বুলডোজার আর বলরুম: হোয়াইট হাউসে নিজের স্থায়ী ছাপ রেখে গেলেন ট্রাম্প
এই মাসের শুরুতে হোয়াইট হাউসের নতুন বলরুম নির্মাণের জন্য অর্থদাতাদের সঙ্গে এক নৈশভোজে বসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই আসরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর মতো উচ্ছ্বাসে ভরা একটি গল্প শোনান তিনি।
ট্রাম্প বলেন, 'আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাজ শুরু করতে কত সময় লাগবে? তারা জানাল, "স্যার, আজ রাত থেকেই শুরু করতে পারেন, কোনো অনুমতির দরকার নেই।" আমি অবাক হয়ে বললাম, "সত্যি?" তারা বলল, "স্যার, আপনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট—আপনি যা চান, তাই করতে পারেন।"'
এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় হোয়াইট হাউসের পূর্ব দিকের ঐতিহাসিক 'ইস্ট উইং'। কয়েক দশকের ইতিহাসের প্রতীক সেই অংশ মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ইতিহাসবিদ, সংরক্ষণবাদী, বিরোধী দল ডেমোক্র্যাট এবং সাধারণ মানুষ।
কিন্তু ট্রাম্প পেয়েছেন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য—৩শ' মিলিয়ন ডলারের নতুন বিলাসবহুল বলরুম নির্মাণের জন্য একদম খালি জায়গা।
সমালোচকদের মতে, হোয়াইট হাউজের ইস্ট উইং ভাঙার এই ঘটনা ট্রাম্পের প্রকৃত শাসনেরই প্রতিচ্ছবি—যেখানে তিনি দেশের নীতি, আন্তর্জাতিক সংস্থা আর বিশ্বব্যবস্থার প্রচলিত ধারাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের মতো করে পথ তৈরি করেছেন।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপে ফুটে উঠেছে একজন ডেভেলপারের মানসিকতা, কোনো ঐতিহ্যের রক্ষকের নয়।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ জেরেমি সুরি বলেন, 'এটা আসলে ডেভেলপারের মানসিকতা—নিজের নামে বড় কিছু নির্মাণ করে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাওয়া। যেন আরেকটা "ট্রাম্প টাওয়ার"—শুধু এবার সেটা বলরুম আকারে।'
অ্যাপল, অ্যামাজন, লকহিড মার্টিন ও মেটার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, 'রিয়েল এস্টেটের দিক থেকে ভাবলে, এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে না। এটা এক দারুণ সুযোগ।'
তার প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানান, বলরুমটিরও একটি নাম থাকবে, যদিও কী নাম হবে, তা এখনো জানানো হয়নি।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, নিজের নামে নামকরণ করার ইচ্ছা তার নেই। তবুও ইতিহাসবিদদের মতে, ৯০ হাজার বর্গফুটের এই স্থাপনা ভবিষ্যতে চিরকালই ট্রাম্পের নামের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
হোয়াইট হাউস হিস্টোরিকাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড লেঙ্গেল বলেন, 'এখন সবাই হোয়াইট হাউসের পাশে এমন এক বিশাল ভবন দেখবে, যা এক ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করবে। আর সেটা পরিকল্পিতভাবেই।'
এর আগেও ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে নিজের রুচি ও প্রভাবের ছাপ রেখেছেন—ওভাল অফিসে সোনালি সাজসজ্জা, পাকা করা রোজ গার্ডেন, সর্বত্র নিজের প্রতিকৃতি এবং নতুন করে স্থাপন করা বিশাল আমেরিকান পতাকা।
তিনি এমনকি ওয়াশিংটন ডিসিকেও পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন—কেনেডি সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন এবং ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্যারিসের 'আর্ক দ্য ত্রিয়ম্ফ'-এর অনুকরণে এক বিশাল স্মারক নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন।
ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা টেইলর বুদোভিচ বলেন, 'ট্রাম্প একজন দূরদর্শী নির্মাতা। রাজনীতি, ব্যবসা কিংবা জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই তিনি ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখতে পান। এই বলরুম প্রকল্পও তারই প্রমাণ।'
তবে বলরুম নিয়ে বিরোধী মহলে উঠেছে তীব্র সমালোচনা। অনেকে বলছেন, এত বড় সিদ্ধান্তে জনগণের মতামত বা আইনগত পর্যালোচনা ছিল না। ট্রাম্পের সহযোগীরা অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, 'তার সব স্থাপনাই বিশ্বমানের। এই বলরুমও হবে তেমনই এক অসাধারণ স্থাপনা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপভোগ করবে মানুষ।'
আগের প্রশাসনগুলো যেখানে কংগ্রেসের অনুমোদন ও সরকারি অর্থে সংস্কার করেছে, সেখানে ট্রাম্পের বলরুম নির্মিত হচ্ছে বেসরকারি অনুদানে—যার ফলে সরকারি তদারকির সুযোগও সীমিত। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, নকশা জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হবে, তবে সেই কমিশনের এখতিয়ার শুধু নির্মাণে, ধ্বংসে নয়।
ইতিহাসবিদ লেঙ্গেল বলেন, 'প্রশাসন দুর্বলতাগুলো ভালোভাবে বুঝে সেগুলোকে খুব দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে।'
যদিও হোয়াইট হাউস দাবি করছে, তারা প্রকল্প নিয়ে স্বচ্ছ থেকেছে—নকশা প্রকাশ করেছে এবং খোলাখুলি আলোচনা করেছে। কিন্তু ধ্বংসের সিদ্ধান্তে কোনো সংস্থা বা কমিটির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন মেলেনি।
ইতিহাসবিদ এলেন ফিৎসপ্যাট্রিকের মতে, 'এই ঘটনাই দেখায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সেই সীমাহীন ক্ষমতার ধারণা, যেখানে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জনগণকে জানানো বা পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয় না।'
