১৭ বছরের নির্বাসন শেষে নভেম্বরের মাঝামাঝি দেশে ফিরছেন তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে ফিরতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি নেতার কয়েকজন উপদেষ্টা ও ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকরা তার দেশে ফেরার এই পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তারেকের ঘনিষ্ঠ একজন উপদেষ্টা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অনেক যদি-কিন্তুর পর এখন স্পষ্ট যে আমাদের নেতা নভেম্বরের মাঝামাঝি দেশে ফিরতে চান। নভেম্বরের ১০ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে তিনি ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন ছাড়তে পারেন।'
গত কয়েক মাসে তারেক রহমান লন্ডনে দুজন প্রভাবশালী কূটনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনও। বৈঠকে তারেক দেশে ফেরার ইচ্ছার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
নির্বাসনের এই দীর্ঘ সময় ধরে তারেক বাস করছেন লন্ডনের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহরতলি কিংস্টনে।
সম্প্রতি টিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। সেখানে তিনি বলেন, তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন, তবে চূড়ান্ত তারিখ এখনও ঠিক হয়নি।
দলীয় সূত্রের তথ্যানুসারে, লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে যাত্রা করার কথা রয়েছে তারেকের। এ সময় তার সঙ্গে যুক্তরাজ্য বিএনপির অন্তত দুজন উপদেষ্টা ও নেতা থাকবেন।
দলীয় সূত্র আরও জানায়, লন্ডন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে তারেক ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরব যেতে পারেন। সেখানে তার সঙ্গে বিএনপির দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও পরিবারের সদস্যরা থাকবেন।
বিএনপি নেতার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, 'নিরাপত্তার কারণে আমরা ছাড়ার সঠিক তারিখ ঘোষণা করতে পারছি না। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাই কমিশনের মাধ্যমে ট্রাভেল পাস ইস্যুসহ প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তারেক রহমান এখন ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন (আইএলয়ার) স্ট্যাটাসে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।'
আইএলআর স্ট্যাটাসে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস, কাজ ও পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া যায়; ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্যও আবেদন করা যায়।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও কর্তৃপক্ষের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন দাবি করে লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসনে যান তারেক।
তবে এই ১৭ বছরের নির্বাসনে তারেক ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেননি।
এরই মাঝে গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব বসতি দিবসে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তারেক লেখেন: 'বাসস্থান মানুষের মৌলিক অধিকার। আমরা সবাই একটি নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও সুরক্ষিত বাড়ি প্রাপ্য।'
এদিকে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় নাম না থাকায় তারেককে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত করার জন্য বাংলাদেশ হাই কমিশনের একটি দল সম্প্রতি কিংস্টনের বাড়িতে গিয়ে তার বায়োমেট্রিক তথ্যসহ অন্যান্য নথি সংগ্রহ করেছে।
খালেদা ও তারেকের জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা নতুন বুলেটপ্রুফ মিনিবাস ও তারেক রহমানের জন্য একটি বুলেটপ্রুফ এসইউভি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি।
এই গাড়িগুলোর কেনার অনুমোদনের জন্য বিএনপি ইতিমধ্যে সরকারের কাছে লিখিত আবেদনও দিয়েছে। দলের নেতারা জানান, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ভালো থাকলে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন এবং প্রচারণায় যোগ দেবেন।
এ ধরনের যানবাহন আমদানি করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র প্রয়োজন। মন্ত্রণালয় যেকোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) মাধ্যমে এ ধরনের আবেদন যাচাই-বাছাই করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'প্রায় পাঁচ মাস আগে বিএনপির পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র পাঠানো হয়েছিল। আমরা এসবি রিপোর্ট পাওয়ার পর অনুমতি দিয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'পরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়ির জন্য একটি নতুন আবেদন করা হয়। সেটিরও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গাড়ি দুটো জাপান থেকে আমদানি করা হবে।'
তবে জাপান থেকে ঠিক কোন মডেলের গাড়ি আমদানি করা হচ্ছে, তা টিবিএস নিশ্চিত হতে পারেনি।
নিরাপত্তা-উদ্বেগ
বিএনপির শীর্ষ নেতার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি দেশে ফেরার পর সরকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'তারেক রহমান দেশে ফিরলে আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেব। আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, সবই করা হবে। বিএনপির সব যৌক্তিক অনুরোধ বিবেচনা করা হবে।'
'তবে তাদের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক ডিমান্ড লেটার আসেনি। কিছুদিন আগে খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার সময় বিএনপির অনুরোধ অনুযায়ী নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল,' যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।
পুলিশি প্রোটোকলের বাইরেও চেয়ারপারসনস সিকিউরিটি ফোর্স নামক নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। ১০ সদস্যের এই দলটি বিশেষ পোশাকে সজ্জিত থাকে এবং সবসময় খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ এখন ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনার পর দেশ গণতন্ত্রের যে পথে যাত্রা শুরু করেছে, সেখানে নানা বাধা আসতে পারে। এই যাত্রায় তারেক রহমান সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন—এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'দেশে ফেরার পর তিনি নিষ্ক্রিয় থাকবেন না। মনে রাখতে হবে, প্রচারণা ও নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। সর্বোচ্চ সুরক্ষার মধ্যেও ঝুঁকি থেকে যায়। তাই এ ধরনের ঝুঁকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে রাষ্ট্রকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর উদাহরণ স্মরণ করতে চাই। গণতন্ত্রের পথে যাত্রায় আমরা এই সুযোগ হারাতে পারি না।'