বাংলার রেশম: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে বিপুল মুনাফায় নিয়ে যায় রেশম উৎপাদন
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে, ঐতিহ্য ও রূপান্তরের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল বাংলা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই উর্বর বদ্বীপ অঞ্চলটি বস্ত্রশিল্পের উৎকর্ষের প্রতীক ছিল; ঢাকার মসলিন ও মুর্শিদাবাদের রেশম এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত অভিজাত ও রাজপরিবারের পোশাকে স্থান পেত। কিন্তু ১৭৫০-এর দশকে এসে বাংলার রেশমশিল্প প্রবেশ করল এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের যুগে; যে পরিবর্তনের চালিকাশক্তি দেশীয় তাঁতি বা ব্যবসায়ীরা ছিল না, বরং ছিল ঔপনিবেশিক শক্তি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
এই রূপান্তর শুধু বাংলার রেশম অর্থনীতিকেই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্যবসায়ের মুনাফা, শ্রম ও ব্যয়ের ধারণাকেও। এ ছিল এক অর্থনৈতিক স্থানান্তরের পাঠ, যেখানে এক অঞ্চলের প্রযুক্তি, পুঁজি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার পেছনে ছিল ক্ষমতার অসম সম্পর্ক।
এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তিনটি জটিলভাবে জড়িয়ে থাকা সুতোর মতো উপাদান–কাঁচামালের দাম, উৎপাদন খরচ এবং স্থানান্তরের কার্যকারিতা। এই তিনটি দিক একসঙ্গে বুঝিয়ে দেয় কীভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তক্ষেপ রেশমকে স্থানীয় হস্তশিল্প থেকে টেনে নিয়ে গেল বৈশ্বিক বাণিজ্যের অগ্রভাগে, যেখানে ইউরোপীয় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা মিলেছিল বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ ও শ্রমের সুবিধার সঙ্গে, গড়ে উঠেছিল এক নতুন ধরনের আধা শিল্পায়িত অর্থনৈতিক কাঠামো।
রেশমের দাম ও উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলার বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়, তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল রেশমের জোগান স্থিতিশীল করা ও তা সম্প্রসারিত করা; কারণ, রেশম ছিল বৈশ্বিক বাজারে এক উচ্চমূল্যের পণ্য। ইউরোপে বাংলার রেশম, যার দীপ্তি ও কোমলতার জন্য সে সময় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল, তার চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু স্থানীয় উৎপাদনব্যবস্থাটি ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ছোট ছোট রেশম সুতো কাটার কারিগর ও তাঁতিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতেন এবং প্রায়ই তাদের পণ্য একাধিক মধ্যস্বত্বভোগী বা পাইকারদের কাছে বিক্রি করতেন। এই অগোছালো ব্যবস্থাকে একক, কেন্দ্রীভূত কাঠামোর আওতায় আনতে চেয়েছিল কোম্পানি।
এ উদ্দেশ্যে তারা চালু করে 'ফিলেচার ব্যবস্থা'–একধরনের কারখানার মতো উৎপাদনপ্রক্রিয়া, যেখানে ইউরোপীয় তত্ত্বাবধানে কাঁচা রেশম কাটা হতো। 'ফিলেচার' শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ ফিলার থেকে, যার অর্থ 'সুতা কাটা'। দেশীয় ঘরে ব্যবহৃত সাধারণ চরকার বিপরীতে, ফিলেচার ইউনিটে ব্যবহার করা হতো উন্নতমানের রিলিং বেসিন, মানসম্মত প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষিত তদারককারীরা কাজ করতেন সেখানে। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদদের ভাষায়, এটি ছিল 'ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন'-এর এক প্রাথমিক উদাহরণ, যেখানে উৎপাদনের একাধিক ধাপকে একক কর্তৃত্বের অধীনে আনা হয়।
কিন্তু এই প্রযুক্তিগত ও সাংগঠনিক পরিবর্তন অর্থহীন হয়ে পড়ত, যদি উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানÑকাঁচামালের দাম কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে না থাকত। এখানে 'ইনপুট' বলতে বোঝানো হয়েছে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ–কোকুন/রেশম গুঁটি (রেশমের কাঁচামাল), শ্রম (বিশেষত সুতা কাটার শ্রমিক) এবং জ্বালানি (রেশম সেদ্ধ করার জন্য পানির তাপ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঠ)।
বাংলায় এসে কোম্পানি পেয়েছিল একদম খরচসাশ্রয়ী অর্থনৈতিক পরিবেশ। শ্রম ছিল সস্তা, কোকুন ছিল প্রচুর আর কাঁচামাল মিলত স্থানীয়ভাবে। তুলনা করলে দেখা যায়, ইউরোপের প্রধান রেশম উৎপাদন অঞ্চল ইতালির পিয়েমন্তের সঙ্গে বাংলার ব্যবধান ছিল অবিশ্বাস্য।
১৭৮৬ সালে বাংলায় এক পাউন্ড ফিলেচার রেশম উৎপাদনে খরচ হতো মাত্র ৭ শিলিং, যেখানে পিয়েমন্তে একই পরিমাণ রেশম তৈরি করতে খরচ পড়ত তিন গুণ বেশি। এই বিশাল পার্থক্যের মূল কারণ ছিল কোকুনের দাম, যা বাংলায় মোট উৎপাদন খরচের প্রায় ৮৫.৭ শতাংশ জুড়ে ছিল। পিয়েমন্তে কোকুনের দাম ছিল বাংলার তুলনায় প্রায় তিন গুণ, প্রতি পাউন্ডে ১৩ পেনি, যেখানে বাংলায় ছিল মাত্র ৪ পেনি।
শ্রম খরচেও ছিল বিশাল ফারাক—বাংলার একজন সুতা কাটার শ্রমিক দিনে পেতেন ৩ পেনি, আর পিয়েমন্তে একই কাজের জন্য মজুরি ছিল ৯ পেনি।
এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে 'ফ্যাক্টর এনডাওমেন্ট' ধারণাটি, অর্থাৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ যেমন শ্রম, জমি ও পুঁজির প্রাপ্যতা। বাংলায় সস্তা শ্রমশক্তি ও প্রচুর কাঁচামালের সহজলভ্যতা রেশম উৎপাদনে এক বিশেষ তুলনামূলক সুবিধা তৈরি করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাফল্যের মূল রহস্য লুকিয়ে ছিল এই প্রাকৃতিক সম্পদকে সংগঠিত পদ্ধতিতে কাজে লাগানোয়, শুধু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে নয়।
খরচের বিশ্লেষণ: ফিলেচারের অর্থনীতি
ঔপনিবেশিক বাংলায় রেশম উৎপাদনের খরচ বোঝার জন্য আমাদের জানতে হয় অর্থনীতির ভাষায়, যাকে বলে 'কস্ট স্ট্রাকচার'–অর্থাৎ মোট ব্যয়ের কোন অংশ কোন উপাদানের পেছনে যাচ্ছে।
১৭৮৬ সালে এক পাউন্ড (ছোট মাপের) ফিলেচার রেশম উৎপাদনের খরচের কাঠামো ছিল প্রায় এ রকম—
কোকুন: ৬ শিলিং (৮৫.৭%)
শ্রমিকদের মজুরি: ৬.৮ পেনি (৮.১%)
জ্বালানি কাঠ: ৩.৭ পেনি (৪.৪%)
অন্যান্য ছোটখাটো খরচ: ১.৫ পেনি (১.৮%)
মোট খরচ: ৭ শিলিং
এর সঙ্গে কোম্পানি যোগ করেছিল কাস্টমস, পরিবহন ও বাণিজ্য খরচ; যার পরিমাণ ছিল আরও ৪ শিলিং ২ পেনি, ফলে এক পাউন্ড রেশম উৎপাদনের মোট খরচ দাঁড়ায় ১১ শিলিং ২ পেনি।
তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ইতালির পিয়েমন্তে রেশমশিল্পে শ্রমিকদের মজুরি ও কাঁচামালের খরচ–দুই দিকেই চাপ ছিল অনেক বেশি। কোকুনের উচ্চমূল্য কেবল আবহাওয়া ও জীববৈচিত্র্যের পার্থক্যের ফল ছিল না, বরং ইউরোপের গ্রামীণ অর্থনীতির আরও বাণিজ্যিক ও প্রতিযোগিতামূলক চরিত্রেরও প্রতিফলন ছিল।
ঔপনিবেশিক বাংলায় উৎপাদন ব্যয়ের এই সুবিধা মূলত নির্ভর করেছিল মজুরির পার্থক্য এবং সম্পদমূল্যের অসমতার ওপর। বাংলার শ্রমবাজার ছিল জীবনধারণভিত্তিক অর্থনীতির অংশ; এখানে মজুরি নির্ধারিত হতো খাদ্যের দামের সঙ্গে তুলনায়, শিল্পের মানদণ্ড অনুযায়ী নয়। প্রচুর তুঁতগাছের বাগান ও রেশম কীট চাষের (সেরিকালচার) প্রচলনের ফলে কোকুনের জোগান ছিল স্থিতিশীল, যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ–যেমন বন্যা, দুর্ভিক্ষ বা মারাঠা আক্রমণের মতো ঘটনার কারণে তা মাঝে মাঝে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত।
সে সময় কলকাতাভিত্তিক কোম্পানির অর্থনীতিবিদেরা এই সমীকরণটি খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। উৎপাদন খরচ কম রাখতে তারা চালু করেন চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা, যেখানে কোকুনের দাম আগেই নির্ধারণ করে দেওয়া হতো। এতে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতেন কৃষকেরা; কারণ, তাদের হাতে ছিল না দর-কষাকষির তেমন ক্ষমতা।
এই ব্যবস্থায় কৃষকেরা প্রায়ই পড়তেন বিপাকে; কারণ, কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের সামনে তাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা ছিল সামান্যই। তবে শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই পদ্ধতি ছিল কার্যকর, কারণ আগেভাগে নির্ধারিত দাম মানেই ছিল নির্দিষ্ট মুনাফা।
বাংলাকে বৈশ্বিক বাজারে টেনে আনা
১৭৮০-এর দশকে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এমন এক মডেল তৈরি করেছিল, যেখানে খরচ নিয়ন্ত্রণ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা–দুই দিকই নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাজারদরে রেশম কিনতে গিয়ে যেখানে প্রতি পাউন্ডে গড়ে ৯ শিলিং ১০ পেনি খরচ পড়ত, সেখানে কোম্পানি নিজস্ব ফিলেচার ইউনিটে রেশম উৎপাদন করত মাত্র ৭ শিলিংয়ে; অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ খরচ সাশ্রয়।
বাজার থেকে পণ্য কেনার পরিবর্তে সরাসরি উৎপাদনে যাওয়া, এই পরিবর্তনটিই অর্থনীতির ভাষায় পরিচিত 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রান্সফার' হিসেবে, অর্থাৎ শিল্পপ্রক্রিয়া, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা কৌশল এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর করা। তবে বাংলার ক্ষেত্রে এই স্থানান্তরটি ছিল স্বাভাবিক নয়, বরং ঔপনিবেশিক একটি ব্যবস্থা, যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নিয়ন্ত্রিত ছিল ইউরোপীয় তত্ত্বাবধানে, আর যার মূল লক্ষ্য ছিল স্থানীয় সম্পদ থেকে সর্বাধিক উদ্বৃত্ত (surplus) আহরণ।
১৭৮৬ থেকে ১৮০৩ সালের মধ্যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশম উৎপাদন চমকপ্রদ ফলাফল দেখিয়েছিল:
মূল খরচ : ৪৭ লাখ ৭৯ হাজার ২৬৮ পাউন্ড
শুদ্ধ মুনাফা : ৬ লাখ ১৬ হাজার ৭৮১ পাউন্ড
এটি প্রায় ১২.৯% লাভের মার্জিন নির্দেশ করে, যা ওই সময়ের জন্য এক বিশাল সংখ্যা।
আগের পর্যায়ে (১৭৭২-৭৯), কোম্পানির অভ্যন্তরীণ রিটার্নের হার, যা সময়ের সঙ্গে লাভের পরিমাপ ছিল প্রায় ৫৫%।
এই মুনাফার পরিসর দেখায়, কোম্পানি কত দক্ষভাবে ফ্যাক্টর খরচের পার্থক্য থেকে লাভকে অভ্যন্তরীণকরণ করতে পেরেছিল। যা একসময় ছিল স্থানীয় হস্তশিল্প, তা পরিণত হলো একটি বৈশ্বিক রপ্তানি পণ্য, যা যুক্তরাজ্যের শিল্পধর্মী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উঠেছিল।
তবে কীভাবে এমন মুনাফা অর্জিত হয়েছিল, তা বোঝার জন্য কেবল সংখ্যার দিকে তাকানো যথেষ্ট নয়; দেখতে হবে ঔপনিবেশিক উৎপাদনের অর্থনৈতিক ব্যাকরণ। এই রূপান্তরের পেছনে কয়েকটি প্রযুক্তিগত ধারণা কাজ করেছিল:
১. ফ্যাক্টর এনডাওমেন্ট : কোনো অঞ্চলের প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের প্রাপ্যতা বোঝায়। বাংলার উর্বর মাটি তুঁত চাষের জন্য সহায়ক ছিল, আর তার ঘনবসতি গ্রামীণ জনসংখ্যা প্রচুর শ্রম সরবরাহ করেছিল।
২. তুলনামূলক সুবিধা : ডেভিড রিকার্ডো ১৮১৭ সালে এই নীতি প্রবর্তন করেছিলেন, যদিও বাংলার রেশম কেস তার চেয়ে আগে, তবুও এটি প্রযোজ্য–বাংলা রেশম উৎপাদনে ইউরোপের তুলনায় বেশি দক্ষ ছিল (কম সুযোগ ব্যয়ের বিনিময়ে)।
কৃষক, পাইকার ও ক্রয়ের রাজনীতি
যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যালান্স শিট মুনাফায় উজ্জ্বল ছিল, বাস্তবে মাঠের পরিস্থিতি ছিল অনেক জটিল। কোকুনের দামের ওপর কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে নির্ভর করেছিল পাইকারদের ওপর; স্থানীয় এজেন্ট যারা রেশম কীটচাষিদের কাছ থেকে কোকুন সংগ্রহ করতেন। প্রায়ই এই পাইকারেরা চাষিদের ঋণও দিতেন, ফলে চাষিরা ভবিষ্যতের ডেলিভারির জন্য নির্ধারিত দামে কোকুন বিক্রির বাধ্যতায় আবদ্ধ থাকতেন।
তাত্ত্বিকভাবে এটি স্থিতিশীল সরবরাহ শৃঙ্খল নিশ্চিত করত। কিন্তু বাস্তবে, এটি শোষণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করত। কৃষকেরা প্রায়ই কোকুন বিক্রি করতে বাধ্য হতেন কৃত্রিমভাবে কম দামে, ভালো মূল্য দর-কষাকষি করার সুযোগও পাননি। দুর্ভিক্ষ এবং হামলা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছিল, কারণ, ঋণগ্রস্ত চাষিদের কাছে ফসলের ক্ষতি বা বাজারের ওঠানামার বিরুদ্ধে কোনো নিরাপত্তা ছিল না।
কোম্পানির খরচ হ্রাসে মনোযোগ ফ্যাক্টরদের কল্যাণের বিনিময়ে এসেছে, এখানে 'ফ্যাক্টর' বলতে বিশেষত মানবশ্রমের সুস্থতা বোঝানো হয়েছে। তবু অষ্টাদশ শতাব্দীর বাণিজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এমন বিষয়গুলো অর্থনৈতিক হিসাবের বাইরে ছিল।
এই কাঠামোগত অসাম্যই ইতিহাসবিদদের কাছে দেখায় কার্যকর স্থানান্তরের অন্ধকার দিক। ইউরোপ থেকে বাংলায় প্রযুক্তি ও সংগঠনিক কৌশল স্থানান্তর উৎপাদন ও মুনাফা বাড়িয়েছিল, কিন্তু সুবিধা বিতরণ হয়েছিল অসমভাবে। বাংলার মাটি ও শ্রম থেকে সৃষ্ট সম্পদ অবশ্যম্ভাবীভাবে লন্ডনের দিকে প্রবাহিত হয়েছিল।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বাংলার রেশমব্যবস্থাকে সাম্রাজ্যিক কাঠামোর অংশে পরিণত করেছিল।
গুণমান, পরিমাণ ও স্থানান্তরের সাফল্য
শোষণাত্মক প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও স্থানান্তর প্রযুক্তিগতভাবে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছিল একটা সময় পর্যন্ত। ফিলেচার তত্ত্বাবধানে বাংলার কাঁচা রেশমের গুণমান নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কোম্পানির কর্মকর্তারা লক্ষ করেছিলেন, রেশমের দঢ়তা, রং এবং সমতার মান এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পিয়েমন্তের রেশমকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ইউরোপীয় রিলিং পদ্ধতি, নিয়মিত তদারকি এবং মানসম্মত গ্রেডিংয়ের পরিচিতি বাংলার রেশমকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে রূপান্তরিত করেছিল। ১৭৯০-এর দশকের দিকে ব্রিটিশ প্রস্তুতকারকেরা মসৃণ কাপড় বোনার জন্য বাংলার রেশমকে পছন্দ করতেন, এমনকি চীনা রেশমের সঙ্গে মিশ্রিত করতেও।
অর্থনৈতিক ভাষায়, স্থানান্তরের কার্যকারিতা তিনটি সূচকের মাধ্যমে পরিমাপ করা যায়:
১. উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি: ফিলেচার ইউনিটে স্থানীয় সুতো কাটার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফলে প্রতি শ্রমিকের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
২. খরচের দক্ষতা: কেন্দ্রীকরণ অপচয় কমিয়েছে এবং প্রক্রিয়াগুলো মানসম্মত করেছে, ফলে গড় খরচ হ্রাস পেয়েছে।
৩. বাজার সংযুক্তি: কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলার রেশম সহজেই ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ করেছে, স্থানীয় উৎপাদনকে বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে যুক্ত করেছে।
তবে পেছনের সংযোগ (স্থানীয় সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পর্ক) এবং আগের সংযোগ (দেশীয় শিল্পে ব্যবহারের সুযোগ) না থাকায় বাংলার শিল্প পরিকাঠামো তুলনামূলকভাবে অগভীর ছিল। স্থানান্তর সফল ছিল রপ্তানিভিত্তিক বৃদ্ধির জন্য, স্থানীয় শিল্পায়নের জন্য নয়।
বাংলা থেকে ব্রিটেন স্থানান্তর
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বাংলার রেশমব্যবস্থাকে সাম্রাজ্যিক কাঠামোর অংশে পরিণত করেছিল। বাংলার রেশম রপ্তানির মুনাফা বিশেষ করে চায়ের আমদানি-সম্পর্কিত কোম্পানির চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে সহায়ক হয়েছিল।
রেশম তখন আর কেবল অভিজাত কাপড় ছিল না; এটি হয়ে উঠেছিল বৃহত্তর সাম্রাজ্যিক হিসাবের আর্থিক উপকরণ। তবু এই সংযুক্তি ছিল অত্যন্ত অসাম্যপূর্ণ। বাংলার রেশমের লাভ ব্রিটিশ সম্প্রসারণকে অর্থায়ন করেছিল, আর স্থানীয় রেশমচাষি ও কারিগরদের জীবনমানের উন্নয়নে প্রায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
পুঁজির স্থানান্তর–বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির থেকে ব্রিটেনের শিল্প কেন্দ্রে প্রতিফলিত হয় জ্ঞান স্থানান্তরের বিপরীত দিকেও। ফিলেচার ম্যানুয়াল, তদারকি প্রটোকল এবং ব্যবস্থাপনার কৌশল সবই ইউরোপ থেকে আনা হয়েছে। এর ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, ইতিহাসবিদেরা তাকে 'ঔপনিবেশিক দ্বৈত অর্থনীতি' বলে অভিহিত করেছেন: আধুনিক উৎপাদন কেন্দ্রগুলো প্রাচীন কৃষিকাঠামোর মাঝে বিদ্যমান।
সারসংক্ষেপে স্থানান্তরের কার্যকারিতা ছিল দুই ধারার–প্রযুক্তিগতভাবে সফল, কিন্তু সামাজিকভাবে পশ্চাদমুখী।
পতন ও ঐতিহ্য
১৮৩০-এর দিকে বাংলার রেশমশিল্প ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে। এর পেছনে একাধিক কারণ জড়িত, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক বাজারে দাম পড়া, সস্তা শ্রমের অভাব এবং পুনরাবৃত্ত দুর্ভিক্ষের বিধ্বংসী প্রভাব। কোম্পানির কঠোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণও উদ্ভাবনকে দমন করেছিল এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করেছিল।
তবুও তার স্বর্ণযুগে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক যুক্তি ঔপনিবেশিক শিল্পকে প্রভাবিত করতে থাকল। কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণ, খরচ হ্রাস এবং রপ্তানিকেন্দ্রিক মনোভাব–এই প্রবণতাগুলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের ভারতীয় সংস্করণকে চিহ্নিত করেছে।
আধুনিক অর্থনীতিবিদেরা এটিকে একটি প্রাথমিক গ্লোবাল ভ্যালু চেইন ইন্টিগ্রেশনের রূপ হিসেবে দেখতে পারেন, যেখানে উৎপাদন বিশ্বজুড়ে বিতরণ করা হয়, কিন্তু মূল্য বা ধন মূল কেন্দ্রগুলোয় অসমভাবে জমা হয়। বাংলার রেশম এশিয়ায় কাটা, প্যাক করা এবং রপ্তানি করা হতো, কিন্তু এর তৈরি হওয়া সম্পদ পশ্চিমে realized হতো।
দুই শতাধিক বছর পার হয়ে গেলেও বাংলার রেশমের গল্প আজও এক শক্তিশালী গবেষণাকাণ্ড, যা দেখায় কীভাবে অর্থনীতি ও সাম্রাজ্য একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে
রেশম স্বপ্নের মূল্য
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ে বাংলার রেশমের গল্পটি ছিল বিরোধের গল্প- অভিজাত্য ও শ্রমের, উদ্ভাবন ও শোষণের, অগ্রগতি ও বিতাড়নের মধ্যে।
একদিকে এটি ছিল অর্থনৈতিক স্থানান্তরের এক জয়গাথা। কোম্পানি সফলভাবে ইউরোপীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে এশিয়ার উৎপাদন পরিবেশে স্থানান্তরিত করেছিল এবং অর্জন করেছিল অভূতপূর্ব দক্ষতা। কাঁচামালের দাম স্থিতিশীল করা হয়েছে, উৎপাদন খরচ সর্বাধিক কমিয়ে আনা হয়েছে আর রেশমের ইউরোপে প্রবাহ ছিল অষ্টাদশ শতকের লজিস্টিকসের এক বিস্ময়।
তবে মুনাফার চকচকে সুতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল ঔপনিবেশিক শোষণের জটিল বাস্তবতা। যে প্রক্রিয়াগুলো উৎপাদন খরচ কার্যকর করেছিল, সেই একই প্রক্রিয়াই নিশ্চিত করেছিল যে সেই দক্ষতার ফলাফলের সুবিধা পৌঁছায়নি সেসব মানুষের কাছে, যারা তা তৈরি করেছিল।
আধুনিক উন্নয়ন অর্থনীতিতে বলা যায়, বাংলা অর্জন করেছিল উৎপাদনক্ষমতা (productive efficiency), কিন্তু অর্জন করতে পারেনি বণ্টনগত ন্যায় (allocative justice) – উৎপাদন সর্বাধিক করা হয়েছে, কিন্তু এর সুবিধা সমানভাবে বিতরণ হয়নি।
দুই শতাধিক বছর পার হয়ে গেলেও বাংলার রেশমের গল্প আজও এক শক্তিশালী গবেষণাকাণ্ড, যা দেখায় কীভাবে অর্থনীতি ও সাম্রাজ্য একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে; কীভাবে খরচ ও কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা অগ্রগতির হাতিয়ারও হতে পারে এবং শোষণের অস্ত্রও।
শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশম কেবল একটি পণ্য নয়; এটি ছিল একটা শোষণের প্রমাণও যে, কীভাবে একটি সাম্রাজ্য তার উপনিবেশ থেকে মুনাফা, অসম বাণিজ্য থেকে সমৃদ্ধি বোনার ক্ষমতা রাখে–যে কারণে প্রতিটি ঔপনিবেশিক রেশমের সুতোর আড়ালেই আসলে লুকিয়ে আছে মানুষের শ্রমের শোষণের কাহিনি।
