বটতলার গল্প

পাশের বাড়িতে একটি কদমগাছ ছাঁটা হচ্ছে। গাছের মগডালে উঠে একজন কাঠুরে ছাতির মতো ছড়ানো শাখাগুলো চাপাতির কোপ দিয়ে কাটছেন। তারপর ধাপে ধাপে ডাল কেটে তার পেশল বাহু ও চ্যাপ্টা চাপাতি নিচে নামতে থাকল। বেলা গড়িয়ে গেলে শেষ শাখাটিকে ধরাশায়ী হতে দেখলাম। বিকেলের মলিন আলোয় ষাট ফুট দীর্ঘ, খাড়া, ন্যাড়া কাণ্ডটা কেবল দাঁড়িয়ে রইল বিধস্ত জাহাজের মাস্তুলের মতো। দেখে মনটা মুষড়ে গেল।
পঁচিশ বছর আগে আমিই গাছটি লাগিয়েছি, যখন ভাড়াটে হিসেবে আমি ও বাড়ির বাসিন্দা ছিলাম। চার ফুট লম্বা কদমের সেই চারা লাগানোর পর আমরা পাঁচ বন্ধু তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। সেই পাঁচজনের একজন ডাক্তার ডেভিড জনসন, আজ প্রয়াত; আর বাকি তিনজন প্রবাসে আছেন। সেই কিশোর কদমের আটটি কচিপাতা আর ডেভ জনসনের হাসিমুখ আজও ফুলের মতো ফুটে আছে আমাদের ছবিটিতে। ও বাড়ির বুড়ো দারোয়ান জানালেন, ক্যান্ট. বোর্ডের অনুমতি মেলেনি বলে গোড়া থেকে গাছটি কাটতে পারছেন না বাড়ির নতুন মালিক।
বোকার মতো বলে ফেললাম, 'গাছটি আমি লাগিয়েছিলাম ২০০০ সালে।'
হাসিমুখে দারোয়ান বললেন, 'কামডা ভালা করেন নাই ছার। গাছ কাটোনে কী ঠেলা, তাই দেখতাছি।'
কথা সত্যি। আমার বন্ধুমহলে যারা এই হাউজিং সোসাইটিতে প্লটের মালিক ছিলেন, তারা বলেছেন, গাছ কাটার 'কাগজ' বা অনুমতিপত্র বের করাটা সহজ কাজ নয়। অদ্ভুত কথা; গাছ না কাটলে কাগজ হবে কোথা থেকে! গাছ মারার অনুমতি নিতে আমাকে কিন্তু কখনো কোনো অফিসে ধরনা দিতে হয়নি। দুই যুগ ধরে বহুতল এই ভবনের একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আমি। আমার অবহেলায় এ ফ্ল্যাটের বারান্দার যেসব পট-প্ল্যান্ট মরে যায়, তার হিসাব কাউকে দিতে হয় না। বন্ধুজনে আমাকে নতুন নতুন পট-প্ল্যান্ট উপহার দেন। উপহার পেলে মৃত গাছের স্মৃতি ধীরে ধীরে মন থেকে মুছে যায়। পটের সীমিত পরিসরে টিকে থাকা ও নিসর্গ হতে নির্বাসিত অকিঞ্চিৎ সে উদ্ভিদজীবন ত্যাগ করে যেতে ওই গাছগুলোরও কি তেমন কোনো হাহাকার থাকে!
যদিও ধারণা করি, আলো ও পানির অভাবে অথবা অদৃশ্য কোনো কীটের সাথে লড়াইয়ে হেরে গিয়ে অকালে মরে যাওয়ার কষ্টটা হয়তো কারও কাছেই কাম্য নয়। খাদ্যাভাবে, অসুস্থতায় অথবা শত্রুর আক্রমণ হলে ভাস্কুলার অঙ্গ কাঁপিয়ে গাছেরা যে আর্তনাদ করে, সে তথ্য সম্প্রতি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন নির্দয় উদ্ভিদবিজ্ঞানীর দল। ভাগ্যক্রমে গাছের সেই আওয়াজের ফ্রিকোয়েন্সি ২৫ থেকে ২৫০ হাজার হার্টস বলে তা আমাদের শ্রবণসীমার মধ্যে পড়ে না মোটেই; পড়লে কি আর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম!
গাছের আর্তনাদ শোনার ক্ষমতা থাকলে আমরা সম্ভবত মরুভূমি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। কারণ, মানুষ ছাড়াও বিশ্বের তাবৎ প্রাণী ও উদ্ভিদ সর্বক্ষণই তো গাছকে আক্রমণ করছে; এবং বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের সর্বত্রই আক্রান্ত গাছ আর্তনাদ করে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, গাছের সাথেও গাছের চলে নৃশংস লড়াই। গাছের জগতেও জমি, সূর্যরশ্মি ও আর্দ্রতা দখলের কঠিন সংগ্রাম রয়েছে। প্রাণীর মতোই উদ্ভিদও পৃথিবীতে লড়াই করে বেঁচে থাকে।
'স্বর্ণলতা' নামের সুদর্শন লতাগাছগুলো বীজ থেকে জন্ম নেওয়ার পর পায়ের তলার মাটিতে সুন্দর স্বাবলম্বী জীবন কাটালেও এরা বড় হয়ে সম্পূর্ণ পরজীবী হয়ে যায়। লতানো হাত দিয়ে কোনো বৃক্ষের নাগাল পেলেই মাটির সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে স্বর্ণলতারা সেই জিম্মি-বৃক্ষ থেকে পুষ্টি শোষণ করে বেঁচে থাকে। তবে স্বর্ণলতাবেষ্টিত অধিকাংশ জিম্মি-বৃক্ষই অকালে মারা যায় না। জিম্মি-বৃক্ষকে অকালে মেরে ফেলার কাজে উঁচুমার্গের দক্ষতাসম্পন্ন বৃক্ষ হলো আমাদের অতিপ্রিয় বট, পাকুড়, ডুমুর, অশ্বত্থ ইত্যাদি। তাই ইংরেজিতে এদের বলা হয় 'স্ট্র্যাঙ্গলার ট্রি' বা গলাটিপে হত্যাকারী গাছ।

আমাদের চোখের সামনেই এরা আদর করে জিম্মি-বৃক্ষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আমাদের এই ছোট্ট আবাসিক এলাকাতেও এমন 'স্ট্র্যাঙ্গলার' পাকুড়গাছ রয়েছে চারটি। এর একটির শিকড়ের ফাঁকে এখনো মৃত পামগাছটি দেখতে পাই। অপর তিন পাকুড়ের শিকড়ের জালে আটকে রয়েছে অন্য তিনটি মৃত্যুপথযাত্রী বৃক্ষ। ধীরগতিতে গলাটিপে ধরে আরও দুই যুগ টিকে থাকার পর এই তিনটি পাকুড়গাছও অবশেষে একদিন জিম্মি-বৃক্ষের মৃতদেহগুলো আড়াল করে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সমর্থ হবে।
'স্ট্র্যাঙ্গলার' বা গলাটিপা খেতাবধারী গাছগুলো অবশ্য জিম্মি-বৃক্ষ থেকে পুষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকে না স্বর্ণলতার মতো। দুনিয়ার আর সব স্বাবলম্বী গাছের মতোই এরা সূর্যরশ্মি থেকে নিজের আহার্য তৈরি করে। কিন্তু সূর্যরশ্মি পেতেও তো লড়াই করতে হয়; বিশেষ করে অন্ধকার বনতল, পাহাড়ের ঢাল ইত্যাদি যেসব যায়গায় সূর্যরশ্মির আকাল থাকে। পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যরশ্মি আহরণের জন্যই গলাটিপা-বৃক্ষগুলো অন্য বৃক্ষের ঘাড়ে চড়ে বসে।
এরা জীবন শুরুই করতে চায় অরণ্যের ছাদের ওপর থেকে। পাখির বিষ্ঠায় এ বৃক্ষের বীজ ছড়িয়ে পড়ে গাছের মাথায়, পাহাড়ের চূড়ায় আর দালানের ছাদে। সূর্যরশ্মির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দ্রুত ডালপালা আর শিকড় ছাড়ার ক্ষমতা আছে এ গাছের। বাতাস থেকে যে পানি নেওয়া যায়, তা দিয়েই এ গাছের কাজ চলে; পানির সন্ধানে এদের মাটিতে নামতে হয় না। ডালপালার চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ে এর শিকড়। যত দ্রুত সম্ভব মাটির গভীরে মোটা মোটা শিকড় প্রোথিত করতে চায় এরা। পানির সন্ধান নয়; জিম্মি-বৃক্ষের মৃত্যুর পর নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে থাকাই এসব শিকড়ের মূল উদ্দেশ্য। শক্তিশালী এই শিকড় দিয়ে শক্ত করে মাটি আঁকড়ে ধরার আগেই জিম্মি-বৃক্ষটি মারা গেলে পতন অনিবার্য এবং সে পতনে মৃত্যু না হলেও সূর্যরশ্মি থেকে বঞ্চিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
এমন একটি পতন ও মৃত্যু দেখেছি আমাদেরই হাউজিং সোসাইটিতেই। বহু বছর আগে দুটি পামগাছ লাগানো হয়েছিল আমাদের ক্লাবের গেটে। বছর না যেতেই পাখির কল্যাণে পামগাছের মাথায় দুটি পাকুড়গাছ গজিয়েছিল। তারপর ছোট্ট সেই দুটি পাকুড়গাছের মোটা শিকড়গুলো পামগাছ দুটিকে জাপটে ধরতে থাকল। তিন দশকের মধ্যে পামগাছের জায়গায় টিকে রইল রুপালি শিকড়ের চমৎকার দুই স্তম্ভের ওপরে সুদর্শন দুটি পাকুড়গাছ; যদিও শিকড়ের সেই বন্ধনীর অভ্যন্তরে মৃত পামগাছ ঠিকই চোখে পড়ে।
ক্লাব গেটের অঙ্গসজ্জা হিসেবে এই গাছ দুটি পামগাছের চেয়ে বেশি বৈ কম মনোহর ছিল না। একদিন সামান্য ঝড়ে এর একটি গাছ ধরাশায়ী হলে এরা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। পথের ওপর থেকে পতিত গাছ অপসারণের ব্যবস্থা করা হলো এবং বিকেলের মধ্যে সেখানে গাছের কোনো চিহ্ন রইল না। গেটের ওপর পাশে অন্য পাকুড়গাছটি নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে; মাটির গভীরে শিকড় গেঁথে ফেলার কাজে নিজের দক্ষতা নিয়ে তার সম্ভবত কোনো অভিযোগ নেই।
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সেই অতিকায়, অনন্য ও অবিস্মরণীয় বটবৃক্ষের কথাও এখানে একটু বলি। উনিশ শতকের ষাট-দশকে ব্রিটিশ সরকারের দাদাগিরির বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নজীরবিহীন ছাত্র বিক্ষোভ দাবানলের মতো এশিয়া মহাদেশের নানা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধে দুঃশাসনের অভিযোগ নেই এমন দেশ কমই ছিল এ মহাদেশে; আমাদের দেশের তো কথাই নেই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছাত্রনেতা তারিক আলি একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে বটতলায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। বটতলার সেই উপচেপড়া লোকারণ্যের শেষ প্রান্ত থেকে আমি হতবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম বিস্ফোরণোন্মুখ তারুণ্যের তপ্ত মাথার ওপরে ঘনপল্লবের বিশাল ছাতাটি মেলে ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে সেই মহীরুহ।
পিরিচের মতো মোটা মোটা হলদে পাতার ওপরে অগণন রক্তলাল ফলের সম্ভার মেলে ধরেছে শতবর্ষী সেই বৃক্ষ। ক্ষণকালের ওই ফলাহারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিল যেসব বুলবুল, কাঠশালিক ও অন্যান্য নির্ভীক শহুরে বিহঙ্গ; তাদের অবকাশ ছিল না বিশ্বখ্যাত ছাত্রনেতার কোনো কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার। তাদের জগতে কোনো সরকার নেই; নেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার কোনো প্রচেষ্টা।
বটতলার সেই অজর জটলাটি একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের বিশাল জনস্রোতে গিয়ে মিলেছিল। পাকিস্তানের ক্রুদ্ধ সামরিক শাসকের মূর্খ প্রতিনিধিরা ত্রিকালদর্শী সেই বটবৃক্ষ কেটে ক্যাম্পাস থেকে তার সব চিহ্ন সরিয়ে ফেলেছিল। তাতে অবশ্য এ দেশের মানুষের প্রতিরোধের গতিতে যতি পড়েনি। সংগ্রাম এগিয়ে গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং নতুন দেশে নবীনের দল আবার বটতলায় গিয়ে জড়ো হয়েছে।
প্রাচীন বটগাছটি সরিয়ে নিলেও ঐতিহাসিক সেই বটতলার মাটি তো আগের মতোই খাঁটি। স্বাধীন বাংলাদেশে এই বটতলায় একটি নতুন বটের চারা রোপণ করা হয়। সেই বটবৃক্ষের বয়সও এখন পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। দেখে মনে হয়, যেন অনাদিকাল থেকে গাছটি এখানেই আছে এবং এ দেশের মানুষের সংগ্রামের সব কথা এর শিকড়ে, কাণ্ডে, শাখায় ও পল্লবের শিরায় শিরায় লেখা হয়ে গেছে।
'পথ-সংগ্রামী বছরগুলো: ষাট দশকের আত্মজীবনী' শিরোনামে একটি স্মৃতিকথায় ২০০৫ সালে তারিক আলি এই বটতলাকে 'আমতলা' বলে উল্লেখ করেন। পাঞ্জাবি হিসেবে তার মাতৃভাষায় আমের নাম 'আম' হলেও বটের নাম 'বোহার'। তাই সম্ভবত তিনি বটতলার স্থলে 'আমতলা' লিখে ফেলেছেন। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমির বটতলায় অনুষ্ঠিত 'হেই ফেস্টিভ্যাল' নামের সাহিত্য উৎসবে ঢাকা এলে তাকে এই 'আমতলা-বটতলা' বিভ্রমটির কথা বলা হয়। তিনি ভ্রম স্বীকার করে নিলে সবাই সন্তুষ্ট হয়েছেন; এবং ক্যাম্পাসের বটবৃক্ষটিও সম্ভবত তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।