সস্তা ভারতীয় সুতায় যেভাবে পিছিয়ে পড়ছে দেশের টেক্সটাইল শিল্প

প্রতিবেশি ভারত থেকে তুলনামূলক সস্তায় সুতা আমদানি করতে পারায় স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকেই বেশি ঝুঁকছে। এ কারণে দেশীয় টেক্সটাইল কারখানাগুলো তাদের উৎপাদিত সুতা ও কাপড় বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে গুদামগুলোও অবিক্রিত পণ্যে ভরে যাচ্ছে।
টেক্সটাইল উদ্যোক্তারা বলেছেন, গত তিন বছরে ভারত তাদের টেক্সটাইল মিলগুলোর জন্য বিভিন্ন রপ্তানি প্রণোদনা চালু করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এই খাতে সহায়তা কমিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিবেশি দেশটি থেকে প্রতি কেজি সুতা আমদানিতে প্রায় ০.৩০ ডলার সাশ্রয় হচ্ছে।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, 'সরকারের কাছ থেকে রপ্তানিতে বিভিন্ন স্কিমে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার কারণে ভারত স্থানীয় বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে সস্তায় বা ডাম্পিং মূল্যে বিক্রি করছে। এসব তথ্যপ্রমাণ আমরা আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে উপস্থাপন করেছি।'
বিটিএমএর তথ্যমতে, ভারত থেকে সুতা আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে কারখানাগুলোতে সুতা বিক্রি স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে অনেকে ব্রেক ইভেন পয়েন্ট এমনকি লোকসানেও সুতা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বিক্রি না হওয়াসহ অন্যান্য কারণে ৫০টির বেশি টেক্সটাইল মিল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্যোক্তারা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এই খাত বড় সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে।
শওকত আজিজ রাসেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা একটি তালিকা করেছি, তাতে দেখা গেছে সংকটের কারণে ইতোমধ্যে ৫০টির বেশি কারখানা আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের নাম প্রকাশ করতে পারছি না। এতে তাদের ক্ষতি হয়ে যাবে।'
বস্ত্র ও পোশাক কারখানার মালিকেরা জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ৩০ কাউন্টের সুতার দাম প্রতি কেজি প্রায় ২.৪৫ থেকে ৩.০৫ ডলার। অন্যদিকে, ভারতীয় সুতার দাম পড়ছে প্রায় ২.১৯ ডলার (চট্টগ্রাম বন্দরে সিঅ্যান্ড এফ মূল্য অনুযায়ী)। মূল্যের এই পার্থক্যের কারণেই পোশাক প্রস্তুতকারকেরা দেশে উৎপাদিত সুতার পরিবর্তে আমদানি করা সুতার দিকে ক্রমেই বেশি ঝুঁকছে। অথচ দুই বছর আগেও মূল্যের এই পার্থক্য ছিল মাত্র ০.০৫ ডলার।
একই সঙ্গে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সুতা ও কাপড় দেশে আসাও স্থানীয় মিলগুলোর চাহিদা কমার কারণ বলে মনে করেন কারখানা মালিকেরা।
নারায়ণগঞ্জ-ভিত্তিক নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফতুল্লা ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, 'দুই বছর আগেও আমি আমার প্রয়োজনীয় প্রায় সব সুতা দেশীয় টেক্সটাইল মিলগুলো থেকে সংগ্রহ করতাম। আর এখন আমি এর ৯০ শতাংশই আমদানি করি। কারণটা খুবই সাধারণ। এতে প্রতি কেজিতে আমার প্রায় ০.৩০ ডলারের মতো সাশ্রয় হয়।'
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, ভারত থেকে বাংলাদেশে সুতা আমদানি ২০২৪ সালে ৪১ শতাংশ বেড়েছে।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, চলতি বছর আমদানি গত বছরের তুলনায় আরও বেড়েছে। যদিও সেটার পরিমাণ এখানো স্পষ্টভাবে জানা যায়নি।
রপ্তানির জন্য সুতা উৎপাদনকারী দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এনজেড স্পিনিং মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউদজামান খান বলেন, 'বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় সুতা আমদানিতে প্রতি কেজিতে ০.২৫ ডলার থেকে ০.৩০ ডলার সাশ্রয় হওয়ায় নিটওয়্যার মিল মালিকেরা আমদানিতে উৎসাহিত হচ্ছে, যা আগের তুলনায় গত দুই তিন মাসে বেড়েছে। বেশির ভাগ কারখানায় এখন স্টকপাইল হয়ে গেছে। ব্রেক ইভেন পয়েন্ট এমনকি লোকসানেও বিক্রি করতে হচ্ছে।'
বিটিএমএর তথ্যমতে, দেশের টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা এক হাজার ৮৬৩টি। এর মধ্যে স্পিনিং মিল ৫২৭টি। এসব স্পিনিং মিলের মধ্যে প্রায় ৩০০টি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত।
বিটিএমএর অন্তত দুজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রপ্তানির চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানি সঙ্গে জড়িত ৭৩টি মিল স্থানীয় বাজারে সুতা বিক্রি শুরু করেছে। এর বড় একটি অংশই ভ্যাট দিচ্ছে না। ফলে ভ্যাট পরিশোধ করে বিক্রি করা স্থানীয় মিলগুলো বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়েছে এবং স্থানীয় বাজারেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, টেক্সটাইল খাত সংকটে পড়লে এর সঙ্গে ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, লজিস্টিকসসহ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
পোশাক খাতে অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এখন টেক্সটাইল খাতে পারতপক্ষে টার্ম লোনে (মেয়াদি ঋণ) অর্থায়ন করছি না। ওয়ার্কিং ক্যাপিটালে অর্থায়নও একেবারেই কমিয়ে দিয়েছি। আমাদের অর্থায়ন করা প্রায় সবগুলো টেক্সটাইল মিল এখন টিকে থাকার জন্য স্ট্রাগল করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এ খাতে করা অর্থায়ন নিয়ে আমরা শঙ্কায় পড়ে গেছি। কিছু কারখানা প্রতি কেজি সুতা তিন ডলারের নিচে বিক্রি করলে লোকসান হচ্ছে দেখছি। কিন্তু তারা এর চেয়েও কম মূল্যে বিক্রি করছে।'
টেক্সটাইল মিল মালিকেরা বলছেন, স্থানীয় মিলগুলোর নিটওয়্যার খাতে শতভাগ এবং ওভেন পোশাকের ৫০ শতাংশ সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসসের বাজারের আকার বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার, যার পুরোটাই স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে।
কেন ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো পিছিয়ে পড়ছে?
উদ্যোক্তারা বলছেন, গত তিন বছর ধরে ভারত তাদের টেক্সটাইল মিল উদ্যোক্তাদের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য একের পর এক প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রণোদনা প্রত্যাহার করছে। এর ফলে বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিল মালিকেরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাচ্ছেন।
সালেউদজামান খান বলেন, রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর মওকুফসহ বিভিন্ন ভর্তুকি এবং রাজ্যপর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার কারণে সেখানকার টেক্সটাইল মিল মালিকেরা রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত ০.২০ থেকে ০.২৫ ডলার লাভ করেন। একই সময়ে বাংলাদেশে নগদ প্রণোদনা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ইউটিলিটি ব্যয় বৃদ্ধি, তহবিলের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভারতীয় সুতা রপ্তানিকারকরা বাড়তি সুবিধার কারণে বাংলাদেশে সস্তায়, এমনকি সেখানকার স্থানীয় বাজারের চেয়ও কম মূল্যে, অর্থাৎ ডাম্পিং মূল্যে বাংলাদেশে রপ্তানি করছে।
বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকে দায়ী করছেন টেক্সটাইল মিল মালিকেরা
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, 'এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্ড মিসইউজ ও চোরাই পথে আসা সুতা। কাস্টমসের নির্লিপ্ততার সুযোগে এবং ৩২ শতাংশ ওয়েস্টেজ অনুমোদনের কারণে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সুতা ও ফেব্রিক দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এ কারণে স্থানীয় মিলগুলো তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছে না।'
তিনি বলেন, দেশে ১২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাকের বাজার থাকলেও স্থানীয় মিলগুলোর বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ মাত্র সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। বাকি সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ সুতা ও ফেব্রিক অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে, যা মিলগুলোর সুতা বিক্রি না হওয়ার অন্যতম কারণ।
নারায়ণগঞ্জভিত্তিক স্পিনিং মিল শাহ ফতেহউল্লাহ গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদ আলম বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উন্মুক্ত বাজারে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত সুতা ও কাপড়ের অবৈধ বিক্রয়কে দায়ী করেন। তিনি বলেন, 'আমরা বহুবার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, কিন্তু এই চক্র এখনো বন্ধ হয়নি।'
তবে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা মনে করেন, বন্ডের অপব্যবহারের এই অভিযোগ পুরোপুরি সঠিক নয়।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, 'বন্ড মিসইউজ কেউ কেউ করলেও এর পরিমাণ খুবই কম। বাস্তবতা হলো ভারত আর বাংলাদেশে পলিসি সহায়তার কমবেশি হওয়ায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।'
সুতা রাখার জায়গা নেই গোডাউনেও
শাহ ফতেহউল্লাহ টেক্সটাইল মিলসের মালিকেরা জানান, বিক্রি কমে যাওয়ায় তাদের গুদামগুলো সুতায় পূর্ণ হয়ে গেছে। এমনকি কারখানার ভেতরেও বিক্রি না হওয়া সুতা রাখতে হচ্ছে।
শহীদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের গুদামগুলো ভর্তি হয়ে গেছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় এখন কারখানার ভেতরেই সুতা রাখতে হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে ২৫ হাজার স্পিন্ডলের উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। শীঘ্রই আরও ২৫ হাজার স্পিন্ডল বন্ধ করার পরিকল্পনা করছি।'
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলমও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'সাধারণত আমাদের উৎপাদিত সুতার প্রায় ১০ শতাংশ মজুত থাকে। কিন্তু গত তিন মাসে তা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গুদামেও জায়গা ফুরিয়ে গেছে।'
তিনি জানান, দেশের বেশির ভাগ স্পিনিং মিলই এখন এই সংকটের সম্মুখীন।
আবেদ টেক্সটাইল প্রসেসিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'বছরের এই সময়টায় রঙ ও প্রিন্টিংয়ের চাহিদা কিছুটা কম থাকে। তবুও আমরা সাধারণত ৭০ শতাংশ সক্ষমতায় উৎপাদন চালাতাম। কিন্তু এবার তা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বাজার এখন আমদানিকৃত সুতা ও কাপড়ে ভরে গেছে। ফলে স্থানীয় পণ্যের চাহিদা কমে গেছে।' তার মতে, স্থানীয় সুতা ব্যবহারে নগদ প্রণোদনা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার সরকারি সিদ্ধান্তও এ চাহিদা কমার একটি বড় কারণ।