রাজউকে মাসের পর মাস আটকে আছে ফাইল, ভোগান্তিতে গ্রাহকেরা

চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর গুলশান এলাকার একজন জমি মালিক একটি বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) আবেদন করেন। কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর চার মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার ফাইল আটকে থাকায় তিনি এখনও নির্মাণের অনুমতি পাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই জমি মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি চার মাস ধরে রাজউকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, কিন্তু তারা [আবেদন অনুমোদনের জন্য] কোনো মিটিং করতে পারছে না বলে বারবার সময় নিচ্ছে।'
ওই ব্যক্তি বলেন, 'আমি সব ধরনের কাগজপত্রসহ ফাইল জমা দিয়েছি। এই ফাইল অনুমোদনের জন্য দুই সপ্তাহের বেশি সময় লাগার কথা না। কিন্তু মিটিংয়ের দোহাই দিয়ে ফাইল ঝুলে আছে।'
ওই জমি মালিক আফসোস করে বলেন, 'ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে। বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, বিশেষ করে রড আগেই কিনে রাখায় মরিচা পড়ে যাচ্ছে।'
জানুয়ারিতে তিনি রাজউকে আবেদন জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু এখনও কোনো অগ্রগতির তথ্য তিনি জানতে পারেননি। ফলে তার ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
এই দুজনের মতো আরও অনেক গ্রাহক, আবাসন ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন তাদের প্রকল্পের জন্য রাজউকের অনুমোদন একই ধরনের বিলম্বের শিকার হয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন।
রাজউক সূত্র জানায়, জনবল সংকটের পাশাপাশি সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ অদক্ষতা ও অভ্যন্তরীণ অদক্ষতার কারণেই এই বিলম্ব হচ্ছে।
সম্প্রতি এই প্রতিবেদক রাজউকের কেন্দ্রীয় অফিসের বেশ কয়েকটি কক্ষ সরেজমিনে ঘুরে ও রাজউকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে শত শত ফাইল আটকে থাকার জটিলতার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে।
পরিকল্পনা, এস্টেট ও ভূমি, প্রশাসন ও অর্থ—রাজউকের এই প্রধান তিনটি উইংয়ের অফিস ঘুরে দেখা যায়, কক্ষগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফাইল স্তূপ হয়ে আছে।
এস্টেট ও ভূমি উইংয়ের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, গত দুই মাস ধরে অফিস কক্ষে ফাইল জমছে। 'কয়েকশো ফাইল জমা আছে বিভিন্ন দপ্তরে।'
ভবন ও প্লটের ধরন (ক্যাটাগরি) পরিবর্তন এবং প্লট একত্রীকরণসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাইল দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে আটকে আছে।
টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে রাজউকের কর্মকর্তারা বলেন, ফাইল আটকে থাকার মূল কারণ ঘন ঘন নেতৃত্ব পরিবর্তন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা থাকা।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) মো. নুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে রাজউকের বোর্ড মিটিং হচ্ছে না। এছাড়া বোর্ডে ৫ জন সদস্যের মধ্যে এতদিন মাত্র ২ জন সদস্য ছিলেন। ফলে জট লেগে গেছে।
তবে নতুন করে এস্টেট ও ভূমি উইংয়ে নতুন একজন সদস্য নিয়োগ হওয়ায় আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ফাইলগুলো অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় যাওয়া সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। 'এজন্য একটু সময় লাগবে।'
এছাড়া রাজউকে কাজে ধীরগতির আরেকটি কারণ, ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যূত্থানে হাসিনা সরকারে পতনের পর অনেক কর্মকর্তার অনুপস্থিতি। জুলাই অভ্যুত্থানের পরে অনেকেই নিয়মিত অফিস করতেন না।
পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডিসহ বদলি ও চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটে।
কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের ঠিক তিন দিন পরে পুনর্বহাল করার পরে ভবনের অনুমোদনসহ নিয়মিত নানা কার্যক্রমে শিথিলতা চলে আসে।
তবে গত ৮ মার্চ প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলাম রাজউকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও সংস্থাটি কোনো বোর্ড মিটিং আয়োজন করতে পারেনি।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প ও নকশা) মো. মোবারক হোসেন টিবিএসকে বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে বর্তমানে তিনজন সদস্যের মধ্যে একজন দুই মাসের প্রশিক্ষণ ছুটিতে আছেন। যদিও তাকে নিয়মিত অফিস সময়ের পরে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ফলে বোর্ড সভাগুলো অফিস সময়ের বাইরে আয়োজন করতে হবে—যা কাজে খুব বেশি গতি আনবে না বলে ধারণা করছেন গ্রাহক ও নগর বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, এই স্থবিরতা ঢাকার ইতিমধ্যেই বিশৃঙ্খল নগরায়ণকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের (রিহ্যাব) একজন প্রতিনিধি বলেন, 'রাজউকের অদক্ষতার কারণে ডেভেলপাররা অবৈধ নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ আইনি অনুমোদন পেতে অনেক বেশি সময় লাগছে।'
এছাড়া বিশেষজ্ঞরাও জন-আস্থা পুনরুদ্ধার এবং সময়োপযোগী সেবা নিশ্চিত করার জন্য রাজউকে জরুরি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলাম এই চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, 'একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ফলে মিটিংগুলো করতে পারব। মিটিংগুলো সম্পন্ন করতে পারলেই ফাইল আটকে থাকার চাপ কমে যাবে।'
রেজাউল ইসলাম বলেন, চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি মন্ত্রণালয়ে লোকবল বৃদ্ধির জন্য বলে আসছেন। 'বিশেষ করে যে উইংগুলোতে সদস্যপদ খালি রয়েছে, সেগুলো নিয়ে চাপ দিচ্ছি।'