এম এ বেগের দুর্লভ ১০ ছবি

যোগাযোগপ্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ 'অনুধাবন'-এর পাটাতনে দাঁড়িয়ে একাধারে একজন গণযোগাযোগের শিক্ষার্থী ও আলোকচিত্রী হিসেবে আমি আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগের ছবির বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী। বিশেষায়িত এই লেখাটির জন্য আমি এম এ বেগের নির্দিষ্ট কিছু ছবি নির্ধারণ করে নিয়েছি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে শিল্প সমালোচনা-সংক্রান্ত সাহিত্যে শত বছরের মধ্যে আলোকচিত্র-সংক্রান্ত ধারাবাহিক শিল্প সমালোচনা এ দেশে খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। সেই ধারা এখনো চলমান রয়েছে; দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন বা উদ্যোগ এখনো চোখে পড়ে না।
ফটোগ্রাফি নিয়ে অন্তত দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে দুটি বিষয় আমাকে নানাভাবে নাড়া দিয়েছে ও এখনো দিচ্ছে। প্রথমত, শিক্ষক হিসেবে ফটোগ্রাফির নানান জনরা পড়াতে আমরা যাদের কাজ আমাদের উপস্থাপনায় সংযুক্ত করেছি, তার প্রায় সমুদয় ছবিই মূলত পশ্চিমা আলোকচিত্রীদের তোলা। দ্বিতীয়ত, আমরা বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের কাজ অত্যন্ত সীমিত মাত্রায় উপস্থাপন করতে পারি শিক্ষার্থীদের সামনে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের অগ্রজদের তোলা অধিকাংশ ছবি তাদের মৃত্যুর পর অস্তিত্বহীনতার সংকটে রয়েছে।
এগুলোকে রক্ষায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া আর কোনো বিকল্প এখন আর আমাদের হাতে নেই। তবে যত দিন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে 'জাতীয় আলোকচিত্র আর্কাইভ' না হচ্ছে, তত দিন আমি অন্তত লিখে যেতে চেষ্টা করব আমাদের আলোকচিত্রণের গৌরব করার মতো আলোকচিত্রী ও তাদের কাজ নিয়ে। বর্তমান আলোচনায় আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগের ১২টি ছবি নিয়ে বিশ্লেষণে মানবীয় যোগাযোগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান 'অনুধাবন' প্রক্রিয়াটিকে পাঠকের সামনে আনতে চাই।
আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগের অধিকাংশ ছবি আমি বা আমরা ২০২১ সালের পূর্বেও দেখিনি। এখনো তার অধিকাংশ ছবি সাধারণ মানুষের কাছে অপ্রকাশিত। বেগার্ট ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফির বর্তমান কর্ণধার এবং এম এ বেগের ছেলে ইমতিয়াজ আলম বেগ করোনাকালে অত্যন্ত ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে তার বাবার ছবিগুলো ডিজিটাইজেশন করতে শুরু করেন। গণযোগাযোগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে মনজুর আলম বেগের ছবিগুলো আমার নজরে আসে ওই সময়কালে। তখন থেকেই ভাবনার শুরু এই ছবিগুলো নিয়ে। ২০২১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানান ধরনের আলোচনায় তার ছবিগুলো উঠে আসতে শুরু করে বিভিন্ন প্রসঙ্গের টানেই। প্রথম দেখায় আমার যে ধাক্কাটি লাগে, সেটি মূলত ছবির জন্য নয়; বরং আমি অনুধাবন করি, এম এ বেগেকে আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে এত দিনে যে অবয়ব প্রদান করা হয়েছে, তা অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং পাশাপাশি অগ্রহণযোগ্যও। আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমাদের অনুধাবনে তার এই অবয়ব নির্মিত হয়েছে কাদের হাত ধরে?

সাধারণভাবে লক্ষ করলাম, মূল সমস্যা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি এম এ বেগ বা তার ছবির নয়। বরং সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে তথ্যের অপ্রতুলতা এবং গবেষণার অভাব। আমরা তার অবয়ব তৈরি করতে পারিনি; কেননা তার ছবিসমূহ আমাদের সামনে উন্মুক্ত ছিল না। গবেষণার কথা এখানে নাই বা উল্লেখ করলাম।
আলোচ্য ছবিগুলোর মতো অন্তত ১০০টি ছবির একটি দীর্ঘ ও পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ করা গেলে আমরা জাতির সামনে আলোকচিত্রাচার্যের একটি শিল্পী অবয়ব পেতে পারতাম। এটি অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ ছিল। কিন্তু নানান কারণে সেটি করা হয়ে ওঠেনি।
ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন বৃহত্তর রাজশাহীর নবাবগঞ্জের (বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রত্যন্ত গ্রামে এম এ বেগ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ১ অক্টোবর। তিনি দেশ ভাগের বছর ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই ১৬ বছরের জীবনে শৈশবের একটি সময় তার কেটেছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল মাটি-কাদার নাচোল, শিবগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায়। সেই অঞ্চলে মাটির একতলা বা দোতলা বাড়িরগুলোর দিকে তিনি নিশ্চয়ই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন। মূলত সে জন্যই ক্যামেরা হাতে এই সমস্ত অঞ্চলের বিস্তৃত মাঠ, ঘাট, পথ, প্রান্তর, জনবসতি ঘুরে ঘুরে তিনি ছবি তুলে গেছেন। তার তোলা ল্যান্ডস্কেপগুলো বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিজ্যুয়াল দলিল হিসেবে টিকে আছে এখনো।
এখানে ব্যবহৃত ছবিটি (ছবি-১) মিডিয়াম ফরম্যাট ক্যামেরায় ১৯৬০-এর দশকের দিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী অঞ্চলে তোলা। ডিজিটাইজ করা নেগেটিভটি দেখলে বোঝা যায়, এটি ভীষণভাবে ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ছিল। নেগেটিভের ইমালশনগুলো অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কম্পিউটারে বিশেষ ফটো-এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংস্কার করা এটি তার প্রথম ছবি। একেবারেই ব্যবহার অনুপযোগী ছবিটিকে এখন ব্যবহার উপযোগী করে তোলা গেছে। ফলে নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হলো–আমাদের অগ্রজ আলোকচিত্রশিল্পীদের সকল নষ্ট নেগেটিভকে একবিংশ শতাব্দীর নতুন প্রযুক্তিতে ডিজিটালাইজেশন ও বিশেষ ফটো-এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা সম্ভব। তবে লক্ষ রাখতে হবে ছবিতে থাকা তথ্যের ব্যত্যয় যেন না ঘটে।

কোনো একটি অঞ্চলে বসবাস না করলে ওই অঞ্চলের জীবনাচার অন্য একজন মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। সে জন্য লক্ষণীয়, ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফাররা (তথ্যচিত্র আলোকচিত্রী) কোনো একটি বিষয়ে ছবিগল্প তৈরি করতে ওই অঞ্চলে বা স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবস্থান করেন। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে তারা সেখানে বারবার যেতে চান। খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে উদাহরণ টানতে গেলেও অন্তত একজন আলোকচিত্রীর নাম তুলে ধরা দরকার। তিনি হলেন আমেরিকান ফটোসাংবাদিক এবং তথ্যচিত্র আলোকচিত্রী উইলিয়াম ইউজিন স্মিথ (১৯১৮-১৯৭৮)। মূলত তার হাত ধরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পঞ্চাশের দশকে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত চর্চা বিকশিত হয়।
১৯৪৮ সালে বিখ্যাত লাইফ ম্যাগাজিনের জন্য তিনি আমেরিকার ডেনভার থেকে ১১৫ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ক্রেমলিং কলোরাডো শহরে কাজ করতে যান। আর্নেস্ট গাই সেরিয়ানি নামের একজন গ্রামীণ শৈল্য চিকিৎসকের জীবন ও ওই শহরের মানুষের সাথে তার সম্পর্ককে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন তার ক্যামেরা দিয়ে ছবিগল্পের মাধ্যমে। 'কান্ট্রি ডক্টর' শিরোনামে ছবিগল্পটি লাইফ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এটি ৭৭ বছর পরেও ফটোগ্রাফির আলোচনায় ও শিক্ষণে অন্যতম ব্যবহৃত ছবিগল্প হিসেবে বিবেচিত। এম এ বেগের প্রিয় আলোকচিত্রশিল্পীদের মধ্যে দুজন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার ছিলেন উল্লেখযোগ্য–উইলিয়াম ইউজিন স্মিথ এবং রঘু রায়। তাদের কাজ তিনি ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত দেখাতেন। 'কান্ট্রি ডক্টর' ছিল তার মধ্যে অন্যতম। এম এ বেগ ওই সময়কালের কিছু পরে ক্যামেরা হাতে বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়ী, নাচোল ও অন্যান্য স্থানের মানুষ ও জনপদের ছবি তুলেছিলেন। তার তথ্যচিত্র আলোকচিত্রী হওয়ার যাত্রাটা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল বলে ধরে নেয়া যায়। তার এসব কাজকে আমাদের ভিজ্যুয়াল স্টাডিতে সংযুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
সনাতন (কেমিকেল ও ফিল্মকেন্দ্রিক) আলোকচিত্রণের অন্তত প্রথম ১০০ বছরে বিশ্বের প্রায় সকল প্রান্তে ফ্যামিলি পোর্ট্রেট তোলার বিষয়টি খুব আকর্ষণীয় ও মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা ছিল। বিংশ শতকের প্রথম তিন দশকের মধ্যে ছোট ফরম্যাটের ক্যামেরা, বিশেষ করে কোডাক, লাইকা এবং অপরাপর ক্যামেরা বাজারে সহজলভ্য হলে ফ্যামিলি পোর্ট্রেটের পাশাপাশি নানান ধরনের পারিবারিক ছবি তোলা সহজ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের কাছে। ছবি দিয়ে ফ্যামিলি অ্যালবাম তৈরি করা ছিল প্রায় প্রতিটি পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় একটি কাজ এবং এটিকে সেই পরিবারের ভিজ্যুয়াল হিস্ট্রি সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে ধরে নেওয়া হতো। বড় আকৃতির টিএলআর মিডিয়াম ফরম্যাট ক্যামেরা সাথে করে নিয়ে গিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এম এ বেগ তার পারিবারিক নানান ধরনের ফটোগ্রাফি করেছিলেন বেশ মনোযোগ দিয়েই।

১৯৬০-এর দশকের কোনো এক সময়ে ছবিটি (ছবি-২) নাচোল অঞ্চলে তোলা হয়েছিল। উন্নত পশ্চিমা বিশ্বে জাতীয় জাদুঘরগুলোতে নানান সময়কাল ধরে ধরে ফ্যামিলি ফটোগ্রাফসকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়। কেননা ব্যক্তিপর্যায়ে তোলা ফ্যামিলি ফটোগ্রাফসের মধ্যেও ওই সময়কালের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, সংস্কৃতি, আর্কিটেকচার, পোশাক-ফ্যাশন ইত্যাদির বিভিন্ন উপাদানসমূহ ফুটে ওঠে। ছবির মধ্যে দৃশ্যমান প্রতিটি উপাদান যেন সাক্ষী দেয় ওই সময়কালের। ছবি-৩-এর দৃশ্যমান উপাদানগুলো ১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের একটি চেহারা তুলে ধরে। বড় বড় গাছের ছায়ায় গ্রামীণ বসতভিটা, মাটির রাস্তা, যাতায়াতের জন্য গরুর গাড়ি ইত্যাদি সহজেই আমাদের নজরে আসে।
যোগাযোগ-অনুধাবনে সবার আগে যেটি উপস্থিত হয়, তা হলো প্রশান্তি; গন্তব্যে পৌঁছানোর স্বস্তি। পাশাপাশি গাছের ছায়ায় দীর্ঘ মেঠোপথ পাড়ি দেওয়া গরুগুলোর ও গাড়োয়ানদের বিশ্রাম নেওয়ার বিষয়টি একধরনের শান্তিদায়ক অনুভবের অনুধাবন সৃষ্টি করে। গ্রামীণ জনপথের এই গহিনে গরুর গাড়িই যাতায়াতের একমাত্র ভরসা। বর্ষায় এই রাস্তায় ভীষণ খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এম এ বেগের ক্যামেরায় ধারণকৃত বেশ কিছু ছবিতে আমরা এই জনপদের মেঠোপথ, সারি সারি তালগাছ, গরুর গাড়ির যাতায়াতের বেশ কিছু ছবির সন্ধান পাই।
একজন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির শিক্ষক হিসেবে আমেরিকান আলোকচিত্রী ডায়ান আরবাসের (১৯২৩-১৯৭১) নানা ধরনের ছবি আমার মানসপটে ভেসে বেড়ায়। তার মধ্যে ১৯৬৭ সালে নিউ জার্সির রোজালে তোলা 'আইডেন্টিক্যাল টুইনস' ছবিটি স্পষ্টভাবে মনে পড়ে। এম এ বেগের তোলা দুই বোনের পাশাপাশি বসে থাকা ছবিটি ডায়ান আরবাসের সেই ছবিটির কথা চট করে মনে করিয়ে দেয়। একজন আলোকচিত্রী হিসেবে আমি বিষয়টি অনুধাবন করে ভীষণ আশ্চর্য হই, পৃথিবীর বিপরীত দুই প্রান্তে অবস্থান করে যোগাযোগহীনতার মাঝেও তাদের ছবির মধ্যে ভিজ্যুয়াল রিপ্রেজেন্টেশনের বেশ মিল দেখা যায়।

প্রথম দেখায় 'বেলকনিতে বসে জুতা রং ও পলিশ করা'র ছবিটি (ছবি-৫) দেখে আমার অনুধাবন হলো এটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন কাজের একটি চিত্র। ফটোগ্রাফির ভাষায় আমরা যাকে বলি 'ডেইলি লাইফে'র ছবি। এই মধ্যবিত্ত চলকের ধারণাটি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু অনুধাবন প্রক্রিয়ায় একজন অডিয়েন্স বা শ্রোতা হিসেবে মধ্যবিত্ত চলকটিকে বুঝতে পারা আমার জন্য খুব সহজ এবং তৃপ্তিদায়ক। একটি কার্যকর যোগাযোগসম্পন্ন হলে মানুষ মানসিকভাবে তৃপ্তিবোধ করেন। এখানে যেহেতু শ্রোতা হিসেবে আমার অবস্থান মধ্যবিত্তে (অন্তত আমার অনুধাবন তাই বলে); সেহেতু ছবিটি দেখে যোগাযোগের এই তৃপ্তি ঘটে প্রথমেই।
এখন এই ছবিতে যে তথ্যগুলো নেই, সেগুলো সংযুক্ত করতে শুরু করি। ছবিটি ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদরাতের দিন তোলা। এখানে দেখা যাচ্ছে একজন ছেলে নিজের ও পরিবারের অন্যদের বেশ কিছু জোড়া জুতা বেলকনিতে সূর্যের নরম আলোয় বসে রং ও পলিশ করতে বসেছেন। অন্য আরেকজনের গায়ে জড়ানো চাদর দেখে বোঝা যায়, এটি শীতকালে তোলা হয়েছে। এখানে শীতকাল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখন শ্রোতা হিসেবে আমার অতীত অভিজ্ঞতার সাথে কর্মটি হুবহু মিলে গেছে। সম্ভবত এ দেশের কোটি কোটি মধ্যবিত্ত পরিবারের চাঁদরাতের দিনের বেলার অত্যন্ত সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি, যা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে।
বর্তমান নিবন্ধের আলোচনার জন্য এম এ বেগের চারটি পোর্ট্রেট ছবি রয়েছে, ছবি-৬-৯। ছবি-৬ হলো ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের একটি স্টুডিও পোর্ট্রেট। এম এ বেগের তোলা ছবিটি প্রথমে দেখামাত্রই বিশেষ এক অনুভবের সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশ পেতে সম্মুখযুদ্ধের একজন মুক্তিযোদ্ধার বলিষ্ঠ হাসিটি শক্তিশালী অনুধাবনের জন্ম দেয়। নিউট্রাল ব্যাকগ্রাউন্ড, ইভেন লাইট, নিয়ন্ত্রিত স্টুডিও পরিবেশ ইত্যাদি কোনো কিছুই আর চোখে পড়ে না। বলিষ্ঠ ও হাস্যোজ্জল মুখটি বাংলাদেশের চেহারাটি ফুটিয়ে তোলে।

পোর্ট্রেট ছবিগুলোর আলোচনায় দুটি মাত্রা রয়েছে। এক, ছবির ভিজ্যুয়াল সিগনেচার এবং দুই, অন্যদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে এম এ বেগের পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির বিশেষ সিগনেচারের প্রয়োগ। পোর্ট্রটে ছবিগুলো দেখলেই দুজন বিশেষায়িত পোর্ট্রটে আলোকচিত্রীর কথা স্মরণে আসে–আমেরিকান আলোকচিত্রশিল্পী ইউসুফ কারশ (১৯০৮-২০০২) এবং জার্মান আলোকচিত্রশিল্পী আগস্ট স্যান্ডার (১৮৭৬-১৯৬৪)। এম এ বেগের তোলা পোর্ট্রটেসমূহে নানান ভিজ্যুয়াল সিগনেচারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। এই ছবিগুলোর মতো তার বেশ অনেকগুলো কাজ রয়েছে এই জনরায়। এসব ক্ষেত্রে তিনি যে ভিজ্যুয়াল সিগনেচারের প্রয়োগ করেছেন, তা ওপরে উল্লিখিত দুজন বিশেষায়িত পোর্ট্রেট আলোকচিত্রীর কাজের সাথে দারুণভাবে মিলে যায়। বিশেষ করে আলোর ব্যবহার, ব্যাকগ্রাউন্ডের সারল্য, সাবজেক্টের (ব্যক্তির) প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ছবি-৭-এর মধ্যে আমরা এই বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করি। আমরা জানি, আগস্ট স্যান্ডার টাইপোলজিক্যাল পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফিকে আমাদের সামনে নতুন সিগনেচার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ব্যান্সডকে যেসব মেধাবী বিজ্ঞানীরা কাজ করতেন, তাদের পোর্ট্রেট তোলার ক্ষেত্রে এম এ বেগ এই সিগনেচারের কিছু কিছু প্রয়োগ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এই পোর্ট্রেটগুলো তোলার ক্ষেত্রে আলোকচিত্রণের নান্দনিকতার প্রয়োগ তার অন্য ক্ষেত্রের পোর্ট্রেট চর্চা থেকে বেশ খানিকটা পৃথক ধরনের। তার তোলা এই পোর্র্ট্রেটগুলো আমাদের এই জনরায় কাজ করতে উজ্জীবিত করে। আলোকচিত্রণ অধ্যয়নে তার এসব পোর্ট্রেটকে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। এম এ বেগের তোলা পোর্ট্রেটসমূহ এভাবে বাংলাদেশের আলোকচিত্রণ অধ্যয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে। বিশ্বপরিমণ্ডলে বিশেষায়িত পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারদের কাজের উপস্থাপনার পাশাপাশি এই বিশ্বমানের আলোকচিত্রশিল্পীর কাজ তুলে ধরার ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।

১৯৬০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬৫ বছরের ইতিহাস রয়েছে ফটোগ্রাফির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষণের। এই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও লক্ষণীয়, এখনো ফটোগ্রাফি শিক্ষণে লাইট-পেইন্টিং সমানভাবে জনপ্রিয় নবীন শিক্ষার্থীদের মাঝে। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত 'বেগার্ট ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি'র মাধ্যমে বাংলাদেশে এম এ বেগ ফটোগ্রাফি শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। সে জন্যই মূলত তিনি এ দেশের আলোকচিত্র সমাজে 'বেগ স্যার' বলে অধিক পরিচিত। সেই সময়কালে ফটোগ্রাফি শিক্ষণের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল সনাতন পদ্ধতির ক্যামেরা এবং রসায়ননির্ভর আলোকচিত্রণ প্রক্রিয়া, যা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে না শিখে চর্চা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বর্তমান সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যারা ফটোগ্রাফি শিখেছেন, তাদের পক্ষে এটি অনুধাবন করা অত্যন্ত কঠিন।

একবিংশ শতকের অত্যাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং উন্মুক্ত ইন্টারনেটভিত্তিক জ্ঞানের এই সময়েও কিন্তু 'পেইন্টিং উইথ লাইট' সকল নবীন শিক্ষার্থীকে এখনো চমৎকৃত করে। আজ থেকে অর্ধশত বছর পূর্বেও এম এ বেগ ও তার সহ-আলোকচিত্রীরা লাইট-পেইন্টিং এবং ফটোগ্রাফির নানান কারিগরিতা ব্যবহার করে এক্সপেরিমেন্টাল ফটোগ্রাফিতে ঝুঁকে পড়েছিলেন। তার মধ্যে প্রয়াত বিজন সরকার এবং অন্যান্য অগ্রজ আলোকচিত্রশিল্পীর হাতে তৈরি সেই সময়ের পরীক্ষামূলক কাজগুলো এখনো আমাদের চমৎকৃত করে। আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগের পরীক্ষামূলক ফটোগ্রাফি কাজগুলোর থেকে একটি (ছবি-১০) এখানে প্রকাশিত হলো। লাইট-পেইন্টিং (বা পেইন্টিং উইথ লাইট) ছাড়াও ফটোগ্রাম, সোলারাইজেশন প্রিন্ট, মাল্টিপল এক্সপোজারে ছবি তোলা, মিনিয়েচার ফটোগ্রাফি, ডার্করুমে মাল্টিপল নেগেটিভ থেকে প্রিন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত আলোকচিত্রশিল্প তৈরি করার কাজ নিরলসভাবে করে গেছেন এম এ বেগ।

মূলত তার চেষ্টা ছিল চোখ দিয়ে দেখা যায় না কিন্তু আলোর মাধ্যমে ক্যামেরার দ্বারা তোলা যায় এমন আশ্চর্য নান্দনিক শিল্পকর্ম তৈরি করার। ডার্করুমের লাল আলোর মধ্যে তরল কেমিকেলে ডোবানো কাগজে আশ্চর্য সব শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে 'ফটোগ্রাফি উইথ আউট ক্যামেরা'কেও পরিচিত করে তোলার কাজ তিনি করে গেছেন। সনাতন ফটোগ্রাফির যুগে ডার্করুম ছিল আলোকচিত্র-শিল্পীদের কাছে শিল্পকর্ম জন্মদানের আঁতুড়ঘর। সেসব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্বের বহু আলোকচিত্রশিল্পী এখনো সনাতন আলোকচিত্রণ প্রক্রিয়ায় আলোকচিত্রশিল্প নির্মাণ করছেন। বাংলাদেশের একজন আলোকচিত্রশিল্পী ঊনবিংশ শতকের ওয়েট কলোডিয়ান পদ্ধতিতে ছবি তোলার চর্চা করছেন।
ছবি-১১ ও ১২ মূলত এম এ বেগের তোলা বিশেষায়িত ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির দারুণ একটি উপস্থাপনা। স্ট্রিট ফটোগ্রাফি ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি জনরার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সক্রিয় একটি ধারা। বর্তমানে বাংলাদেশে এই ধারাটি তরুণ আলোকচিত্রীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং চর্চিত একটি ফটোগ্রাফি জনরা।

১৯৬০-এর দশকে এম এ বেগের স্ট্রিট ফটোগ্রাফির কাজগুলো অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারে। এবং বাংলাদেশের ওই সময়কালের নগর সংস্কৃতির চিত্রকে তুলে ধরে তার ওই ছবিগুলো। স্বাধীনতা উত্তর ঢাকা শহরের চেহারা এবং নাগরিকদের বিনোদনের ব্যবস্থা বর্তমান মফস্বল শহরগুলোর মতোই ছিল। ঢাকার ধানমন্ডির সায়েন্স ল্যাবরেটরি কলোনির মধ্যে একজন বেলুন বিক্রেতাকে ঘিরে শিশু-কিশোরদের জটলা আমাদের শৈশবের অনুধাবনকে নাড়া দেয়। তখন নেই কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আধিক্য; নেই ডিজনিল্যান্ডের মতো পার্কে ঘোরাঘুরির ব্যবস্থা।
বিকেল হলেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আলাদা আলাদা জটলা করে গল্প করা, ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে বেলুন বিক্রেতার কাজটি চিত্তাকর্ষক একটি আনন্দের বিষয় হয়ে ওঠে। খুব সাধারণ একটি ঘটনার স্থির চিত্রধারণ মনে হলেও ওই সময়কালের সোশ্যাল ডকুমেন্টারির গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের উদাহরণ ১১ নম্বর ছবিটি।

ছবি-১২ তার স্ট্রিট ফটোগ্রাফির অত্যন্ত চিন্তাশীল আরেকটি কাজের উদাহরণ। বাংলার শ্যামল প্রান্তর ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। নগরায়ণের চাপে নতুন নতুন ধানি জমি ধূসর মাটিতে পরিণত হয়ে যায়। উঁচু উঁচু দালান দাঁড়িয়ে যায় চোখের সামনে হুড়মুড় করে। সূর্যের তাপে তপ্ত জমিনে একটুখানি ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় না। কংক্রিটের বিশাল বিশাল পাইপের মধ্যে একটু শীতলতার আশ্রয়ে শুয়ে আছেন একজন শ্রমিক।
এই আলোচনা আরও দীর্ঘ করা দরকার ছিল। স্থানাভাবে সম্ভব হলো না।
- ছবিগুলো বেগার্ট আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত। যথাযথ অনুমতি ব্যতীত এই ছবিসমূহ ব্যবহার করা যাবে না।
লেখক: তথ্যচিত্র আলোকচিত্রী; প্রিন্সিপাল, ছায়া ইনস্টিটিউট অব কমিউনিকেশন আ্যান্ড ফটোগ্রাফি; সম্পাদক, আলো (আলোকচিত্রবিষয়ক পত্রিকা)।