মেগা প্রকল্প ব্যর্থ হলেও পথ দেখাচ্ছে ‘ডাইভারশন’—যেভাবে বিনা খরচের সহজ উদ্যোগে কমছে ঢাকার যানজট

দীর্ঘদিন ধরেই যানজটে বিপর্যস্ত রাজধানী ঢাকা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকাই যেন নগরবাসীর নিত্যদিনের বাস্তবতা। তবে ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প ব্যর্থ হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের বিনা খরচের এক উদ্যোগ প্রমাণ করছে—বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্ষুদ্র পরিসরের পদক্ষেপেও যানজট অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
শ্যামলী থেকে আজিমপুরে প্রতিদিন অফিসযাত্রী আনা-নেওয়া করা প্রাইভেটকার-চালক শাহজাহান মোল্লা বললেন, "পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ঢাকার বেশিরভাগ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ নতুন ব্যবস্থা নেয়। শুরুতে একটু বিরক্ত লাগত, কিন্তু এখন এর সুফল বুঝতে পারছি।"
"আগে সংসদ ভবন এলাকার কাছে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে সামান্য ঘুরপথ নিলেই কোনো সিগন্যালে থামতে হয় না," যোগ করেন তিনি।
শাহজাহান আরও জানান, সায়েন্স ল্যাব, কলাবাগান ও নীলক্ষেত মোড়ে দেওয়া ডাইভারশনগুলো চলাচলের রাস্তায় যানজট অনেকটাই কমিয়েছে। আগের মতো এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না। পাশের রাস্তাগুলোর চাপও আর মূল সড়কে এসে পড়ে না।
পুরোনো সমস্যার নতুন সমাধান
দুই কোটিরও বেশি মানুষের শহর ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। বহু বছর ধরেই রাজধানীকে পীড়া দিচ্ছে যানজট নিয়ন্ত্রণের দুরবস্থা। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, ২০২৪ সালে তা নেমে আসে মাত্র ৫ কিলোমিটারে—যা ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বিগত বছরগুলোতে সরকার একের পর এক উড়ালসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে ও সিগন্যাল ব্যবস্থায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করলেও যানজট সমস্যার স্থায়ী সমাধান মেলেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অচলাবস্থার কারণে প্রতিবছর কর্মঘণ্টা নষ্ট, উৎপাদনশীলতা হ্রাস, জ্বালানি অপচয় ও জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবসহ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে।
সমস্যার নতুন সমাধান খুঁজতে এ বছর ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ অবলম্বন করে এক ভিন্ন কৌশল। নতুন করে কোনো অবকাঠামো নয়, বরং বিদ্যমান মোড়গুলোর গতিপ্রবাহ নতুনভাবে ডিজাইন (নকশা) করে যান চলাচলের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
ডিএমপি ট্রাফিক উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে যানজট কমাতে বিকল্প সড়ক বা ডাইভারশন ব্যবস্থার ধারণাটি দেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. সারওয়ার, যিনি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ট্রাফিক উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নতুন অবকাঠামো নির্মাণের বদলে ডিএমপি মনোযোগ দেয় বিদ্যমান মোড়গুলোর যানবাহন চলাচলের নকশা পুনর্গঠনে। এ লক্ষ্যেই ৬৯টি ব্যস্ততম মোড়ে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়।
পরিবর্তনগুলো ছিল খুবই সাধারণ, কিন্তু কার্যকর—চারমুখী মোড়ে এক বা দুইটি ছোট সংযোগ সড়ক বন্ধ করা, ঘুরপথ বা টার্নিং পয়েন্টের অবস্থান বদলানো, এবং ভালো দৃশ্যমানতার জায়গায় নতুন ইউ-টার্ন তৈরি বা পুরোনোটি সরিয়ে নেওয়া। এসব ছোটখাটো সমন্বয়ের মাধ্যমেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঢাকার ব্যস্ত মোড়গুলোয় তৈরি হওয়া "গ্রিডলক বক্স" বা যানজটের ঘূর্ণাবর্ত।
অনেক জায়গায় এই পরিবর্তনগুলো ছিল অস্থায়ী এবং সহজেই প্রত্যাহারযোগ্য। ট্রাফিক পুলিশ স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের বদলে ব্যবহার করেছে স্থানান্তরযোগ্য ব্যারিকেড, রঙ ও কোণ। এমনকি কিছু স্থানে বিভাজক তৈরির ব্যয়ও বহন করেছে বেসরকারি পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানগুলো।
"আমি জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ঢাকার ট্রাফিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক ছিল," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. সারওয়ার।
"রাস্তায় প্রায়ই বিক্ষোভ, ফুটপাত দখল আর অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের কারণে চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। বিশ্বের কোথাও আসলে ট্রাফিক সিগন্যাল হাতে নিয়ন্ত্রণ করে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয় না।"
বিদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তিনি চালু করেন ডাইভারশন বা বিকল্প সড়ক ব্যবস্থার ধারণা। "সাধারণভাবে একটি ইন্টারসেকশনের চার দিক থেকে যান চলাচলের ক্ষেত্রে যদি প্রতিটি দিককে তিন মিনিট করে সময় দেওয়া হয়, তবে ওই মোড় ঘুরে আসতে একজনের ১২ মিনিট সময় লাগবে। আমরা ভাবলাম, যদি ডাইভারশন ব্যবহার করে একসঙ্গে শুধু দুই দিকের যান চলাচল চালু রাখা যায়, তাহলে অপেক্ষার সময় ৬ মিনিটে নেমে আসবে," ব্যাখ্যা করেন তিনি।
"শুরুর দিকে দুই-তিনটি মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে এই পদ্ধতি চালু করা হয়, এতে ইতিবাচক সাড়া পাই। এ পর্যন্ত আমরা ৬৯টি ডাইভারশন বাস্তবায়ন করেছি, আরও কিছু কাজ চলছে," বলেন সারওয়ার।
তিনি জানান, পুরো প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে 'জিরো কস্ট' বা বিনা ব্যয়ে—বিদ্যমান ব্যারিকেড ও কোণ ব্যবহার করে, আর যেখানে প্রয়োজন সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বিভাজকও বসানো হয়েছে।
গতি বেড়েছে, কমেছে যানবাহনের সারি
নতুন উদ্যোগের ফল মিলেছে দ্রুতই। ডিএমপির হিসাব অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর গড় গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ১০ কিলোমিটার হয়েছে। কিছু সিগন্যাল পয়েন্টে অপেক্ষার কমে গেছে সময় দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত।
বিজয় সরণি মোড়ে দায়িত্ব পালনকারী সার্জেন্ট সোহেল রানা বলেন, "আগে যেখানে গাড়িগুলোকে সিগন্যালে ৮ থেকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো, এখন ৩ মিনিটের মধ্যেই পার হতে পারে। ডাইভারশন ব্যবস্থার ফলে পূর্ব–পশ্চিমমুখী ট্রাফিক লুপ আকারে ঘোরে, ফলে সিগন্যাল সময়ও কম লাগে। গাড়িগুলো দ্রুত মোড় পার হতে পারছে।"
তেজগাঁও জোনের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সুরুজ জানান, "দীর্ঘদিনের যানজটের কেন্দ্রবিন্দু কারওয়ান বাজারেও এখন পরিস্থিতি বদলেছে। আগে চালকদের ৩০ মিনিট বা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতো। এখন ট্রাফিক অনেকটাই মসৃণভাবে চলছে, আমাদের কাজের চাপও কমেছে," বলেন তিনি।
মাঠপর্যায়ে উদাহরণ
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পরিবর্তিত ১৫টিরও বেশি মোড়ে যান চলাচলে চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার আড়ং মোড়ে আগে গাবতলী থেকে নিউমার্কেটমুখী এবং ধানমন্ডি থেকে গাবতলীগামী যানবাহন একই সিগন্যালে মুখোমুখি হতো, ফলে সৃষ্টি হতো দীর্ঘ যানজট। এখন গাবতলী–নিউমার্কেটগামী গাড়িগুলো সংসদ ভবনের সামনে ইউ-টার্ন নিচ্ছে, এতে মূল সড়ক ফাঁকা থাকছে। আর ফার্মগেটের দিক থেকে আসা যানবাহনগুলোকে এখন মাত্র একটি সিগন্যালেই থামতে হয়।
ধানমন্ডি ২৭ সিগন্যাল থেকে শংকরমুখী যানবাহন আগে মোড় পেরিয়ে একাধিক দিকের গাড়ি চলাচল বাধাগ্রস্ত করত। এখন সেই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; গাড়িগুলো এখন শবনমবাগ মসজিদের সামনে ইউ-টার্ন নিচ্ছে।
শাহবাগ মোড়ে আগে কাটাবনগামী গাড়িগুলোকে বারডেম হাসপাতালের সামনে সিগন্যালে অপেক্ষা করতে হতো। এখন এগুলো ঢাকা ক্লাবের সামনে ইউ-টার্ন নিয়ে সরাসরি চলে যেতে পারছে। এতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের দীর্ঘস্থায়ী যানজট সম্পূর্ণ দূর হয়েছে।
নিউমার্কেট এলাকার নীলক্ষেত মোড়ের সংযোগ সড়ক বন্ধ করে ইডেন কলেজের কাছে একটি নতুন ইউ-টার্ন চালু করা হয়েছে, ফলে নিউমার্কেট থানা মোড়ের যানজটও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিজয় সরণি মোড়ে একটি দিকের প্রবেশপথ বন্ধ করে ফার্মগেটের কাছে নতুন ইউ-টার্ন যুক্ত করা হয়েছে, এতে কাজী নজরুল অ্যাভিনিউমুখী যান চলাচল আরও সহজ হয়েছে।
প্রতিটি জায়গায় চালকদের নতুন রুটে গাড়ি চালানোর জন্য অস্থায়ী ব্যারিকেড, কোণ ও দিকনির্দেশক সাইন ব্যবহার করা হচ্ছে। সার্জেন্ট রানা বলেন, "প্রয়োজন হলে এসব সহজেই সরানো যায়। আগে মানুষ রেগে যেত, এখন আর রাগেন না—বরং তারা নিজেরাই এর সুফল বুঝতে পারছে।"
চালক ও যাত্রীরা পরিবর্তন বুঝতে পরছেন
সাভার–নিউমার্কেট রুটের বাসচালক শিপলু মিয়া বলেন, "আগে আড়ং মোড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। এখন ইউ-টার্ন নিয়ে সরাসরি চলে যাই—কোনো সিগন্যালে আটকে থাকতে হয় না।"
মোটরসাইকেলচালক মাহিদুল ইসলাম বলেন, "এখন যানজট হলেও গাড়ি একদম থেমে থাকে না, ধীরে ধীরে এগোয়—এটা স্বস্তির। এমন ব্যবস্থা আরও জায়গায় চালু করা উচিত।"
শাহবাগের এক যাত্রী বলেন, "জ্যাম অনেক কমেছে ঠিকই, কিন্তু ফুটপাতগুলোর অবস্থা খারাপ। যানবাহনের পাশাপাশি পথচারীদের নিরাপত্তার দিকেও নজর দেওয়া দরকার।"
যানবাহন বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা, নতুন উদ্যোগ সফল হলেও ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ১০ কিলোমিটার—যা এখনও বিশ্বমানের তুলনায় অনেক কম। এই উন্নতি ধরে রাখতে হলে নিয়মিত সমন্বয়, গণপরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনা এবং পথচারী ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করা প্রয়োজন।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকা এই উদ্যোগ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিতে পারে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, "ইন্টারসেকশন ম্যানেজমেন্ট বা মোড় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে যান চলাচল উন্নত করার সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও দ্রুত পদ্ধতি। ব্যাংকক, ম্যানিলা ও জাকার্তাও বড় অবকাঠামো নির্মাণের আগে এমন ব্যবস্থা নিয়েছিল। কার্যকর সমাধানের জন্য নমনীয় (নীতি ও ব্যবস্থাপনা) এবং কঠিন (অবকাঠামো) উভয় ধরনের উদ্যোগই প্রয়োজন।"