লক্ষ্মীপুরের শারমিনের হাতের সয়াফুড যেভাবে এখন রাজধানীর অভিজাত দোকানে

বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদনকারী জেলার মধ্যে প্রধান হলো লক্ষ্মীপুর। সয়াবিন চাষের প্রাচুর্যের কারণে এ জেলা পরিচিত 'সয়াল্যান্ড' নামে। তেলবীজ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশের উৎপাদিত সয়াবিন এত দিন ব্যবহৃত হতো কেবল পোলট্রি, মাছ ও গবাদিপশুর খাবার তৈরিতে। কিন্তু এখন সয়াবিন দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানাধরনের মুখরোচক খাবার।
বিশ্বের সবচেয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও খাদ্যগুণে ভরপুর শস্যগুলোর মধ্যে অন্যতম সয়াবিনে রয়েছে উচ্চমানের প্রোটিন, বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। আর এই পুষ্টিগুণের কথা মাথায় রেখেই বিকল্পভাবে সয়াবিন ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের নারী শারমিন আক্তার।
সয়াবিন দিয়ে তিনি তৈরি করছেন প্রায় ৫০ রকমের মুখরোচক ও আকর্ষণীয় খাবার। তার তৈরি এসব খাবার এখন ঢাকার অভিজাত ফুড শপে বিক্রি হচ্ছে, জনপ্রিয়তাও বাড়ছে দ্রুত।
সয়াবিন দিয়ে তৈরি এসব খাবার স্থানীয়ভাবে পরিচিত 'সয়াফুড' নামে। শারমিনের তৈরি সয়াফুডের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও। সম্প্রতি এই ব্যতিক্রমী উদ্যোক্তাকে দেখার জন্য নেদারল্যান্ডস থেকে কয়েকজন এসেছিলেন তার বাড়িতে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, সয়াবিন দিয়ে শারমিনের তৈরি করেন নানা স্বাদের খাবার—চিপস, সয়া কাবাব, সয়া নাগেটস, সয়া পিঠা, আরও অনেক কিছু।
সয়াফুডের উদ্যোক্তা শারমিন
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর কাদিরা ইউনিয়নের চর ঠিকা গ্রামে থাকেন শারমিন। তার স্বামী মাসুম বাঘা পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান; তিনিই মূলত নানা উপায়ে সহযোগিতা করছেন শারমিনকে সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে। সয়াফুডের উদ্যোগ শুধু তাদের পরিবারের আর্থিক সংকটই দূর করেনি, আশেপাশের বহু নারীরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।
শারমিনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, কয়েকজন নারী ব্যস্ত সয়াফুড তৈরিতে, আর শারমিন দিচ্ছেন নির্দেশনা। ঢাকার অভিজাত ফুড শপে পাঠানোর জন্য তারা তৈরি করছেন বিভিন্ন সয়া-জাত পণ্য।

সেখানে কাজ করা পাপিয়া সুলতানা জানান, "শারমিন শুধু নিজেই সয়াফুড তৈরি করেন না, অন্যদেরও শেখান।"
তিনি জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এসএসিপি প্রকল্প এবং সয়াবিন নিয়ে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শতাধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন শারমিন। পাপিয়া নিজেও তিন মাস ধরে তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
বর্তমানে শারমিনের উদ্যোগে ২৫ জন নারী নিয়মিতভাবে সয়াফুড তৈরির কাজ করছেন। চাহিদা বাড়লে আরও অনেকে যুক্ত হন। প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন তারা পণ্য পাঠান ঢাকায়।
মনিরন বেগম ও পাইনুর বেগম জানান, তারা প্রতিদিন ৪০০ টাকা মজুরি ও দুপুরের খাবার পান। এতে সংসার চলছে, নিজেদের অভাবও অনেকটা দূর হয়েছে। তাদের মতো আরও অনেক নারী আজ শারমিনের হাত ধরে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
শারমিন বলেন, "ঢাকার অভিজাত ফুড শপগুলো থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকার সয়াফুডের অর্ডার পাই। এটা শুধু ব্যবসা নয়, আমাদের গ্রামের নারীদের জীবন পাল্টে দেওয়ার এক নতুন পথ।"
সয়াবিনে দিয়ে কী তৈরি করছেন শারমিন
সয়াফুডের উদ্যোক্তা শারমিন আক্তার বলেন, "এক সময় বাংলাদেশে সয়াবিন ব্যবহৃত হতো শুধু হাঁস, মুরগি, মাছ ও গরুর খাদ্য তৈরিতে। তবে গত সাত-আট বছরে আমরা এই উচ্চমানের খাদ্যশস্য সয়াবিনকে মানুষের জন্য মুখরোচক খাবারে রূপান্তর করতে পেরেছি এবং অনেক ভোক্তা তৈরি করতে পেরেছি। এটা আমাদের জন্য বিশাল এক সাফল্য। আমাদের সয়াফুডের নিজস্ব একটি ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে।"
বর্তমানে সয়াবিন থেকে অন্তত ৫০ ধরনের খাবার তৈরি করছেন শারমিন—যার মধ্যে ৩০ রকমের সয়াফুড পাঠানো হয় ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত ফুডশপে।

"সয়া তফু, সয়া প্রোটিন বল, সয়া দুধ, সয়া কাবাব, সয়া দই, সয়া পায়েশ, সয়া সস, সয়া আটা, সয়া বিস্কুট, সয়া রোল, সয়া মিষ্টি, সয়া জিলাপি, সয়া পরোটা, সয়া সন্দেশ, সয়া বোরহানি, সয়া সমুচা, সয়া সিঙ্গারা—এমন ৫০ ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করছি। এসব খবর বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে," বলেন শারমিন।
সয়াফুডের ভোক্তা কারা
শারমিন জানান, সয়াবিন দিয়ে তৈরি অন্তত ৩০টি পণ্যের ক্রেতা বাংলাদেশের সাধারণ থেকে অভিজাত শ্রেণির মানুষ। তবে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের ক্রেতা কেবল অভিজাত শ্রেণি ও দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকরা।
তিনি বলেন, "সয়াবিনে তৈরি 'তফু' চীন, জাপান, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের কাছে জনপ্রিয়। বর্তমানে সয়া তফুর চাহিদা অনেক বেড়েছে, এর বেশির ভাগ ক্রেতাই বিদেশি।"
শারমিন আরও বলেন, সয়াবিনে তৈরি কিছু খাবারের দাম স্বাভাবিক, কিছু খাবারের দাম তুলনামূলক বেশি। বর্তমানে তিনি ঢাকার অভিজাত চেইন ফুডশপ 'ফৌজিয়া হেলদি ফুড' এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা 'সলিডারিডাট'-এ সয়াফুড সরবরাহ করছেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পরবর্তীতে তার সয়াফুড পণ্য যাচ্ছে রিটেল চেইন শপ ইউনিমার্ট, আগোরা এবং ফুডপান্ডায়।

দামের বিষয়ে জানতে চাইলে শারমিন জানান, ২০০ গ্রামের তফু বিক্রি করেন ৪৫ টাকায়, প্রতিটি প্রোটিন বল ৬ টাকা, সয়া বিস্কুট ৩৫০ গ্রাম ১০০ টাকা, ৭০০ গ্রাম ওজনের ১০ পিস পরোটা ৮০ টাকা, ৬০০ গ্রাম সয়ারুটি ৭৫ টাকা, সয়া সন্দেশ প্রতিটি ১৫ টাকা এবং সয়া রোল প্রতিটি ৫০ টাকায় সরবরাহ করেন। তবে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের পর ভোক্তা পর্যায়ে এসব খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
বিদেশে রপ্তানি হতে পারে সয়াফুড
বর্তমানে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার কৃষকরা প্রতি কেজি সয়াবিন বিক্রি করছেন ৫০–৫৫ টাকায়।
শারমিন, পাপিয়া ও রুপানা জানান, এই এক কেজি সয়াবিন দিয়ে অন্তত ১,৭০০ টাকার খাবার তৈরি করা সম্ভব।
তাদের মতে, সয়াফুডের চাহিদা বাড়লে কৃষকদের উৎপাদিত সয়াবিনের দামও বাড়বে। পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে, অনেকে সয়াবিন থেকেই উচ্চমানের প্রোটিন পাবেন। লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে বিপুল পরিমাণ সয়াফুড উৎপাদন করা গেলে তা বিদেশে রপ্তানিও সম্ভব, কারণ বিদেশিরা সয়াফুড পছন্দ করেন। সয়াবিনভিত্তিক ফুড তৈরি হলে কৃষকরা বর্তমানের তুলনায় অন্তত তিন থেকে চার গুণ বেশি দাম পাবেন বলেও জানান তারা।
উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প
"আমি নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত একজন নারী। ছোটবেলা থেকেই নানা ধরনের খাবার তৈরির প্রতি আমার আগ্রহ ছিল, কিন্তু পারিবারিকভাবে সেই সুযোগ পাইনি,"—বলছিলেন লক্ষ্মীপুরের শারমিন আক্তার।
তিনি জানান, ২০১৮ সালে একটি এনজিওতে সাময়িকভাবে কাজ করার সময় দেখেন, নারীরা সয়াবিন মিশিয়ে পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করছে। সেখান থেকেই তার মাথায় আসে—সয়াবিন দিয়ে কীভাবে মুখরোচক খাবার তৈরি করা যায়। সেই ভাবনা থেকেই শুরু তার সয়াফুডের যাত্রা। প্রথমে নিজেই সয়াবিন দিয়ে নানা পণ্য তৈরি করে স্থানীয় মেলা ও অনুষ্ঠানে বিক্রি করতে থাকেন। এতে তৈরি হয় কিছু স্থায়ী ক্রেতাও।

২০১৯ সালে তিনি ঢাকায় পাঁচ দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন, যেখানে ফুড প্রসেসিং, সংরক্ষণ ও বিপণনের বিষয়ে ধারণা পান। সেখানে একটি চেইন ফুডশপের সঙ্গে পরিচয় হয়, যারা তার তৈরি সয়াপণ্য বাজারজাত করার আশ্বাস দেয়।
প্রশিক্ষণ শেষে তিনি এলাকায় ফিরে আসেন এবং ২৫ জন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করেন। দলবদ্ধভাবে তারা সয়াবিন দিয়ে বিভিন্ন খাবার তৈরি শুরু করেন। প্রতিদিন নারীরা তাদের তৈরি পণ্য শারমিনের বাড়িতে এনে একত্র করেন, সেগুলো নিরাপদে প্যাকিং করে সকালে যাত্রীবাহী বাসে ঢাকায় পাঠানো হয়। ফুডশপের কর্মীরা বাস কাউন্টার থেকেই পণ্য সংগ্রহ করেন। এভাবেই শুরু হয় সয়াফুডের বাণিজ্যিক যাত্রা।
শারমিন বলেন, "এখন ঢাকার বেশ কয়েকটি সুপারশপ আমাদের সয়াপণ্য নিতে আগ্রহী। আমার দেখাদেখি গ্রামের আরও অনেক নারী এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন।"
তিনি জানান, সয়াবিন নিয়ে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মিলে তার গ্রামের নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ নারী তার কাছ থেকে হাতে-কলমে সয়াফুড তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, অনেকেই স্থানীয়ভাবে উৎপাদনও শুরু করেছেন।

সয়াফুড তৈরিতে সহযোগিতার আশ্বাস বিদেশি প্রতিষ্ঠানের
জানা যায়, নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা 'সলিডারিডাট' দীর্ঘদিন ধরে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীল সয়াবিন চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প নিয়ে কাজ করছে। চলতি বছরের জুনে সলিডারিডাট ও নেদারল্যান্ডসের কয়েকজন বাসিন্দা শারমিনের বাড়িতে আসেন এবং স্থানীয় নারী কারিগরদের সঙ্গে কথা বলেন।
শারমিন জানান, সলিডারিডাট তাকে সয়াফুড সংরক্ষণের জন্য কুলিং বক্স, ব্লেন্ডার, ডাইস ও কিছু যন্ত্রপাতি দিয়েছে। তারা বাজারও তৈরি করে দিয়েছে, যা তার পণ্যের বিক্রি বাড়িয়েছে। এখন নির্ধারিত বাজারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় সামাজিক অনুষ্ঠানে সয়া নাস্তা পরিবেশনের প্রচুর অর্ডার পাচ্ছেন তিনি। কয়েক হাজার মানুষের জন্য একসঙ্গে সয়া খাবার তৈরির অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন তারা।
"এই কাজ আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এনেছে। বর্তমানে আমার মাসিক আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। দলের প্রত্যেক নারী মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন। প্রায় ২৫–৩০ জন নারী এখন আমার উদ্যোগে ছোট পরিসরে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন," যোগ করেন তিনি।
শারমিন কমলনগর উপজেলা ও লক্ষ্মীপুর জেলা পর্যায়ে একাধিকবার সেরা উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অর্ডার আসে তার সয়াফুডের জন্য। প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে নারীরা এসে তার কাজ দেখতে ও শিখতে আসেন।

সয়াফুড নিয়ে শারমিনের প্রত্যাশা
শারমিনের লক্ষ্য, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সয়াবিনকে বাংলাদেশের অন্যতম মুখরোচক খাদ্যে পরিণত করা। তার বিশ্বাস, এতে উপকূলীয় এলাকার কৃষকরা সয়াবিন ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন এবং মানুষ অল্প টাকায় পুষ্টিকর খাবার পাবে।
তবে তিনি কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। সয়াফুড তৈরিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দরকার, কিন্তু গ্রামে ঘনঘন লোডশেডিং হয়। এতে সময়মতো পণ্য তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া ভালো মানের কিচেন শেডেরও অভাব রয়েছে, যা আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে নির্মাণ করা যাচ্ছে না।

কী আছে সয়াবিনে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) অনুযায়ী, সয়াবিনে রয়েছে ১০টি খনিজ উপাদান, ১৪টি ভিটামিন ও ৩ ধরনের ফ্যাটি এসিড।
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি জানিয়েছে, সয়া তফু বা সয়াভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী খাবার খেলে স্তন, প্রোস্টেট ও জরায়ুর আস্তরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) তাদের জার্নালে বলেছে, প্রতিদিন ২৫ গ্রাম সয়া প্রোটিন গ্রহণ হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
ছবি: সানা উল্লাহ সানু