ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধের ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ ৫ দিক

শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনের নেতা স্বদিচ্ছা না দেখানো পর্যন্ত – দেশটিকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সব সামরিক সহায়তা স্থগিত থাকবে বলে গত সোমবার গণমাধ্যমকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের একদিন পরেই এ বিষয়ে নিশ্চিত করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।
প্রভাবশালী একটি মার্কিন দৈনিক এর আগে পূর্বাভাস দিয়েছিল, এমন পরিস্থিতিতে (ট্রাম্প সামরিক সহায়তা প্রদান বন্ধ করলে) চলতি গ্রীষ্ম পর্যন্ত বর্তমান গতিতে লড়তে পারবে ইউক্রেন। হোয়াইট হাউসে বিদেশি একজন সরকারপ্রধানের সঙ্গে এমন আচরণ নজিরবিহীন। এ ঘটনা এবং সামরিক সহায়তা বন্ধের প্রভাব নিয়ে মূলত পাঁচটি বিষয় উঠে আসছে। এগুলো হলো—
১. ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতায় আসলেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন
গত শুক্রবার হোয়াইস হাউস সফরের বিপর্যয়ের পর জেলেনস্কি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। একইসঙ্গে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়াসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর সেনা সহায়তা চান তিনি।
ট্রাম্পের কাছে এসব আহ্বান অগ্রহণযোগ্য; তিনি সাফ জানিয়ে দেন, জেলেনস্কি যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি করবেন।
আর এজন্যই তিনি সামরিক সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, যুদ্ধসরঞ্জাম দেওয়া বন্ধ না করলে জেলেনস্কিকে শান্তি আলোচনার টেবিলে বসানো যাবে না। এই কৌশল কাজেও দিয়েছে। সম্প্রতি ভলোদিমির জেলেনস্কি তাকে এক চিঠি পাঠিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
২. ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে গোপনে একটি চুক্তি হয়েছে
এর আগে গত সপ্তাহে ট্রাম্প বলেছিলেন, একটি যুদ্ধবিরতি অনতিবিলম্বে কার্যকর করা হবে। একথার মাধ্যমে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর একটি গোপন সমঝোতা হয়েছে।
এরপরেও ইউক্রেনের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার আগপর্যন্ত স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করা যায় না। কারণ, জেলেনস্কি নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাঁর সম্মতি দিয়েছেন। তবে এই নির্বাচনের জন্য জেলেনস্কির জারি করা মার্শাল ল' প্রত্যাহার করতে হবে। আর সেজন্য আগে দরকার একটি যুদ্ধবিরতি।
৩. কিন্তু বিস্তৃত একটি চুক্তিতে এখনও হয়নি তাঁদের মধ্যে
ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে গোপন চুক্তির এই অনুমান সঠিক হলে— বলা যায় দুই নেতার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার খুঁটিনাটির বিষয়ে এখনো কোনো বিস্তৃত চুক্তি বা ঐকমত্য হয়নি।
কারণ, যুদ্ধাবসানের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের সীমান্তকে চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ এবং শান্তিরক্ষী পাঠানোর মতো বিষয়গুলোতে ঐকমত্য এখনো হওয়া বাকি। আর ইউক্রেনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনের আগে– তা হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
বর্তমানে যেসব মুখোমুখি অবস্থানে দুইপক্ষের সেনারা যুদ্ধ করছে (সামরিক পরিভাষায় লাইন অব কন্ট্যাক্ট) সেটিই যে শেষপর্যন্ত নির্ধারিত সীমান্ত হবে এমনটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া, পশ্চিমা দেশগুলোর শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের বিষয়েও রাশিয়ার আপত্তি আছে।
৪. গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পোল্যান্ড
প্রতিবেশী পোলান্ডের মাধ্যমেই পশ্চিমা দেশগুলোর দেওয়া প্রায় ৯০ শতাংশ সামরিক সহায়তা পায় ইউক্রেন। ট্রাম্প পোল্যান্ডকে হয়তো বলবেন, যাতে ইউরোপীয় দেশগুলো পোল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে এ ধরনের সহায়তা না পাঠাতে পারে। বিশেষত, যুদ্ধবিরতির সময়টাতে।
ট্রাম্প চান না যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স বা জার্মানির উৎসাহে ইউক্রেন আরও বেপরোয়া হয়ে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করুক বা রাশিয়াকে তা করার উস্কানি দিক। তাই এটি নিশ্চিত করতে তিনি পোল্যান্ডকে বিভিন্ন সুবিধার প্রস্তাব দিতে পারেন। যারমধ্যে একটি হতে পারে, দেশটির নিরাপত্তা জোরদারে সেখানে আরও মার্কিন সেনা মোতায়েন। এইক্ষেত্রে ট্রাম্প জার্মানির ঘাঁটিগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা সরিয়ে এনে পোল্যান্ডে উপস্থিতি বাড়াতে পারেন। এতে করে, জার্মানির বদলে পোল্যান্ডই হয়ে উঠতে পারে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার।
৫. 'নতুন দাঁতাত'-ই ট্রাম্পের শীর্ষ অগ্রাধিকারে
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের ট্রাম্প ও পুতিনের প্রথম ফোনালাপের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বড় পদক্ষেপের ক্ষেত্রেই রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র দাঁতাত (উত্তেজনা প্রশমন) এর কৌশলগত লক্ষ্যকে সামনে রাখা হয়েছে। বিরোধী দুই শক্তির মধ্যে ব্যাপক অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংঘাতের ঝুঁকি কমানোর এই পন্থা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দাঁতাত হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও।
এ লক্ষ্য অর্জনেই ছুটছেন ট্রাম্প। একারণেই তিনি ইউক্রেনকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দেওয়া স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আন্তঃআটলান্টিক সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক এবং আমেরিকান আধিপত্যবাদের প্রকৃতি — এসবই আজ সবার চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে, যখন ট্রাম্প জেলেনস্কিকে শান্তি আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করছেন।
সবশেষ তিনি যা করেছেন, ইউক্রেন ও ইউরোপের দৃষ্টিতে তা একটি কঠিন পরিস্থিতি। কিন্তু, এর প্রতিক্রিয়ায় আক্ষেপে আহাজারি করা, এবং ট্রাম্পের সব দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই তাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই এখন তুরুপের সব তাস। গেল শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পও তাই বলেছেন জেলেনস্কিকে। এর উল্টো যারা বুঝবে, তাদের সেই ভুলের মাশুলও দিতে হবে।