থামল কামানের শব্দ: রেশম দিয়েই শুরু অর্থ কামানোর বিজয়
পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার অর্থনীতি বাণিজ্য এবং শাসনের রূপ বদলে যায়। কামানের শব্দ থেমে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছিল এক নিঃশব্দ বিজয়। অর্থ-কড়ি, ধন-দৌলত কামানোর বিজয়। মুনাফার জয়জয়কার। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবল রাজনীতি নয়, রাজস্ব এবং রপ্তানির চালিকাশক্তিও নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তাদের সামনে প্রধান প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় বাংলার বিপুল আয় কীভাবে ইংল্যান্ডে পাঠানো কিংবা আরও ঠিকভাবে বললে 'পাচার' করা সম্ভব।
১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভ পলাশীতে জয় লাভের পর বাংলার রাজত্বের লাগাম হাতিয়ে নেয়। এদিকে ১৭৬৫ সালে বাংলা বিহার ও ওডিশার দেওয়ানি বা কর আদায়ের অধিকার পায় কোম্পানি। তখনো কেউ ভাবতে পারেনি যে এই জয় কেবল রাজনীতি বদলাবে না, বদলে দেবে পুরো অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা।
এদিকে লন্ডনে ধারণা জন্মায় কোম্পানির সামনে নতুন সোনালি সময়। এবার সোনার স্রোত, রুপার বন্যা বয়ে যাবে লন্ডনে। কিন্তু সোনা-রুপা ইউরোপে পাঠানো ছিল প্রায় অসম্ভব। বিল অব এক্সচেঞ্জ বা হুন্ডির কায়কারবারও জোরালো ছিল না। ফলে ওপথেও অর্থ-সম্পদ পাঠানো ততটা সহজ ছিল না। কোম্পানি এবারে মাথা খাটিয়ে একটি উপায় বের করল। রাজস্ব পাঠানোর বড় পথ হিসেবে বেছে নেয় রপ্তানি বাণিজ্যকে। বাংলার উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করেই রাজস্ব ইংল্যান্ডে পাঠানো হবে। অর্থাৎ পণ্যই হবে টাকার বাহন।
এভাবেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়, রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে রাজস্ব 'পাচার'। এই কৌশলে কোম্পানির ভাষায় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পণ্যসামগ্রী বা চয়েস্ট গুডস ছিল কাঁচা রেশম, কাঁচা তুলা, বস্ত্র এবং নীল। বাংলার উর্বর মাটি তখন এসব কিছু উৎপাদনের ভান্ডার।
দেওয়ানির নিয়ন্ত্রণ পেয়ে কোম্পানির হাতে আসে জমির ভাড়া এবং শুল্কের একচেটিয়া সুবিধা। পাশাপাশি জরিমানা ও সম্পদ জব্দ থেকে আয়ও হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা পেয়ে যায়। এভাবে কোম্পানির আর্থিক কাঠামো পাল্টে যায়। আগে এশিয়ায় পণ্য কেনার জন্য ইউরোপ থেকে সোনা-রুপা পাঠাত কোম্পানি। ১৭০৮ থেকে ১৭৬০ সালে এশিয়াগামী মোট রপ্তানি মূল্যের প্রায় ৭৫ শতাংশই ছিল সোনা-রুপা। ১৭৬২ থেকে ১৭৭২ দশকে এই অনুপাত গড়ে নেমে আসে ২৩ শতাংশে। অর্থাৎ এশিয়ায় কেনাকাটার অর্থের বড় অংশ আসতে থাকে বাংলার রাজস্ব এবং হুন্ডি থেকে। হিন্দুস্তানের প্রখ্যাত অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ওম প্রকাশ মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য, ঔপনিবেশিক হিন্দুস্তানের অর্থনীতি এবং ইউরোপ-এশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন।
এই অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদের ভাষায়, ১৭৬০ সালের পর ভারত ও চীনে বস্ত্র ক্রয়ের অর্থের জোগান দিয়েছে মূলত দেওয়ানি রাজস্ব এবং হুন্ডির অর্থ। হুন্ডি বা বিল অব এক্সচেঞ্জ মানে ভারতে রুপিতে পাওয়া রসিদ। এই রসিদের বিপরীতে লন্ডন বা অন্য কোথাও নগদ টাকা পরিশোধ করা হতো। কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মুনাফা ইউরোপে পাঠাত এই ব্যবস্থায়। ঠিক কতটা রপ্তানি ক্রয় সরাসরি বাংলার রাজস্বে চালানো হয়েছে, তা বের করা কঠিন। এই পরিমাণ যে উল্লেখযোগ্য ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এখানে একটি বড় পরিবর্তন হলো, বাংলার আঞ্চলিক রাজস্বকে রপ্তানি পণ্য ক্রয়ের কাজে লাগনো। তবুও কোম্পানিকে রপ্তানির লাভের ওপর নির্ভরশীল থাকতেই হলো। কারণ, দেওয়ানি খাতের আয়কে রাতারাতি নগদে অর্থে রূপান্তর করা যেত না। ইতিহাসবিদ হিউ বোয়েন দেখিয়েছেন, রাজস্ব উদ্বৃত্ত ব্রিটেনে পাঠানোর মৌলিক উপায় ছিল ইউরোপমুখী রপ্তানিকে বাড়ানো। ভারতীয় কারখানাগুলোকে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয় রপ্তানিযোগ্য পণ্য বেশি বেশি কিনতে। বিশেষ করে কাঁচা রেশম, নীল ও বস্ত্র। যুক্তি ছিল, এভাবে পরিস্থিতি মোতাবেক বেশি পরিমাণে টাকাকড়িও বাংলার রাজস্ব থেকে কোম্পানি হাতিয়ে নিতে পারবে।
বোয়েন আরও বলেন, ১৭৬৫ সালের পর কোম্পানিকে আর্থিক দিক থেকে খুবই হিসাব করে চলতে হচ্ছিল। এদিকে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বাড়ায় দায়ও বাড়ছিল। বাড়ছিল হোম বন্ড ঋণের সুদ। ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস এবং বোর্ড অব কন্ট্রোলের ব্যয়। ইংল্যান্ডের রাজকীয় সৈন্য এবং প্রতিষ্ঠানের খরচ। ব্রিটিশ সরকারের শুল্ক। এসব আর্থিক দায় কোম্পানিকে এশিয়া-ইউরোপে রপ্তানি বাড়াতে বাধ্য করে।
১৭৭২ সালে এই টালমাটাল ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। ১৭৫৭ থেকে কোম্পানি বছরে চার লক্ষ পাউন্ড সরকারকে দেয়। পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের উচ্চ লভ্যাংশও দেয়। ধরে নেওয়া হয়েছিল, ভারতীয় রাজস্ব হয়তো কোম্পানির ব্যয়কে ছাড়িয়ে যাবে। এই হিসাব-কিতাব ছিল অতিমাত্রায় আশাবাদী।
এদিকে কোম্পানির ভাগ্যে নানা অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় ঘনিয়ে আসে। ইতিহাসবিদ লুসি এস সাদারল্যান্ড দেখান, ফরাসি আগ্রাসনের ফলে সামরিক ব্যয় বেড়ে যায়। ১৭৬৯ থেকে ১৭৭০ বাংলার দুর্ভিক্ষের কারণে বাণিজ্য মন্দা গভীরতর হয়। পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যয়ও বাড়ে। রাজস্ব আদায়ের ব্যয়, সেনা এবং নৌবাহিনীর খরচ, বিচার বিভাগ ও পুলিশ খাতে ব্যয়, জনকল্যাণ কাজ ভারতীয় বন্ড ঋণের সুদ–সব মিলিয়ে বেড়ে ওঠে ব্যয়ের পাহাড়। ১৭৭১ সালে কোম্পানির কর্মীরা লন্ডনে এক মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি বিল অব এক্সচেঞ্জ তোলে। একই বছরে চা-বাণিজ্যে ক্ষতি হয় আরও এক মিলিয়ন পাউন্ড। ঋণ সংকটের পড়ে কোম্পানি স্বল্পমেয়াদি দায় মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
সমাধানের পথ হিসেবে কোম্পানি বাংলায় খরচ কমাতে এবং পছন্দের পণ্যসামগ্রীতে বিনিয়োগ বাড়াতে বলে। কোম্পানির ধারণা ছিল, অবস্থা যতই অপ্রীতিকর হোক, ভবিষ্যৎ জোগান নিশ্চিত করতে হলে ভারতে বেসামরিক ও সামরিক খরচ কমাতে হবে। ইউরোপের বাজারোপযোগী বস্ত্রে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। কাঁচা রেশমে যতটা সম্ভব বড় অঙ্কের লাভ তুলতে হবে। কোম্পানির প্রধান প্রধান বিনিয়োগের খাত ছিল নীল, কাঁচা তুলা, বস্ত্র এবং কাঁচা রেশম। প্রতিটির পণ্যের সুনির্দিষ্ট বাজার ছিল।
১৭৮০ দশকে দক্ষিণ ক্যারোলিনার উপনিবেশ হারানোয় এবং ১৭৯১ সালে সেন্ট ডোমিঙ্গোর দাসবিদ্রোহের যোগফলে নীলের সরবরাহ ভেঙে পড়ে। তুলাবস্ত্র ছিল আটলান্টিক ও আফ্রিকার বাজারে পুনঃরপ্তানিযোগ্য প্রধান পণ্য। চীনের চা কিনতে কাঁচা তুলা ও আফিমকে ব্যবহার করা হতো। চীনের সঙ্গে কোম্পানির বাণিজ্য বাড়ে। এই বাণিজ্য কোম্পানির লাভের প্রধান উৎসও হয়ে ওঠে।
কোম্পানির লক্ষ্য ছিল সব পণ্যের মান আন্তর্জাতিক চাহিদার পর্যায় নিয়ে যাওয়া। বোয়েনের কথায়, মানুষজন কিনতে চায় না, ব্রিটেনে এমন পণ্য আনার কোনো মানে নেই।
এই মানোন্নয়নের সবচেয়ে গভীর প্রয়াস চালানো হয় রেশমশিল্পে। বাংলায় কাঁচা রেশম উৎপাদন করে কোম্পানির বরাবরই মোটা অঙ্কের লাভের উচ্চ আশা করেছে। প্রাক্তন কর্মী জর্জ উইলিয়ামসন বলেন, দেওয়ানি হাতে আসায় উদ্বৃত্ত রাজস্ব ঘরে তুলতে এবং রেশমে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহী হয়ে ওঠে কোম্পানি। নতুন রিলিং বা সুতো কাটার পদ্ধতি রেশমের মান বাড়াবে। ব্রিটেনে দাম ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে–এমনই হিসাব কষা হচ্ছিল। পিয়েডমন্ট অঞ্চলের ইতালীয় রিলিং বা রেশমি সুতা কাটার পদ্ধতির জন্য বিখ্যাত ছিল। এই খ্যাতি কোম্পানির লাভের প্রত্যাশাকে উসকে দেয়। পিয়েডমন্টিজ রেশম তখন ছিল ইউরোপের সবচেয়ে দামি কাঁচা রেশম। চাহিদার দিক থেকে বাজারেও এই রেশম তখন শীর্ষেই ছিল।
রেশমকে চয়েস্ট গুডস ভাবার পেছনে বিশাল হিসাব-নিকাশ করা হয়েছিল। রেশমের পরিবহন ব্যয় ছিল খুব কম। পণ্য বেচার দামের তুলনায় পরিবহন ব্যয় রেশমের ক্ষেত্রে ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সে সময় ওজনের হিসাবে সবচেয়ে লাভজনক পণ্য ছিল রেশম। বিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী হিন্দুস্তানি অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ কে এন চৌধুরী বা কৃষ্ণনন্দ চৌধুরীর গবেষণায় উঠে এসেছে বিশেষত ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস এবং প্রাক্-ঔপনিবেশিক এশিয়ার অর্থনীতির বিষয়াদি।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ হিসেবেও পরিচিত তিনি। তার বক্তব্য অনুসারে, ইউরোপীয় আধিপত্যের আগেও এশিয়ার নিজস্ব একটি বিশাল, স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জগৎ ছিল। তার যুক্তি, এশিয়ার বাণিজ্য ও সভ্যতা ছিল এক 'বিশ্বব্যবস্থা' বা 'ওয়ার্ল্ড সিস্টেম', যেখানে ভারত মহাসাগর ছিল কেন্দ্রবিন্দু।
এন চৌধুরীর তথ্য অনুযায়ী, ১৭৫০ দশকে বাংলার রপ্তানিতে রেশমের অংশ ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। তুলাবস্ত্রের পর দ্বিতীয় স্থানে ছিল রেশম। রেশমশিল্প সরকারের সুরক্ষানীতি পেয়েছে। ব্রিটেনে রেশমশিল্পের কাঁচামালের ঘাটতি ছিল এবং ফরাসি উৎপাদন ছিল শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই ব্রিটিশ নীতিতে রেশমবস্ত্রের আমদানিকে নানা বাধানিষেধের মধ্যে বন্দী করে রাখে। আমদানি করা রেশমবস্ত্রে বেশি বেশি হারে শুল্ক বসানো হয়। কাঁচা রেশমে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়। দেশীয় রেশমবস্ত্র রপ্তানিতে উৎসাহ জোগানোর মতো তৎপরতা কার্যকর করা হয়।
১৭৫০ থেকে ১৭৬৫ এবং ১৮০১ থেকে ১৮২৩—এই দুই সময়ে বাংলার কাঁচা রেশমে শুল্ক চীনা বা ইতালীয় রেশমের চেয়ে কম রাখা হয়। একই সময় আন্তএশীয় বা দেশীয় বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছিল। ইউরোপে পাঠানোর জন্য পণ্য কিনতে সোনা-রুপা আমদানি করা থেকে বিরত থাকে কোম্পানি। তার বদলে এক এশীয় বাজারের পণ্য দিয়ে অন্য বাজারের চাহিদা মেটানোর পথ ধরে।
সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ, ভারত থেকে আফিম ও কাঁচা তুলা চীনে পাঠিয়ে তার বদলে চা আনা হচ্ছিল। বাংলার রেশমও এই বাণিজ্যে ব্যবহার হতো, উদ্দেশ্য ছিল বাংলার জন্য কাঁচা তুলার জোগান দেওয়া।
কিন্তু কেবল জোগান বাড়ানোই যথেষ্ট ছিল না। ১৮ শতকের শেষ দিকে বাংলায় এবং পরে বোম্বে অঞ্চলে কোম্পানির বাণিজ্য তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালনকারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম কর্মকর্তা জেমস উইস ১৭৭৮ সালে লন্ডনে জানান, তিন বছর আগে চীনা রেশম বোম্বের বাজারে ঢোকার পর থেকে বাংলার রেশম মান খারাপ এবং সুতার লাটিম করা কঠিন হয়ে যায়। তাই বাজারও হারাতে থাকে। তিনি চীনে বোম্বের রেশম পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তার যুক্তি, ইতালীয় পদ্ধতিতে প্যাঁচানো হলে বাংলার রেশম বোম্বেতেই বাজার পাবে। তাই মানোন্নয়ন কোম্পানির আন্তএশীয় বাণিজ্যের জন্য জরুরি হয়ে ওঠে। এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন বাংলা থেকে কাঁচা রেশমের মোট রপ্তানি মূল্য এবং ব্রিটেনে পাঠানো বাংলার রেশমের মূল্যের মধ্যে তুলনা করা হয়।
১৭৭০ দশক থেকে ১৮১০ দশকের বাণিজ্যের তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। কোম্পানির হিসাব বলছে, ১৭৯৩ থেকে ১৮১২ ইউরোপে ভারতীয় ও চীনা পণ্যের মোট বিক্রির গড়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হলো কাঁচা রেশম। বাংলার রেশমের ক্ষেত্রে কোম্পানির কাছে ১৭৯৩ থেকে ১৮০৭ পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যায়। দেখা যায়, এই পণ্য বিক্রির গড়ে ৪ দশমিক ৭ শতাংশই হলো রেশম। এই অনুপাত কম মনে হতে পার। পাশাপাশি বুঝতে হবে, একই সময়ে চা হয়ে ওঠে প্রধান বাণিজ্য পণ্য।
ভারতীয় রাজস্ব পাঠানোর বড় মাধ্যম। চায়ের চাহিদা বাড়ার কারণ দুটি। ব্রিটেনে চায়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং ১৭৮৪ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে চায়ের আমদানি শুল্ক ১১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১২ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসা। একই সাথে ইউরোপের অন্যান্য অংশ এবং আটলান্টিক বিশ্বেও চায়ের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে চা বিক্রির হার ৫০ শতাংশ পার হয়ে যায়। তারপরও অন্যান্য পণ্যের তুলনায় রেশমের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যই থাকে। লন্ডন বাজারে কাঁচা রেশম ছিল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য। ১৭৯৯ থেকে ১৮০৬ সাল পর্যন্ত লন্ডনে আমদানি করা কাঁচা রেশমের মূল্যের ৮১ শতাংশই এসেছে বাংলার রেশম থেকে।
রেশম ছাড়াও কোম্পানি আরও কিছু পণ্য নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সরাসরি উৎপাদনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। এগুলো হলো আফিম, চিনি, নীল ও কফি। কিন্তু নতুন নতুন এই পণ্য নিয়ে কোম্পানির বেশির ভাগ পরীক্ষাই লন্ডনের বাজারে বিক্রির জোয়ার ডেকে আনেনি।
এ ক্ষেত্রে কোম্পানি সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বণিকেরা চিনি, নীল কফির মতো নতুন পণ্যের বেলায় কোম্পানির চেয়েও সফল হয়। তবে কাঁচা রেশমের ক্ষেত্রে বণিকেরা ব্যক্তিগতভাবে সফল হতে পারেনি। রেশমের ক্ষেত্রে কোম্পানির প্রশাসনিক জোর ও বিনিয়োগ ছিল গভীরতর।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমশিল্পের প্রতি টানের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিঃসন্দেহে মুনাফা অর্জন। কিন্তু এর ভেতরে ছিল মারকেন্টিলিজম নামের আরও গভীর অর্থনৈতিক দর্শন। মারকেন্টিলিজম এমন এক অর্থনীতির কথা বলে, যেখানে বাণিজ্যের ভারসাম্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের শক্তি ও সম্পদ পরিমাপ করা হয়।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে মারকেন্টিলিজম ছিল 'জাতীয় সম্পদ ও শক্তি বৃদ্ধির বাস্তব নীতি'। এই নীতির মূল তিনটি দিক হলো, দেশ থেকে সোনা-রুপা বেরিয়ে যাওয়া রোধ করা, ইতিবাচক বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা আর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা।
সেকালের অর্থনৈতিক চিন্তাবিদেরা বারবার বলতেন, 'দেশীয় উৎপাদন বাড়াও, আমদানি কমাও।' তাদের মতে, কাঁচামাল বিদেশ থেকে এনে দেশের শিল্পকে সচল রাখতে হবে। কিন্তু তৈরি পণ্য বাইর থেকে না এনে নিজেকেই বানাতে হবে। তাই উপনিবেশগুলোকে কাঁচামালের ভান্ডার হিসেবে দেখা হয়েছিল।
সমকালীন পুস্তিকা এবং চুক্তিগুলোতে বারবার উঠে আসে কীভাবে বাণিজ্য বাড়ানো যাবে, বাণিজ্যের ভারসাম্য উন্নত করতে হবে এবং উৎপাদন ও গরিবের কাজ বাড়বে। কতটা সুরক্ষা দরকার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমিকা কী হবে–এসব নিয়ে মতভেদ ছিল। তারপরও রেশমশিল্প নিয়ে মতৈক্য ছিল। পুরোপুরি প্রস্তুত রেশমবস্ত্রকে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা বা ভারী শুল্ক দিয়ে সুরক্ষা দিতে হবে, আর কাঁচা রেশম আনতে হবে উপনিবেশ থেকে, ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ থেকে নয়। অতএব বাংলার রেশম আমদানির পরিকল্পনা সমর্থন পায়। সমসাময়িক লেখক জে থর্প পর্যন্ত বলেন, কোম্পানি বাংলার রেশমের মানোন্নয়নে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে না; এ ক্ষেত্রে আরও জোর দিতে হবে।
রেশমশিল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। ব্রিটিশ লেখকেরা বলতেন, তৈরি রেশম কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি নয়, বরং উপনিবেশ থেকে কাঁচা রেশম আনো। সেই রেশম দিয়েই দেশীয় মানে ব্রিটেনের তাঁতশিল্প চালাও। কোম্পানিও এই নীতি অনুসরণ করে বাংলায় রেশম উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ায়।
কোম্পানির ১৭৭০ ও ৮০-এর দশকের চিঠিপত্রে দেখা যায়, তারা কীভাবে ইতালীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চেয়েছিল। তারা মনে করত, 'বাংলা ইতালীয় রেশম' তৈরি হলে লাভ হবে দ্বিগুণ। এতে একদিকে ইউরোপে চাহিদা বাড়বে, অন্যদিকে ব্রিটিশ তাঁতশিল্প বিদেশি রেশমের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারবে।
১৭৭২ সালের আর্থিক দুরবস্থাতেও কর্মীদের বলা হয় কাঁচা রেশমে বিনিয়োগ চালিয়ে যেতে। লন্ডন থেকে বাংলার প্রশাসকদের কাছে লেখা এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, 'রেশম এমন এক পণ্য, যা আমদানি করা হলে ব্রিটেন এবং কোম্পানি–দুই পক্ষেরই মঙ্গল বয়ে আনে। তাই তোমরা সর্বোচ্চ মনোযোগ দেবে এর উৎপাদন বাড়াতে ও মানোন্নয়নে।'
তাদের নির্দেশ ছিল, আরও বেশি পরিমাণে তুঁতগাছ লাগানো হোক। এতে রেশম পোকার খাদ্য সহজে পাওয়া যাবে। কোম্পানি বিশ্বাস করত, রেশমশিল্প কেবল রাজস্বই দেবে না, বাংলার কৃষক ও শ্রমিকদেরও কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এ হলো মারকেন্টিলিস্ট চিন্তাধারা মূল লক্ষ্যগুলোর অন্যতম।
১৭৭০ এবং ১৭৮০ দশকের চিঠিপত্রে দেখা যায়, ইতালীয় রিলিং পদ্ধতি বাস্তবায়নে তাদের প্রবল প্রতিশ্রুতি। কোম্পানির নথিপত্র থেকে জানা যায়, কোম্পানি এই পদ্ধতির সফলতায় এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্ভাব্য মোটা লাভ করবে বলে বিশ্বাস করত। কাঁচা রেশমকে তারা মূল্যবান বাণিজ্য পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। আশা ছিল, বাংলা রেশম ইতালীয় রেশমের মতোই নগদ লাভের স্রোত বইয়ে দেবে।
কোম্পানির নজর ছিল সর্বদা মুনাফার দিকে। যখন দেখা গেল রেশম উৎপাদন থেকে প্রত্যাশিত লাভ আসছে না, যেমন ১৭৯০-এর দশকে ব্রিটিশ বাজারে রেশমের মজুত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন কোম্পানি বিনিয়োগ কমিয়ে খরচ উশুল করার পথে ধরে।
কোম্পানি রেশম বাণিজ্য থেকে তখনো পুরোপুরি সরে যায়নি। ১৭৮৫ সালের পর নতুন প্রযুক্তি স্থানান্তরের প্রকল্প না নিলেও বিনিয়োগ চালিয়ে যায় এবং কয়েকটি উদ্ভাবন কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৮৩০-এর দশক পর্যন্ত কোম্পানি নিজের রেশম প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোয় উৎপাদন অব্যাহত রাখে। পরে ১৮৩৩ সালে আইনের মাধ্যমে কোম্পানির বাণিজ্যিক অধিকার বাতিল হলে এসব কারখানা বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়।
কোম্পানির নথিতে লেখা আছে, এই শিল্পকে বর্তমান মানে পৌঁছাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে; তাই ক্ষতি পুষিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত এর কাজ বন্ধ করা অসম্ভব। অর্থাৎ বিনিয়োগের খরচই তাদের এই শিল্পে আরও বহু বছর ধরে টিকে থাকতে বাধ্য করেছিল।
অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটেনে রেশম বয়ন ছিল এক কৌশলগত শিল্প। কিন্তু জলবায়ু এই শিল্পে ব্রিটেনকে আত্মনির্ভর হতে দেয়নি। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বঙ্গরেশম উদ্যোগ ছিল একদিকে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, অপর দিকে এটা ছিল সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির বাস্তব প্রয়োগ।
কোম্পানির এই উদ্যোগকে টেকসই করেছিল পাঁচটি কারণ–প্রথমত, বঙ্গরেশমের আমদানিতে শুল্ক ছিল খুব কম; দ্বিতীয়ত, ১৭৫০ ও ৬০-এর দশকে কাঁচা রেশম ছিল ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা কাঁচামাল; তৃতীয়ত, বাংলার রেশম ছিল কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বাধিক রপ্তানি পণ্য; চতুর্থত, পরিবহন ব্যয় বাদ দিলে লাভের অনুপাত ছিল সবচেয়ে বেশি; আর পঞ্চমত, এই রেশম ব্যবহার করা হতো ভারতীয় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও, যেখানে এর বিনিময়ে তুলা ও অন্যান্য পণ্য আনা হতো।
সব মিলিয়ে কোম্পানির কাছে রেশম ছিল এক সোনার সুতা। এই সুতায় ঔপনিবেশিক ব্রিটেন একসঙ্গে বুনেছিল রাজস্ব, বাণিজ্য, সাম্রাজ্য আর শ্রম নিয়ন্ত্রণের গল্প।
পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে আর্থিক সংকটের উত্থান-পতন পেরিয়েও রেশম বেনিয়া ব্রিটিশদের বিনিয়োগের তালিকার শীর্ষে রয়ে যায়। এই পথেই বাংলার রাজস্ব ইউরোপমুখী রপ্তানির স্রোতে মিশে ব্রিটিশ অর্থনীতির কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছায়। বাংলার সুতার গায়ে গায়ে জড়িয়ে থাকে ঔপনিবেশিক আর্থিক নীতির সব সূক্ষ্ম জটিলতা।
মারকেন্টিলিজমের ভাষায়, 'এটা ছিল জাতীয় মুনাফার জন্য বাণিজ্যের প্রসার।' কিন্তু বাংলার মাটি জানত, এই লাভের পেছনে লুকিয়ে আছে কত পরিশ্রম, কত ক্ষুধা, কত অদেখা কোকুনের অশ্রু।
অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ওম প্রকাশ দেখিয়েছিলেন, ১৭৬৫ সালের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পণ্য কেনার জন্য ইউরোপ থেকে আর রুপা পাঠানোর প্রয়োজন পড়েনি; তারা সেই অর্থ পেয়েছিল বাংলার দিওয়ানি রাজস্ব থেকেই।
অর্থাৎ, তার গবেষণাই প্রমাণ দেয় যে বাংলার রাজস্বব্যবস্থাই হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বাণিজ্য ও সাম্রাজ্য বিস্তারের আর্থিক মেরুদণ্ড। আর এই মেরুদণ্ডের অন্যতম উপাদান ছিল বাংলার রেশম।
রেশম তাই কেবল একটি কাপড়ের নাম নয়, এটি ছিল ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সবচেয়ে সূক্ষ্ম, কিন্তু সবচেয়ে দৃঢ় জাল। এর মধ্যে আটকে গিয়েছিল একসময়ের সমৃদ্ধ বাংলার অর্থনীতি।