মালয়েশিয়ায় আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন: কারা অংশ নেবেন? আলোচনার টেবিলে কী কী থাকছে?
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের ৪৭তম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বিশ্বের প্রায় দুই ডজন নেতা মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আসছেন। রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনের পাশাপাশি আরও একাধিক পার্শ্ব বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
আসিয়ান কী এবং কারা অংশ নিচ্ছেন?
আসিয়ান মূলত ১০টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত—ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের তথ্যমতে, এই দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা ৬৭ কোটি ৮০ লাখ এবং মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩.৯ ট্রিলিয়ন ডলার।
এ বছর আসিয়ান তার ১১তম সদস্য হিসেবে পূর্ব তিমুরকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। দেশটি ২০০২ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং এর জনসংখ্যা ১৪ লাখ।
এবারের সম্মেলনে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ছাড়া জোটের সব দেশের নেতারা অংশ নেবেন।
আসিয়ান সম্মেলনের পাশাপাশি প্রতিবছর ইস্ট এশিয়া সামিট বা পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। এতে আসিয়ান দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নেতারা যোগ দেন।
এ বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ, জাপানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ুং এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাক্সন সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন।
রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন।
এছাড়াও কুয়ালালামপুরে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাও উপস্থিত থাকবেন।
মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বারনামা জানিয়েছে, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ফিফা নামে পরিচিত ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলের প্রধানেরাও কয়েকটি অধিবেশনে যোগ দেবেন।
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার 'শান্তিচুক্তি' সই
আসিয়ান ও পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের বাইরেও কুয়ালালামপুরে প্রভাবশালী দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে আসিয়ানের পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া একটি যৌথ 'শান্তিচুক্তি' স্বাক্ষর করেছে। রোববার মালয়েশিয়ায় এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যেকার সাম্প্রতিক উত্তেজনার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটল।
আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প রোববার মালয়েশিয়ায় অবতরণ করেন। কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এবং স্থানীয় নৃত্যশিল্পীদের একটি দল অভ্যর্থনা জানায়। রেড কার্পেটে নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে নাচে অংশ নেওয়ার পর ট্রাম্প এক হাতে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ও অন্য হাতে মালয়েশিয়ার পতাকা নিয়ে লিমুজিনে চড়ে শহরের দিকে রওনা দেন।
চুক্তির আগে ট্রাম্প বলেন, জুলাইয়ে থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর 'তাদের চারজনের মধ্যে অনেক ফোনালাপ হয়েছে', এবং তার প্রশাসন 'সংঘাত থামাতে সক্ষম হয়েছে'। ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি শান্তিচুক্তি করাতে অত্যন্ত পারদর্শী এবং এক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘের চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেন।
কাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তার 'সতর্ক নেতৃত্ব' এবং 'অবিরাম প্রচেষ্টা' ছাড়া শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হত না। তিনি বলেন, 'যতই জটিল ও কঠিন বিবাদ হোক, তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা উচিত।'
হুন মানেত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকেও ধন্যবাদ জানান এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা প্রকাশ করেন।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অনুতিনও ট্রাম্পের চেষ্টা এবং থাইল্যান্ডের রাজমাতা সিরিকিতের মৃত্যুর পর তার সমবেদনা জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অস্ত্র সরানো এবং যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি 'শিগগিরই' শুরু হবে, এবং এই চুক্তি 'স্থিতিশীল শান্তির ভিত্তি' হিসেবে কাজ করবে, যদি তা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
গত জুলাই মাসে দুই দেশের সীমান্তে টানা পাঁচ দিনের ভয়াবহ সংঘর্ষের পর ট্রাম্পই তাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি মধ্যস্থতা করেছিলেন। ওই সংঘর্ষে অন্তত ৪৮ জন নিহত হন এবং প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন—যা ছিল সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় সীমান্ত সহিংসতা।
তবে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল শুক্রবার দেশটির রাজমাতা সিরিকিতের মৃত্যুর কারণে অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন, পরে সিদ্ধান্ত বদলে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে মালয়েশিয়া পৌঁছান।
এত বড় আয়োজন সত্ত্বেও কিছু সমালোচক প্রশ্ন তুলেছেন, এই চুক্তিটি একটি স্থায়ী সমাধানের চেয়ে ট্রাম্পের জন্য ছবি তোলার সুযোগই বেশি হবে কিনা। খেমার মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির সভাপতি ও কম্বোডিয়ার সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী মু সোচুয়ার মতে, জুলাই মাস থেকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে এবং সীমান্ত নির্ধারণের মূল সমস্যাটিরও কোনো সমাধান হয়নি।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকিই থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে সাহায্য করেছে। এই পদক্ষেপ স্বল্প মেয়াদে কার্যকর হলেও এটি বেশ বিতর্কিত।
তিনি বলেন, 'উভয় দেশের সমালোচকরা বলছেন, এটি অর্থনৈতিক ব্ল্যাকমেইলের সামিল। এখানে ন্যায়বিচার, সার্বভৌমত্ব বা স্থানীয় চাহিদা পূরণের পরিবর্তে বাণিজ্য সুবিধার জন্য শান্তি বিনিময় করা হচ্ছে।'
আলোচনার টেবিলে কোন কোন বিষয়?
আসিয়ান সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক এবং উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য বিরল খনিজ পদার্থ বা রেয়ার আর্থ মিনারেল প্রাপ্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। এই খনিজ পদার্থের উৎপাদনে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ট্রাম্প এপ্রিলে বেশিরভাগ বাণিজ্য অংশীদারের বিরুদ্ধে 'লিবারেশন ডে ট্যারিফস' চালু করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর, আসিয়ানের বেশিরভাগ দেশের জন্য মার্কিন শুল্কের হার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়েছে, তবে ব্রুনাইয়ের জন্য এই হার ২৫ শতাংশ। লাওস ও মিয়ানমারের জন্য শুল্কের হার ৪০ শতাংশ। ট্রাম্পের শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় চীন রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যার প্রভাব বিশ্বজুড়ে অনুভূত হচ্ছে।
পেশাদার পরিষেবা সংস্থা ডেজান শিরা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের আসিয়ান ডিরেক্টর মার্কো ফস্টার আল জাজিরাকে বলেন, বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজবেন। তিনি বলেন, 'প্রায় সবাই তার (ট্রাম্পের) পেছনে ছুটবে অথবা তাদের চুক্তি নিয়ে কথা বলার জন্য তার বা তার লোকদের সঙ্গে একই কক্ষে থাকার চেষ্টা করবে। সবাই ট্রাম্পের সঙ্গে একটি পার্শ্ব বৈঠক করতে চাইবে।'
এছাড়াও মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গজিয়ে ওঠা স্ক্যাম সেন্টারগুলোর বিস্তার নিয়েও আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই স্ক্যাম সেন্টারগুলো থেকে অপরাধী চক্রগুলো কয়েক হাজার কোটি ডলার আয় করেছে।
মিয়ানমার কেন সম্মেলনে নেই?
২০২১ সাল থেকে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না। এ কারণে আগামী বছর মালয়েশিয়ার পর আসিয়ানের সভাপতিত্বও গ্রহণ করবে না মিয়ানমার। এর পরিবর্তে এই দায়িত্ব ফিলিপাইনের কাছে যাবে।
২০২১ সালে আসিয়ান মিয়ানমার সংকট নিরসনে পাঁচ দফা ঐকমত্য প্রকাশ করেছিল, যেখানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা প্রদান এবং সংকট মধ্যস্থতার জন্য একজন বিশেষ দূত নিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছিল। চার বছর পরেও সমালোচকরা বলছেন, এই ঐকমত্যের তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।
আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের সহ-সভাপতি চার্লস সান্তিয়াগো আল জাজিরাকে বলেন, তিনি আশা করছেন সম্মেলনে মিয়ানমার এবং এর গৃহযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, 'নিরাপত্তা এবং সামাজিক সংহতি—উভয় ক্ষেত্রেই মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশে একটি অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তিনি আরও যোগ করেন, এই গৃহযুদ্ধ মাদক ও অস্ত্রের চোরাচালান বাড়িয়ে দিয়েছে এবং একটি শরণার্থী সংকট তৈরি করেছে।
তবে আসিয়ান সম্মেলন থেকে বড় কোনো ফল আসবে বলে মনে করেন না সান্তিয়াগো। তিনি বলেন, 'এটি সবার জন্য ছবি তোলার একটি বড় সুযোগ হবে,' তবে নীতিগত দিক থেকে 'তেমন কিছুই ঘটবে না।'
আসিয়ানের সীমাবদ্ধতা কোথায়?
সদস্য দেশগুলোকে সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার মতো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় আসিয়ান প্রায়শই সমালোচিত হয়। এখানেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো অন্যান্য আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে এর পার্থক্য, কারণ ইইউ-এর সদস্যদের অবশ্যই জোটের আইন ও রায় মেনে চলতে হয়।
মিয়ানমার সংকট এবং কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্ত বিরোধের মতো বিষয়গুলোতে সম্প্রতি এই সমালোচনা জোরালো হয়েছে।
মার্কো ফস্টার বলেন, এই বৈশিষ্ট্যটি আসিয়ানের অনন্য ইতিহাসের একটি অংশ। বিশ্বজুড়ে উপনিবেশবাদের অবসানের পর ১৯৬৭ সালে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর কাঠামো সেই সময়ের আদর্শকেই প্রতিফলিত করে।
ফস্টার বলেন, 'যেহেতু আসিয়ান স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো থেকে জন্ম নিয়েছে, তাই এটি কখনোই এমন একটি সংগঠনে পরিণত হবে না যা সদস্য দেশগুলোর স্বাধীনতাকে সীমিত করবে। কোনো রাষ্ট্রই তার ঊর্ধ্বে থাকা কোনো সংস্থার নিয়ম মেনে নেবে না। আসিয়ানে রাষ্ট্র সবসময়ই এক নম্বরে থাকবে।'
