যুদ্ধ শেষ করার প্রস্তাব এখনও পড়েননি জেলেনস্কি, ট্রাম্প বললেন আমি ‘হতাশ’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে তিনি "হতাশ", কারণ জেলেনস্কি এখনো রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ শেষ করার সর্বশেষ মার্কিন প্রস্তাবটি পড়ে দেখেননি।
জেলেনস্কি সোমবার ইউরোপের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসার প্রস্তুতি নেওয়ার মধ্যে ট্রাম্পের সমালোচনা কিয়েভের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করেছে। ইউরোপজুড়ে আশঙ্কা বেড়েছে—ওয়াশিংটন এমন একটি শান্তি-সমাধান চাপিয়ে দিতে চাইছে, যা ক্রেমলিনের জন্য বেশি সুবিধাজনক হতে পারে।
এদিকে রাশিয়া এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো পরিকল্পনাকে সমর্থন করেনি এবং পূর্বের মতোই কঠোর শর্তে অটল রয়েছে। অন্যদিকে জেলেনস্কি সোমবার বলেছেন, আলোচকরা এখনো দুটি মূল ইস্যু—ভূখন্ডগত ছাড় ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা—নিয়ে বিভক্ত।
শান্তি প্রস্তাবের সংশোধিত সংস্করণ নিয়ে মস্কো যাওয়ার পর ট্রাম্পের দলের সদস্যরা মিয়ামিতে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। তবে ওয়াশিংটনের এই কূটনৈতিক তৎপরতা এখনো কোনো বড় অগ্রগতি এনে দিতে পারেনি।
এরমধ্যে রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, "আমি একটু হতাশ যে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এখনো প্রস্তাবটি পড়েননি।"
ট্রাম্প শান্তি-প্রস্তাবের যে সংস্করণের কথা বলছেন, তা যে ঠিক কোনটি—সেটি স্পষ্ট নয়।
ওয়াশিংটনে কেনেডি সেন্টার অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানের রেড কার্পেটে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেন, "তার দেশের (ইউক্রেনের) মানুষ প্রস্তাবটি ভালোবাসে। কিন্তু সে এখনো দেখেনি। রাশিয়ারও এতে সমস্যা নেই।"
তিনি আরও বলেন, "আপনারা জানেন, রাশিয়া—সম্ভবত পুরো দেশটাই নিতে চাইবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস রাশিয়া এই প্রস্তাবের ব্যাপারে রাজি আছে, তবে জেলেনস্কি এনিয়ে সহমত কি না, তা নিশ্চিত নই। তার জনগণ এটি চায়, কিন্তু সে পড়েনি।"
তবে ট্রাম্প যে ইঙ্গিত দিয়েছেন—মস্কো নাকি সর্বশেষ সংস্করণের প্রস্তাবে 'রাজি আছে'— যদিও ক্রেমলিন সেই দাবিকে সরাসরি নাকচ করেছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ রোববার বলেন, খসড়ায় "কিছু বিষয়ে" আমেরিকান পক্ষকে "ব্যাপক পরিবর্তন" আনতে হবে।
এই অবস্থায় ইউক্রেনের প্রধান আলোচক ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ জানিয়েছেন, সর্বশেষ আলোচনার পর তিনি সোমবারই ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টকে ব্রিফ করবেন।
সামাজিক মাধ্যমে এক্স–এ (পূর্বে টুইটার) দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেছেন, "ইউক্রেনীয় দলের প্রধান কাজ ছিল মার্কিন পক্ষের মস্কোতে হওয়া আলোচনার পূর্ণ বিবরণ এবং সব খসড়া প্রস্তাব সংগ্রহ করা, যাতে সেগুলো বিস্তারিতভাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করা যায়।" তিনি যোগ করেন, "আমরা সর্বোচ্চ গতি নিয়ে কাজ করছি।"
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য জেলেনস্কির কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এতে সাড়া দেয়নি তার কার্যালয়।
গত রোববার রাতে নিয়মিত ভাষণে জেলেনস্কি জানান, তিনি ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন—যারা গত সপ্তাহে মস্কোয় পুতিনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার বৈঠক করেছেন। তিনি বলেন, "মার্কিন দূতেরা ইউক্রেনের মূল অবস্থান সম্পর্কে অবগত, এবং আলাপটি ছিল গঠনমূলক, যদিও সহজ ছিল না।"
আজকে এক পৃথক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি জানান, মার্কিন পরিকল্পনার কয়েকটি উপাদান নিয়ে এখনো "সংবেদনশীল বিষয়ে" আরও আলোচনা প্রয়োজন। ডনবাস অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়েও এখনো "একক অবস্থান" তৈরি হয়নি। সাম্প্রতিক ব্লুমবার্গ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ডনবাস—যা পুতিন পুরোপুরি দখল করতে চান—এখনো আংশিক ইউক্রেনীয় নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিষয়টি অত্যন্ত জটিল।
ট্রাম্প একটি ২৮ দফা শান্তি-পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন, যাতে ইউক্রেনকে ওই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবসহ এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যা রাশিয়ার পক্ষে সুবিধাজনক বলে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন। কিয়েভ এবং ইউরোপের তীব্র আপত্তির পর পরিকল্পনাটিতে একাধিক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
ট্রাম্পের বিদায়ী ইউক্রেন দূত কিথ কেলগ সপ্তাহান্তে বলেছেন, যুদ্ধ শেষ করার চুক্তি "খুব, খুব কাছাকাছি," তবে দুটি বিষয় এখনো ঝুলে আছে—পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল এবং ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক স্থাপনা জাপোরিঝঝিয়া পরমাণু কেন্দ্র, যা এখন রাশিয়ার দখলে। কেলগ বলেন, "এই দুটি ইস্যু নিষ্পত্তি করতে পারলে, বাকি বিষয়গুলো সহজেই সমাধান হবে।"
কিন্তু প্রেসিডেন্টের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র ইঙ্গিত দিয়েছেন, তার বাবা শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসতেও পারেন। কাতারে আয়োজিত এক ফোরামে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আর কিয়েভের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী নয়।
এদিকে ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন পেতে আজ সোমবার লন্ডনে এসেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে মিলে নতুন শান্তিপ্রস্তাব চাপিয়ে দিতে চান ইউক্রেনের ওপর, এমন আশঙ্কা থেকে আলোচনার টেবিলে জায়গা নিশ্চিত করা নিয়ে ইউরোপীয় নেতারা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
ইউরোপ কি ইউক্রেনকে সমর্থনে অসহায়—এমন প্রশ্নে, ইইউ–এর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কায়া কালাস এনবিসি নিউজকে বলেন, তিনি এমনটা মনে করেন না। দোহায় আয়োজিত ফোরামে তিনি বলেন, "আপনি বলতে পারেন না যে আমরা অসহায়। আমরা আসলে যথেষ্ট শক্তিশালী।" তিনি আরও বলেন, "আমাদের নিজেদের শক্তিকে ছোট করে দেখা উচিত নয় এবং রাশিয়ার শক্তিকে অতিরঞ্জিত করাও উচিত নয়। তাদের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় নেই।"
এদিকে ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ পাওয়ার পর ইউরোপে উদ্বেগ বেড়েছে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখে না। কিন্তু ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এই দলিলকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বলেছেন, এটি রাশিয়ার নিজের অবস্থানের সঙ্গে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি মন্তব্য করেন, "এতে সংঘাত নয়, বরং সংলাপের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।"
