জীবনানন্দ তবুও আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি

অফিসে আপনি টয়লেটে গেলে খাতায় সময় নোট করে রাখা হত। আপনার কাজের জায়গার টেবিল থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল একে একে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কবিতার বই প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। অবিক্রিত বই যাতে গছিয়ে না দেয় তাই দপ্তরীকে দেখে দৌঁড়ে পালাচ্ছেন।
তবু আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
লেখকের বাড়ি গিয়ে চিঠি লিখে একটি পত্রিকা আপনি সম্পাদনা করলেন, অথচ সম্পাদক হিসেবে অন্য নাম ছাপা হল। আপনার দেখা পরীক্ষার খাতা আপনার অজান্তে অন্য কোনো পরীক্ষককে দিয়ে পুনরায় পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হত।
তবু আপনি কখনও ঘুরে দাঁড়াননি।
টিউশনিতে কামাই হলে আপনার মাইনে থেকে সমানুপাতিক টাকা কেটে নেওয়া হত। ছাত্র আপনাকে টিটকারি দিত, 'জীবনানন্দের মাহিনা', ছাত্রী লকেট ঠিক করার বাহানায় আপনাকে প্ররোচিত করত। রাত জেগে দিস্তার পর দিস্তা নোট লিখেছেন আপনি, আর সেই নোট অন্যের নামে প্রকাশিত হত।
তবু আপনি মুখ ফুটে কিছু বলেননি।
ক্লাসের ছাত্ররা কাগজ গোল্লা করে আপনাকে ছুঁড়ে মারত, বিল্লি ডাকত, আপনার নাম ব্যাঙ্গ করে উচ্চারণ করা হত। সজনীকান্ত দাস আপনাকে নিয়ে তাঁর পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কুৎসা করত। সহকর্মীর স্ত্রী আপনার কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করত। নৌকো ভ্রমণে গিয়ে আপনার কবিতা নিয়ে বন্ধুরা এমন রসিকতা শুরু করল যে, আপনি মাঝপথে নেমে যেতে বাধ্য হলেন।
তবু আপনি প্রতিকারের কোনো পথ বেছে নেননি।
অনেক এলেবেলে লেখা যত্ন করে পত্রিকার ওপরে ছাপা হত আর আপনারটা সবার নিচে, অথবা লেখা বাতিল হত। গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন না, লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াতেন, হীনমন্যতায় ভুগতেন। ছেঁড়া চটি পরে কীভাবে কবিতা পাঠ করতে যাবেন ভেবে সঙ্কুচিত হয়েছিলেন।
তবু আপনি নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলেছিলেন।
আপনার কবিতা থেকে লাইনের পর লাইন বাদ দিয়ে তা প্রকাশ করা হয়েছে। একটা ডিম বেশি চাইলে বউয়ের মুখঝামটা খেতে হয়েছে। গামছা পরে বড়ো রাস্তা পেরিয়ে বালতি বালতি জল তুলতে হত। সকালে বাড়িতে চা অবধি জুটত না, পাড়ার দোকানে গিয়ে চা খেতে হত।
তবু আপনি কখনও টুঁ-শব্দ করেননি।
আপনার প্রেমিকা আপনাকে নিয়ে রঙ্গরসিকতা করত, চেহারা নিয়ে খোঁটা দিত, দিনের পর দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছেন। সবসময় ভাবতেন আপনার জন্যই আপনার সন্তান এত কুৎসিত। ভাবতেন মাথায় টাক পড়ে যাচ্ছে, অন্ধ হয়ে যাবেন, রক্তে দোষ ধরা পড়বে।
তবু আপনি সমাধানের চেষ্টা করেননি।
চাকরি খুঁজতে গিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন, ছাতার বাঁট বিক্রি থেকে জীবন বিমা—নানান জীবিকার কথা ভাবতে হয়েছে। একটা বিশুদ্ধ চাকরি কেউ দেয়নি। আহত হয়ে হাসপাতালের মাটিতে রক্তাক্ত ও নোংরা অবস্থায় পড়ে ছিলেন। স্ত্রী আপনার আহত হওয়ার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেননি।
আপনি ভেবেছেন এগুলো আপনার প্রাপ্য।
শুধু ডায়েরিতে লিখবেন:
'...কোনো দিন কি table turned হবে? তা হলে দেখিয়ে দিতাম মজা...কিন্তু তা তো হবে না, আমিই চিরকাল অনেকের কাছে underdog হয়ে থাকব & shall make them feel the pleasures of top dogs.'
এবং 'under dog' হয়ে অপেক্ষা করেছেন শুধু কখন সময়ের চাকা ঘুরবে! সময়ের চাকা ঘোরেনি। ১৯টি উপন্যাস, ১২৭টি গল্প, ২৫০৭টি কবিতা ও ৪০০০ পৃষ্ঠার ডায়েরি অপ্রকাশিত রেখে পৃথিবীর অন্যতম এক মন্থরতম যানে চাপা পড়ে মারা গেলেন।
তখনও আপনার মুখে একচিলতে তামাশার হাসি লেগে ছিল। পৃথিবীর রগড় দেখছিলেন আপনি।
পৃথিবীর সমস্ত ব্যর্থ, অসফল ও মন্থর মানুষের প্রতিনিধি আপনি।
তবে স্যার, আপনার জীবনে শুধুমাত্র একটিই প্রতিবাদ। মোক্ষম থাপ্পড়। দাবার শেষ চালে জব্দ করেছেন সবাইকে।
এবং তা আপনার লেখা।
আজ আপনার চলে যাওয়ার দিন নয়, বারবার ফিরে আসার একটি নশ্বর দিন শুধু। নিটশের ভাষায়, শাশ্বত প্রত্যাবর্তন।
আপনার কবিতা দিয়েই আপনাকে প্রণাম স্যার:
নীরবে মোমের বাতি ঘুরে উড়ে টেবিলের বইয়ে নিজের ছায়াকে নিজে ফসকায়ে যায়
ধবল ঘোড়াকে ধীরে সুস্থে চাবকিয়ে
হৃদয়ের অন্ধকারে যেন কারা সময় ডিঙায় মানুষের হৃদয়ের স্মৃতি তবু হেমন্তের রাতে ব্রহ্মান্ডের মতো বড়ো গোলাকার বলে
সেই সব আবছায়া সীমানা ফুরলে
পুনরায় ধরা পড়ে যায় হাতে হাতে।
(অপ্রকাশিত একটি কবিতার অংশ)
লেখক: জীবনানন্দ গবেষক