিরভাগ নবীন ফ্যাকাল্টি) এ টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। সাধারণত গবেষণার বিষয় নির্ধারণ ও প্রাথমিক প্রস্তাবনা দুজন রিভিউয়ারকে দিয়ে পর্যালোচনা করিয়ে নেওয়া হয়। যদি দুজনের মধ্যে মতের পার্থক্য দেখা দেয়, তবে তৃতীয় একজন রিভিউয়ারের কাছে তা উপস্থাপন করা হয়। অর্থবছরের শেষ নাগাদ আয়োজিত সেমিনারে গবেষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। প্রথম দিকে ক্রোমোজোম সংখ্যার তারতম্য, আকার-আকৃতি নিয়ে গবেষণা হয়েছে বেশি। ডিএনএ এবং প্রোটিন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে এখন, এর সঙ্গে জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিনের বংশগতির ধারা) এবং জিন স্থানান্তর নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম ২০২১ সাল থেকে ক্রোমোজোম সেন্টারের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সুইডেনে তিনি পোস্ট-ডক্টরাল পর্যায়ের গবেষণা সম্পন্ন করেন। তিনি বলছিলেন, 'আমার সঙ্গে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো ছিলেন পাকিস্তানের কয়েকজন গবেষক। তখন সেখানে রাষ্ট্রপতি ছিলেন পারভেজ মোশাররফ। তিনি নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন, প্রত্যেককে দেশে ফিরে সরকার-নির্ধারিত কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে, বিনিময়ে রাষ্ট্র প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা দেবে। যারা ফিরবেন না, তারা ব্যয়িত অর্থের পাঁচগুণ রাষ্ট্রকে প্রদান করতে বাধ্য থাকবেন। যারা কর্মস্থলে গবেষণায় মনোযোগী থাকবেন না, তাদের বেতন-ভাতা থেকে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ কেটে নেওয়া হবে। আমাদের এখানে উল্টো চিত্র দেখবেন। মেধাবীদের দেশ থেকে তাড়াতে পারলে যেন আমরা বেঁচে যাই।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'বস্তুত যখন গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করবেন, তখন গবেষক দেশে ফিরতে অনাগ্রহী হবেন না। যদিও ক্রোমোজোম সেন্টারে টাকার পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েছে, তবু বরাদ্দকৃত অর্থ রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে আমাদের কাছে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। তাতে গবেষণার জন্য নির্ধারিত সময় কমে যায়, গবেষণার মান খারাপ হয়। ক্রোমোজোম বা বায়োটেকনোলজি গবেষণা অনেকটা হাতি পোষার মতো ব্যাপার। এখানে প্রয়োজনীয় অ্যানজাইমের সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর দাম এমনিতেই বেশি, তার ওপর আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়। সব সত্ত্বেও আমি মনে করি, কেন্দ্রটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গবেষণা কেন্দ্রের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়।'
ড. নূরুল ইসলামের কাছে এ পর্যায়ে জানতে চেয়েছিলাম, 'ধরে নিচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গবেষণা কেন্দ্রের তুলনায় ক্রোমোজোম সেন্টার এগিয়ে, কিন্তু যদি বিশ্বমান বিবেচনা করি, সেক্ষেত্রে একে কত নম্বর দেবেন?' জনাব নূরুল ইসলাম বললেন, 'এ ক্ষেত্রে তুলনার কোনো সুযোগ নেই, সত্যি কোনো নম্বর দিতে পারছি না।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রগুলোর জন্য ২০২৪-২৫ সেশনের বাজেটে ২০ কোটি ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা সামান্য বাড়িয়ে ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের মাত্র ২.৮ শতাংশ।
নিষ্ক্রিয় কেন্দ্রগুলো বন্ধ হলে ভালো
অধ্যাপক মামুনের মতো ড. ইসলামও মনে করেন এই বরাদ্দ খুবই অপর্যাপ্ত। যদি নিষ্ক্রিয় কেন্দ্রগুলোকে বন্ধ বা একীভূত করা হয়, তবে হয়তো কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা তৈরি হবে। যেমন ক্রোমোজোম এবং বায়োটেকনোলজি সেন্টার একীভূত হওয়ার সুযোগ আছে। দুটি গবেষণা কেন্দ্রই একই রকম কাজ করে।
উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক জসিম উদ্দিনও বললেন, 'এতগুলো গবেষণা কেন্দ্রের আসলেই দরকার নেই, কারণ কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয়। প্রতি অনুষদে একটি করে কেন্দ্র হলেও এখনকার তুলনায় ভালো গবেষণা হবে।'
তিনি যোগ করলেন, 'কেন্দ্র বেশি হয়ে যাওয়ায় কোনোটিই পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে না। অথচ যদি নির্ধারিত অর্থ প্রয়োজনীয় কেন্দ্রগুলোতে বরাদ্দ করা যেত, তবে তহবিল অপ্রতুলতা কমত। আধুনিক যন্ত্রপাতি, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হতো।'
চিপ তৈরির সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি
সেমিকন্ডাক্টর রিসার্চ সেন্টারটি নিশ্চয়ই এর উৎকৃষ্ট নমুনা। আগামীর পৃথিবী যে চিপ দিয়ে তৈরি হবে, বুঝতে পেরেছিলেন সুলতান আহমেদ। আজ ত্রিশ বছর পর তার প্রমাণ মিলছে। সোলার প্যানেল থেকে স্মার্টফোন, কম্পিউটার থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম—সবেতেই লাগছে সেমিকন্ডাক্টর চিপ। গুণে ও পরিমাণে চিপ উৎপাদনকারী হিসেবে তাইওয়ানের নাম ছড়িয়ে গেছে সারা বিশ্বে। তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা দিতে আমেরিকা সামরিক ঘাঁটি গড়েছে এর চারপাশে।
ঢাবির সেমিকন্ডাক্টর রিসার্চ সেন্টারের তরুণ গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ন্যানো পার্টিকেলের গঠন-কাঠামো নিয়েই তারা বেশি গবেষণা করেন। তবে এটুকু কাজেরও সবটা সেন্টারে করার সুযোগ নেই। এর জন্য কখনো বিসিএসআইআর বা বুয়েটেরও দ্বারস্থ হতে হয়। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাও এখানে এসে কাজ করেন, তাই এক মাস আগে থেকেই একজন গবেষককে নাম লিখিয়ে রেখে যেতে হয়।
সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মুজিব লেনিন পলাশ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেন, 'এটি একটি মৌলিক গবেষণাস্থল। এখানে কাজ হয় ন্যানো লেভেলে, অন্যদিকে চিপ হলো একটি প্রোডাক্ট। একটি চিপ তৈরি করতে একাধিক ধাপ পেরোতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত প্রথম ধাপে পৌঁছানোর বা প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য গবেষণা হয়। সোজা কথায়, একাডেমিক পর্যায়ের ভিত্তি তৈরি হয় এখানে, আর চিপ তৈরি হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলে।'
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে যেসব গবেষণাপত্র তৈরি হয়েছে, তা কিউওয়ান জার্নালেও প্রকাশ পেয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেধাবী ছাত্র আছে। কিন্তু গবেষণার পরিবেশ না থাকায় প্রতি ব্যাচের ৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫ জন বিদেশ চলে যায়। অথচ পাশের দেশ ভারতে গবেষণা ইকোসিস্টেম এমনভাবে প্রস্তুত হয়েছে যে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে গবেষকরা দেশে ফিরে আসছেন।
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেছেন, 'প্রেসিডেন্ট বাইডেন ২০২৩ সালে যখন ভিয়েতনাম সফর করেন, তখন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বড় একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গী হয়েছিল। তারা ভিয়েতনামে সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির জন্য বিনিয়োগ ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন, কারণ একদিন হয়তো চীন সত্যি তাইওয়ানকে নিজের অধিকারে নিয়ে নেবে। বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, যেসব দেশ চিপ তৈরিতে সমর্থ, উন্নত বিশ্ব তাদের মুখাপেক্ষী থাকে, গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে এর এখানেই ফারাক যে আমরা উন্নত বিশ্বের মুখাপেক্ষী থাকি।'
শেষে ড. মুজিব লেনিন পলাশ আশার বাণীও শোনালেন। বললেন, 'ল্যাব থেকে শিল্প পর্যায়ে যেতে পরিকল্পিতভাবে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সীমিত পরিসরে চিপ ডিজাইনের কাজ শুরু করেছে। আমেরিকার কিছু বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ডিজাইন অর্ডার দিচ্ছে। দেশের তরুণ প্রকৌশলী ও শিক্ষার্থীরাই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত।'
কার্যকর করার উপায়
একটি গবেষণা কেন্দ্র কার্যকর করতে তহবিল ছাড়া আর কী কী প্রয়োজন? জানতে চাইলে ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চের (বিবিআর) পরিচালক অধ্যাপক এবিএম শহীদুল ইসলাম প্রথম যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিলেন, তা হলো একজন পূর্ণকালীন ও নিবেদিতপ্রাণ পরিচালক। অন্য কোনো দায়িত্ব দিয়ে তাকে ব্যস্ত রাখা যাবে না। আরও প্রয়োজন পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং দক্ষ কর্মী বাহিনী।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন এবং উচ্চতর সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান অধ্যাপক তৈয়েবুর রহমানও একই রকম মত ব্যক্ত করে বললেন, 'এত এত সেন্টার আছে, অথচ জনবল নেই, রুম নেই, এমনকি কম্পিউটারও নেই।'
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চের কার্যক্রমে গতি বৃদ্ধি পেয়েছে বছরের পর বছর, মনে করেন পরিচালক অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা 'বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও তাদের ক্লায়েন্টদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক', 'বাংলাদেশে শিল্প শ্রমিকদের নিরাপত্তা', 'জনজীবনে পর্যটনের প্রভাব', 'ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং' ইত্যাদিসহ আরও অনেক বিষয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। আগামীতে জিআই পণ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে কেন্দ্রটি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। তিনি বললেন, 'আমাদের অধিকাংশ জিআই পণ্য কিন্তু গ্লোবাল স্বীকৃতি পায়নি, বরং লোকাল স্বীকৃতি পেয়েছে। ধরুন আমরা মসলিনের জিআই স্বীকৃতি পেতে চাই। আমরা আবেদন করলাম ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনে বা ডব্লিউআইপিওতে। এখন আমাদের চেষ্টা করতে হবে যতটা শিকড়ে পৌঁছানো যায়, মানে যেতে হবে ইতিহাসের সূচনায়। এরপর প্রমাণ করতে হবে যে বাংলাদেশ ভিন্ন অন্য কোথাও এটি প্রস্তুত করা সম্ভব নয়, কারণ প্রয়োজনীয় মাটি, জল আর হাওয়া শুধু এখানেই মেলে। গবেষণা পদ্ধতিও আর গতানুগতিক নেই এখানে। স্টাটা, স্মার্ট পিএলএসের মতো ডাটা ম্যানেজার ও অ্যানালাইজারের ওপর গবেষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।'
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান গভর্নান্সের পরিচালক ড. কে এম আজম চৌধুরীর সঙ্গেও আমরা দেখা করেছিলাম। তিনি জানালেন, বিশ বছর আগেও পৃথিবী সমুদ্রের দিকে নজর দেয়নি। যখন স্থলভাগের সম্পদ ফুরিয়ে আসতে থাকল, তখন মানুষ ভাবল এবার সমুদ্রে যাওয়া দরকার। বাংলাদেশ এক অর্থে এ ব্যাপারে বেশ অগ্রসর, ২০১২ সালে ব্লু ইকোনমি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে এবং গুরুত্বও দিয়েছে।
ড. আজম চৌধুরী মনে করেন, তাদের কেন্দ্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সক্রিয় ও কার্যকর গবেষণা কেন্দ্র। এর কারণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তহবিল না পেলেও তারা বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে পারছে। চীনের ফার্স্ট ইনস্টিটিউট অব ওশানোগ্রাফির সঙ্গে কেন্দ্রটি যৌথভাবে কাজ করছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের গবেষকরা চীন যাচ্ছেন এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। ওশানোগ্রাফি বিভাগে ফ্রান্স সরকারের তরফ থেকে একজন ইতালিয়ান ওশানোগ্রাফার নিয়মিত ক্লাস নিয়ে থাকেন ও কর্মশালা পরিচালনা করেন। সমুদ্রের অম্লতা বেড়ে যাওয়া, দুর্যোগে আগাম সতর্কতা জ্ঞাপন করার উপায় নিয়ে তারা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রটি ২০ হাজার টাকা করে ৬ জন শিক্ষার্থীকে গবেষণা বৃত্তি প্রদান করে থাকে প্রতি বছর। তরুণ শিক্ষকদের ৭৫ হাজার ও ৫০ হাজার টাকা প্রদান করে। পুরো বছরের জন্য কেন্দ্রটির বাজেট ৬ লাখ টাকা। এখনো পরিচালকের কক্ষই কেন্দ্রটির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবু ড. চৌধুরী মনে করেন কেন্দ্রটি এগিয়ে যাবে, কারণ এর তহবিলের অভাব হবে না আর প্রয়োজনীয় জনবলও প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি এও মনে করেন, গবেষণাকেন্দ্রগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পলিসি গাইডলাইন থাকা দরকার, তাহলে গবেষণা থেকে আরও অধিক উপকৃত হওয়া যাবে।
আরও কিছু কেন্দ্রের নাম
উল্লেখিত গবেষণা কেন্দ্র ছাড়াও আরও যেসব কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে তা হলো, আরবরি কালচার, আর্কাইভস অ্যান্ড হিস্ট্রিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ স্টাডি অ্যান্ড রিসোর্স ইউটিলাইজেশন, সেন্টার ফর করপোরেট গভারনেন্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স স্টাডিজ, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল স্টাডিজ, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি রিসার্চ, সেন্টার ফর এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং, সেন্টার ফর মাইক্রোফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সেন্টার ফর প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, সেন্টার ফর আরবান রেজিলিয়েন্স স্টাডিজ, সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোস্যাল সায়েন্স, সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন হিউম্যানিটিজ, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন স্ট্র্যাটেজিক হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ডিজাস্টার রিসার্চ ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, ড. সিরাজুল হক সেন্টার ফর ইসলামিক রিসার্চ, এনার্জি পার্ক, ইনোভেশন অ্যান্ড ক্রিয়েটিভিটি সেন্টার (আইসিই), ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান গভর্ন্যান্স, কোটলার সেন্টার ফর মার্কেটিং এক্সিলেন্স (কেসিএমই), নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টার, নজরুল রিসার্চ সেন্টার, নিউরোসায়েন্স রিসার্চ সেন্টার অভ ঢাকা ইউনিভার্সিটি (এনআরসিডিইউ), অরগানিক পলিউট্যান্টস রিসার্চ সেন্টার, প্রফেসর দিলিপ কুমার ভট্টাচার্য রিসার্চ সেন্টার, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট, রিনিউয়েবল এনার্জি রিসার্চ সেন্টার (ঢাবির বিজ্ঞান অনুষদের অধীন স্বায়ত্তশাসিত), স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাডি সেন্টার, সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার, দ্য সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড লিগ্যাল স্টাডিজ, দি ইস্ট এশিয়া স্টাডি সেন্টার (ইএএসসি), ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যালায়েন্স ইত্যাদি। প্রতিটি অনুষদের অধীনে একাধিক রিসার্চ সেন্টার রয়েছে। কিছু কিছু আবার বিভাগভিত্তিক। এর ফলে সেন্টারের সংখ্যা বাড়ালেও কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার মতো সক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারেনি।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
আলোচনার শেষ পর্যায়ে অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, গবেষণা কার্যক্রম থেকে দেশ কীভাবে উপকৃত হয়? তিনি উত্তরে বললেন, 'কেবল দেশ নয়, গবেষণা থেকে পুরো বিশ্ব উপকৃত হয়। বোস-আইনস্টাইন থিওরি আজও আমাদের বস্তু ও আলোর আচার-আচরণ বুঝতে সাহায্য করে, হয়তো আগামী শত শত বছর ধরে করবে। একেকটি গবেষণার ফলাফল বস্তুত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয় এবং নতুন নতুন দ্বার উন্মুক্ত হতে থাকে। উন্নত দেশগুলো এটা বুঝতে পারে বলেই তারা উন্নত, আর আমরা বুঝতে পারি না বলে পশ্চাৎপদ।'
