৬৮৬ মিলিয়ন ডলারে পাকিস্তানের এফ-১৬ আপগ্রেড করে ভারতকে কি কোনো বার্তা দিতে চান ট্রাম্প?
ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বহর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে উন্নত প্রযুক্তি এবং যন্ত্রাংশ বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৬৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
চলতি বছরের মে মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে এক সশস্ত্র হামলার জেরে দুই দেশের মধ্যে পাঁচ দিনের যুদ্ধ হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তি হলো।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তাদের কাছ থেকে আরও অস্ত্র কেনার জন্য চাপ দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে কী চুক্তি হয়েছে?
ব্রাসেলস-ভিত্তিক এনজিও 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ'-এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীণ ডন্থি আল জাজিরাকে জানান, এই প্যাকেজ অনুমোদনটি মূলত পাকিস্তানের এফ-১৬ বহর সচল রাখতে ২০২২ সালে হওয়া রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তিরই একটি অংশ।
তিনি বলেন, 'এফ-১৬ চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ কারণেই কিছু বিলম্ব সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন থেকে ট্রাম্প প্রশাসন পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। উভয় পক্ষই এই অঞ্চলের সন্ত্রাসদমন কার্যক্রমে এই বিমানবহরের উপযোগিতার ওপর জোর দিয়ে থাকে।'
গত ৪ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসকে দেওয়া ডিফেন্স সিকিউরিটি কো-অপারেশন এজেন্সির (ডিএসসিএ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য প্রযুক্তি বিক্রির মাধ্যমে পাকিস্তানের বর্তমান এফ-১৬ বহরের সক্ষমতা বাড়ানো।
ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের হাতে বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০টি সচল এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এর মধ্যে কিছু পুরনো কিন্তু আপগ্রেড করা 'ব্লক ১৫' মডেল, কিছু জর্ডান থেকে আনা এফ-১৬ এবং কিছু নতুন 'ব্লক ৫২ প্লাস' মডেলের বিমান।
যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সুবিধার মধ্যে রয়েছে—ফ্লাইট অপারেশন ও বিমানের ইলেকট্রনিক সিস্টেম উন্নত করার জন্য হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার আপডেট; 'অ্যাডভান্সড আইডেন্টিফিকেশন ফ্রেন্ড অর ফো' (আইএফএফ) সিস্টেম—যা দিয়ে পাইলটরা শত্রু ও মিত্র বিমান আলাদা করতে পারেন; নেভিগেশন আপগ্রেড; খুচরা যন্ত্রাংশ এবং মেরামত সুবিধা।
এফ-১৬ এর রক্ষণাবেক্ষণ ও আপগ্রেড বাবদ ৬৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের পাশাপাশি ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের প্রধান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামও (এমডিই) বিক্রি করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে ৯২টি লিঙ্ক-১৬ সিস্টেম। এটি একটি সুরক্ষিত সামরিক ডেটা লিঙ্ক নেটওয়ার্ক, যা সামরিক বিমান, জাহাজ ও স্থল বাহিনীর মধ্যে 'রিয়েল-টাইম' যোগাযোগ স্থাপন করে।
এছাড়াও প্রশিক্ষণের জন্য ছয়টি এমকে-৮২ বোমার নিষ্ক্রিয় খোলস বা বডি বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এগুলো মূলত ৫০০ পাউন্ড ওজনের সাধারণ বোমার খালি ধাতব খোলস। এর ভেতরে টিএনটি বা বিস্ফোরকের বদলে কংক্রিট বা বালির মতো ভারী উপাদান ভরা থাকে, যা প্রশিক্ষণ বা পরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়।
এমকে-৮২ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি আনগাইডেড বা দিকনির্দেশনাহীন বোমা, তবে এটি প্রিসিশন-গাইডেড বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী অস্ত্রের ওয়ারহেড হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান আসলে কী?
এফ-১৬, যা 'ফাইটিং ফ্যালকন' বা 'ভাইপার' নামেও পরিচিত, একটি এক ইঞ্জিনের যুদ্ধবিমান। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আকাশযুদ্ধে এবং আকাশ থেকে ভূমিতে হামলার জন্য এটি ব্যবহার করে।
বর্তমানে এই বিমানগুলো তৈরি করে মার্কিন প্রতিরক্ষা ও মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন, যারা ১৯৯৫ সালে এর উৎপাদনের দায়িত্ব নেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষের দিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি মিগ বিমানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ভারী ও ধীরগতির বিমানগুলোকে নাস্তানাবুদ করছিল, তখন এফ-১৬ তৈরি করা হয়। ১৯৭৪ সালে এটি প্রথম আকাশে ওড়ে।
লকহিড মার্টিনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ২৯টি দেশে এফ-১৬ ব্যবহৃত হচ্ছে। পাকিস্তান ছাড়াও ইউক্রেন, তুরস্ক, ইসরায়েল, মিশর, পোল্যান্ড, গ্রিস, তাইওয়ান, চিলি, সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং নরওয়ের মতো দেশগুলোর হাতে এই বিমান রয়েছে।
মে মাসের ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে এফ-১৬ এর ভূমিকা
গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পেহেলগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহত হন। 'দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট' (টিআরএফ) এই হামলার দায় স্বীকার করে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র টিআরএফ-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। নয়াদিল্লির অভিযোগ, এর সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার (এলইটি) যোগসাজশ রয়েছে, যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
পেহেলগাম হামলার পর নয়াদিল্লি ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে দেয় এবং সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে।
এরপর ৭ মে ভারত পাকিস্তানের ৯টি স্থানে এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইসলামাবাদের দাবি, এতে বহু বেসামরিক লোক নিহত হন। পরবর্তী তিন দিন দুই দেশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে একে অপরের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে তীব্র আকাশযুদ্ধে লিপ্ত হয়।
পাকিস্তানের এয়ার ভাইস মার্শাল আওরঙ্গজেব আহমেদের তথ্যমতে, ওই আকাশযুদ্ধে পাকিস্তান এফ-১৬, চীনা তৈরি জেএফ-১৭ এবং জে-১০সহ ৪২টি উচ্চপ্রযুক্তির বিমান মোতায়েন করেছিল। শেষ পর্যন্ত ১০ মে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, যার কৃতিত্ব দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে?
হ্যাঁ, এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। পাকিস্তানের এফ-১৬ আপগ্রেডের অনুমোদন এমন একসময়ে এল, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও অস্ত্র কেনার জন্য চাপ দিচ্ছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আগস্টে ভারত মার্কিন অস্ত্র ও বিমান কেনার পরিকল্পনা স্থগিত করে। এর ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগেই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের কথা ছিল, যা পরে বাতিল হয়ে যায়।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উত্তেজনাও দেখা গেছে। গত ৬ আগস্ট সস্তায় রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনায় ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় আমদানির ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর আগে থেকেই ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ছিল, ফলে মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে।
এক নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প এই শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান একটি 'জাতীয় জরুরি অবস্থা' তৈরি করেছে এবং ভারতের মতো রাশিয়ার তেলের বড় ক্রেতার ওপর বর্ধিত শুল্ক আরোপ করা 'প্রয়োজনীয় এবং যথাযথ'। তিনি বলেন, 'আমি দেখতে পেয়েছি যে ভারত সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়ান ফেডারেশনের তেল আমদানি করছে।'
মার্কিন চাপের মুখে ভারত রাশিয়ার তেল কেনা কিছুটা কমালেও নয়াদিল্লি মস্কো থেকে তেল কেনা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। চীনের পরে ভারতই রাশিয়ার তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। গত সপ্তাহে দিল্লিতে পুতিন ও মোদির বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে পুতিন ঘোষণা দেন, 'রাশিয়া ভারতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের জন্য প্রস্তুত।'
পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও আপগ্রেড সংক্রান্ত সর্বশেষ মার্কিন চুক্তিটি ভারত ভালোভাবে নেবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষক প্রবীণ ডন্থি বলেন, 'নয়াদিল্লি আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিরোধিতা করে আসছে। ভারতের দাবি, এফ-১৬ বিমানগুলো তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়। তবে ওয়াশিংটন এবার আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে, এই বিক্রি অঞ্চলের মৌলিক সামরিক ভারসাম্য পরিবর্তন করবে না।'
ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান আল জাজিরাকে বলেন, 'এখানে ভারতের বিষয়টি আমি খুব বড় করে দেখব না। অবশ্য কেউ কেউ এই চুক্তিকে ওয়াশিংটনের একটি কৌশল হিসেবে দেখতে পারেন—যেখানে পাকিস্তানকে সুবিধা দিয়ে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে বাণিজ্য আলোচনায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেয়।'
তবে তিনি যোগ করেন, 'এই চুক্তির নিজস্ব একটি যৌক্তিকতা রয়েছে, যা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।' এটি মূলত পাকিস্তানের হাতে থাকা মার্কিন তৈরি বিমানগুলোকে সচল রাখার একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির অংশ। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল কোনো কৌশল নয়, বরং সমান্তরালভাবে দুটি দেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখছে।
পাকিস্তানের জন্য এই চুক্তি কতটা শক্তিশালী?
মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, এই প্যাকেজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানকে দেওয়া অন্যতম বড় নিরাপত্তা সহায়তা প্যাকেজ এটি। প্রায় ৭০ কোটি ডলারের এই প্যাকেজকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।'
যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি প্রমাণ করে যে ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাসদমন সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কুগেলম্যান বলেন, 'বাণিজ্য বা খনিজ সম্পদের বিষয়টি আলোচনায় এলেও, সন্ত্রাসদমনে সহযোগিতা—তা যতই সীমিত পরিসরে হোক—এই প্রশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।'
তবে প্রবীণ ডন্থি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই প্যাকেজ ২০৪০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের এফ-১৬ বহর সচল রাখতে সহায়তা করবে ঠিকই, কিন্তু সুইডিশ থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক 'এসআইপিআরআই'-এর তথ্যমতে, ২০২০ সাল থেকে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশেরও বেশি অস্ত্র সরবরাহ করেছে চীন।
ডন্থি আরও বলেন, 'মে মাসের সংঘাতে পাকিস্তান চীনের তৈরি জে-১০ বিমান ব্যবহার করেছে। ইসলামাবাদ মূলত ওয়াশিংটন ও বেইজিং—উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে এবং দুই পক্ষের কাছ থেকেই সুবিধা আদায় করছে।'
