মিরপুরে আগুনে নিহত বেড়ে ১৬, বিষাক্ত গ্যাস থেকে মৃত্যু: ফায়ার সার্ভিস

রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি রাসায়নিকের গোডাউন তার পাশের একটি কারখানায় লাগা আগুনে নিহত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ জনে। এছাড়া বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস এ তথ্য জানিয়েছে। আহতদের জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ভবনটির নিচতলায় 'অবৈধ' রাসায়নিকের গোডাউন থেকে সূত্রপাত হয়। পরে তা পাশের কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি রাসায়নিক গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। রাসায়নিক থেকে আগুন লাগার পর তা দ্রুত পাশের কারখানাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।'
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন টিবিএসকে বলেন, 'আমরা বিকট শব্দ পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই এবং দেখতে পাই রাসায়নিকের গোডাউন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে উপস্থিত লোকজন গোডাউনের কর্মীরা বলেছেন, গোডাউনের ওপরে ওয়াশিং ফ্যাক্টরির ব্রয়লার ব্লাস্ট হলে নিচের রাসায়নিকে আগুন লেগে যায়। আমরাও ব্রয়লার ব্লাস্ট হওয়ার মতো শব্দ শুনতে পেয়েছি।'

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), ফায়ার সার্ভিস এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগুন লাগা গোডাউন ও কারখানাটি অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। এগুলোর কোনো ট্রেড লাইসেন্স, অগ্নি নিরাপত্তা ছাড়পত্র কিছুই নেই।
ডিএনসিসির জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার (জোন-২) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা আমাদের নথি পরীক্ষা করে দেখেছি। এই ভবনগুলোর কোনো ট্রেড লাইসেন্স পাইনি। যদি এগুলো রাসায়নিকের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হতো, তবে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।'

ফায়ার সার্ভিসের মিরপুর জোনের পরিদর্শক অর্জুন বাড়ই বলেন, 'ঘটনাস্থলে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা বা অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ছিল না। তাদের পরিচালনার জন্য কোনো লাইসেন্স ছিল না।'
রাজউকের পরিচালক (জোন-৩) সালেহ আহমেদ জাকারিয়া বলেন, 'ভবনটি পুরনো এবং এ ধরনের শিল্প কার্যকলাপের জন্য অনুমোদিত নয়। আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাসায়নিকের গোডাউনের কোনো অনুমোদন ছিল না। বিস্তারিত তদন্ত চলছে।'
এদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাসায়নিক গোডাউনটির কোনো অনুমোদন নেই এবং এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।

ডিআইএফই-এর ঢাকা অঞ্চলের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আতিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস)-বলেন, 'যেখানে আগুন লেগেছে, সেটি কেমিক্যালের গোডাউন বলে আমরা জেনেছি। তবে প্রতিষ্ঠানটির মালিক কারা তা জানতে পারিনি।'
তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে এটি কেমিক্যাল গোডাউন বলে কোনো ধরনের তথ্য নেই। কোনো একটা বাড়ির মধ্যে একটা কেমিক্যাল গোডাউন করে রেখেছে। এটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভবও নয়।'
ডিআইএফই-এর শ্রম পরিদর্শক মো. আহসান জামিল টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এখনও ওই কেমিক্যাল গোডাউনের মালিকদের পাচ্ছি না।'
বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মৃত্যু
ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, রূপনগরে আগুনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ জন হয়েছে। প্রথমে ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল, পরে আবার সাত জনের মরদেহ নতুন করে উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।

তবে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতদের পরিচয় জানা যায়নি। নিহতদের মরদেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, কারখানার পাশে থাকা রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে বিষাক্ত সাদা ধোঁয়া বা টক্সিক গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে, যা ছিল প্রাণঘাতী। ফায়ার সার্ভিস বলছে, 'আগুন খুব দ্রুত "ডেভেলপ স্টেজ" বা তৃতীয় ধাপে পৌঁছে যায়, ফলে ভুক্তভোগীরা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।'
সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিষাক্ত গ্যাসের কারণে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, 'চার তলা পোশাক কারখানাটিতে টিনের ছাদ আছে। ছাদে ওঠার জন্য একটি গ্রিলের দরজা আছে। দরজাটি তালাবদ্ধ ছিল। এ কারণে তারা ওপরে যেতে পারেনি।'

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, গুদামটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে ছয় থেকে সাত ধরনের রাসায়নিক মজুদ ছিল। বর্তমানে, রাসায়নিক গুদামে মরদেহ খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
গোডাউনের পাশের কারখানা থেকে যে নয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে, তা দেখে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা প্রয়োজন হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাজুল বলেন, 'ঘটনাস্থলে পৌঁছে দমকল কর্মীরা দুটি জায়গাতেই একই সাথে আগুন জ্বলতে দেখেন। রাসায়নিক গুদাম থেকে নাকি পোশাক কারখানা থেকে আগুন লেগেছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের অভিযান এখনও চলমান। অভিযান শেষ হলে আমরা বিস্তারিত তথ্য দিতে পারব।'
রাসায়নিক গুদামের পরিস্থিতি বিপজ্জনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, দমকল কর্মীদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আগুন নিয়ন্ত্রণে ড্রোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ সময় তিনি সবাইকে ঘটনাস্থল থেকে কমপক্ষে ৩০০ গজ দূরে থাকার আহ্বান জানান।

রাসায়নিক গোডাউন ও আশপাশে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার পর পাশের দুটি পোশাক কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেয় মালিকপক্ষ।
উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করার জন্য ঘটনাস্থলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
তালহা বিন জসিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গুদামের ভেতরে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মজুত ছিল।
অগ্নিকাণ্ডে নিহতের ঘটনায় শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধান উপদেষ্টা অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন।
এর আগে, মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে এ আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাসায়নিক গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।

তালহা বিন জসিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) সে সময় বলেছিলেন, 'দুটো প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগেছে। এর মধ্যে একটি তৈরি পোশাক কারখানা, অন্যটি একটি রাসায়নিকের গুদাম। পোশাক কারখানাটি সাততলা। এর চারতলায় আগুন লেগেছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা পোশাক কারখানার এই আগুন মোটামুটি নিভিয়ে ফেলেছি। তবে রাসায়নিকের গুদামের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'রাসায়নিক কারখানায় ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল।'

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, আগুনের সূত্রপাত এখনো জানা যায়নি। যারা শুরুতে আগুন নেভাতে এসেছেন, তারা রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা দুই দিকেই আগুন দেখেছেন।