স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সরকারি কেনাকাটায় ১০% মার্জিন বাতিলের সিদ্ধান্ত

ঠিকাদার, রাজনীতিক ও অসাধু কর্মকর্তাদের চক্র ভাঙতে সরকারি কেনাকাটায় উদ্বৃত দরের ১০ শতাংশ কম বা বেশি দাম প্রস্তাব করলে দরপত্র বাতিল হওয়ার বিধান বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিযোগীতা বাড়ানো, নতুন দরদাতাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের চলমান বাজেট সহায়তা প্রাপ্তির শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে 'আইডেন্টিফায়িং লিমিটেশনস এন্ড ডিটারমাইনিং হোয়াট টু ডু ইন এপ্লাইয়িং দ্য রুলস এন্ড রেগুলেশনস অফ পিপিএ ২০০৬ এন্ড পিপিআর ২০০৮ ইন দ্য প্রকিউরমেন্ট প্রসেস' শিনোরামে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
সভায় অর্থ উপদেষ্টাসহ চারজন উপদেষ্টা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পূর্ত ও প্রকৌশল কাজ করে থাকেন— এমন সংস্থাগুলোর প্রধান প্রকৌশলীরা উপস্থিত ছিলেন।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন দেশের বাইরে থাকায়, সভায় বিভাগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত সচিব ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস।
তিনি জানান, সরকারি কেনাকাটায় অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলেও সভার মূল ফোকাস ছিল উদ্বৃত দরের ১০ শতাংশ কম বা বেশি হলে সেগুলো বাতিল করা হবে।
তিনি বলেন, উদ্বৃত দরের ১০ শতাংশ কম বা বেশি দর প্রস্তাবের কারণে দরপত্র বাতিল হওয়ায় সব ঠিকাদার প্রাক্বলিত মূল্যের ১০ শতাংশ কম দর প্রস্তাব করে থাকেন।
একাধিক ঠিকাদার একই মূল্য প্রস্তাব করলে লটারির পরিবর্তে বিদ্যমান পারফরম্যান্স ম্যাট্রিক্সের ভিত্তিতে ঠিকাদার নির্ধারণ করায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে, এমন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই বার বার নতুন কাজ পায়। এর ফলে কিছু সংখ্যক ঠিকাদারের কাছে কাজ পুঞ্জিভূত হওয়ায় বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো এক দিকে যেমন ঝুঁকিতে থাকে, অন্য দিকে নতুন ঠিকাদার আসার পথও রূদ্ধ হয়ে যায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "সরকারি কেনাকাটা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির একটি বড় অংশ হয়ে থাকে দরপত্র আহ্বানে সরকারের উদ্বৃত দরের ১০শতাংশ কম-বেশি হলে তা বাতিল করার বিধানের কারণে। তাই সরকার এই বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে তা খুবই ইতিবাচক হবে।"
তিনি বলেন, শুধু এই বিধান পরিবর্তন করেই সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনা যাবে না। এক্ষেত্রে দুর্নীতির আরও অনেক সুযোগ আছে। তাই পুরো আইন পর্যালোচনা করে সংস্কার আনতে হবে।
"সরকার কিছু ক্ষেত্রে ই-জিপি চালু করেছে। কিন্তু সেখানেও অপব্যাবহার হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ই-জিপি'র আওতায় কেনাকাটা করছে না। সরকারি কেনাকাটায় ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করবে হবে," বলেন তিনি।
টিআইবি'র এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ অনুযায়ী উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের উদ্দেশ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই আইন অনুসারে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে দরদাতার দর ১০ শতাংশ কম বা বেশি হলে দরপত্র প্রস্তাব বাতিল হবে। এই পরিস্থিতিকে পুঁজি করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা যোগসাজশের মাধ্যমে কিছু ঠিকাদারের কাছে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত দর ফাঁস করে দেন। আর ঠিকাদাররা নিজেদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন যে, কোন কোন প্রতিষ্ঠান দরপত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে এবং কারা নেবে না। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্ভাব্য দরদাতাদের দরপত্র জমাদানে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মির্জা আশফাকুর রহমান বলেন, "সভায় অভ্যন্তরীণ কার্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে বিদ্যমান ১০ শতাংশের বিধান বিলুপ্ত করার বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আয়োজনের মাধ্যমে পরবর্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।"
এর আলোকে পিপিএ ২০০৬ সংশোধন ও ই-জিপি গাইডলাইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্তও এসেছে সভা থেকে।
তিনি আরও করেন, "১০ শতাংশ সংক্রান্ত বিধান প্রত্যাহার করা হলে ঠিকাদারদের যোসাজশে অস্বাভাবিক নিম্নদর প্রস্তাবের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। ফলে এবনর্মালি লো বিড (এএলবি) প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে বিপিপিএ কর্তৃক একটি কারিগরি ওয়ার্কিং গ্রুপও গঠন করা হয়েছে।"
তিনি জানান, ক্রয় প্রক্রিয়ায় বিধি বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা চিহ্নিতকরণ এবং তা দূরীকরণের লক্ষ্যে বিপিপিএ বিদ্যমান আইন সংশোধনের জন্য ২০২১ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
অর্থ বিভাগের সচিবকে আহ্বায়ক করে গঠন করা কমিটির মাধ্যমে সংশোধিত আইনের খসড়া সিসিইএ তে উপস্থাপন করা হলেও তা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি অর্থ বিভাগ থেকে জানানো হয় যে, বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশ সরকারকে ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট (ডিপিসি) এর আওতায় বাজেট সহায়তা প্রদানের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম হিসেবে দেশের আর্থিক, রাজস্ব ও জনসেবা খাতে নানাবিধ পলিসি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে।
এরমধ্যে এই ১০ শতাংশের কোটা বাতিল করা এবং সরকারের সব কেনাকাটা ই-জিপি সিস্টেমে সম্পন্ন করার মতো বিষয়গুলোও রয়েছে।
এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধনের লক্ষ্যে ৩২টি স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ইতোমধ্যে অংশীজন সভার আয়োজন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিপিপিএ প্রধান।
সভার কার্যবিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, ড ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সভায় বলেন, সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সম-আচরণ ও অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে অর্থের সর্বোত্তম মূল্য (ভ্যালু ফর মানি) অর্জনে সরকারি ক্রয় বিধি-বিধান প্রয়োগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং ক্রয়কারী কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা চিহ্নিত করে সমাধানে করণীয় নির্ধারণ করা জরুরি।
কার্য বিবরণী অনুযায়ী, একই নামের কোম্পানি একাধিক কাজ করে যাচ্ছে বলে সভায় দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এক্ষেত্রে ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।