বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে রাজউক?

উত্তরায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর জোন-২ এর এস্টেট ও ভূমি উন্নয়ন শাখাসহ পূর্ণাঙ্গ অফিস রয়েছে। তবে বিকেন্দ্রীকরণের বদলে এই অফিসকে কেন্দ্রীকরণের আওতায় এনে রাজউকের মতিঝিল প্রধান কার্যালয়ে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে- যার সমালোচনা করছেন পরিকল্পনাবিদ এবং নগরবাসীরা।
গ্রাহকদেরকে সহজে সেবার আওতায় আনতে এর আগে রাজউককে ৮টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। কিন্তু উত্তরার এস্টেট ও ভূমি উন্নয়ন শাখা মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে স্থানান্তরের এই সিদ্ধান্তটি রাজউকের পূর্ববর্তী বিকেন্দ্রীকরণ প্রচেষ্টার সম্পূর্ণ বিপরীত।
জানা যায়, ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে তত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজউককে বিকেন্দ্রীকরণ করে উত্তরার গ্রাহকদের ভোগান্তি কমানোর জন্য জোন-২ এর স্টেট ও ভূমি উন্নয়ন শাখা প্রধান কার্যালয় থেকে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু রাজউক সেই বিকেন্দ্রীকরণের পথ থেকে সরে এসে স্টেট ও ভূমি উন্নয়ন শাখা শুধুমাত্র প্রধান কার্যালয় থেকে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজউকের এস্টেট ও ভূমি উন্নয়ন শাখার কাজের মধ্যে রয়েছে, উত্তরাধিকার সূত্রে নামজারি, বণ্টন সূত্রে নামজারি, সম্পত্তি হস্তান্তর, দান (হেবা), প্লট হস্তান্তর, দলিল রেজিস্ট্রি অনুমতি, ফ্ল্যাট হস্তান্তর, দান কিংবা বণ্টন, ইমারত নির্মাণের নকশা অনুমোদনের ছাড়পত্র, আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক ঋণ, বিভিন্ন বরাদ্দপত্র, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির হস্তান্তর কিংবা ভাগ, আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক কিংবা বাণিজ্যিক থেকে আবাসিকে রূপান্তর, প্লট দখল সংক্রান্তসহ গ্রাহক সম্পর্কিত নানাবিধ কার্যক্রম এই শাখার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়– যা সম্পন্ন করতে নিয়মিত হাজিরাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে অফিসে হাজির হতে হয় গ্রাহকদের।
উত্তরার রাজউক জোনাল অফিস-২ এর গ্রাহক আলাউদ্দিন খন্দকার টিবিএসকে বলেন, "আমার মায়ের সম্পত্তি আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন পরপরই আমার বৃদ্ধ মা-কে নিয়ে জোনাল অফিসে আসতে হয়। কিন্তু স্টেট ও ভূমি উন্নয়ন শাখা মতিঝিল নিয়ে গেলে আমাদের ভোগান্তির শেষ হবে না।"
"হাজিরা দেওয়াটা আমার বৃদ্ধ মায়ের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এমন হটকারি সিদ্ধান্ত না নিয়ে, বরং রাজউকের সেবা আরও সহজ করা দরকার," বলেন তিনি।
রাজউকের উপ-পরিচালক, (এস্টেট ও ভূমি-২) মো. আসাদুজ্জামান বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, "অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই অফিস থেকে প্রধান কার্যালয়ে যেতে দুই মাসের মতো সময় লাগবে। ফাইল নিয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসার ভোগান্তি এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রাজউক-এর বোর্ড মিটিংয়ে। আমাকে যে অফিসে বসাবেন ওনারা, সেখানেই তো কাজ করতে হবে। তবে জনগণের একটু ভোগান্তি বাড়বে প্রধান কার্যালয়ে গেলে।"
এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরাও। তাদের মতে, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাগরিকদের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘদিনের চাওয়া অনুযায়ী, রাজউকের সকল সেবা জোনাল অফিস থেকে পাওয়া নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, "রাজউকের জোনাল অফিসগুলো পুরোপুরি ফাংশনাল না হলে জোনাল অফিস করে তো কোনো লাভ নেই। অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল রাজউককে বিকেন্দ্রীকরণ করা, কিন্তু সেটা না করে এককেন্দ্রীক করা একটি জনবিরোধী সিদ্ধান্ত।"
তিনি বলেন, "প্রধান কার্যালয়ে গ্রাহকরা সেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়বেন এবং হয়রানিও বাড়বে। সরকারি এসব অফিস কর্মকর্তা-বান্ধব না বানিয়ে জনগণ-বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সেবা গ্রহীতাদের কথা মাথায় রেখে রাজউকের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।"
এদিকে, রাজউকের চিফ টাউন প্ল্যানার মো: আশরাফুল ইসলাম কেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্তের পক্ষে বলেন, "উত্তরার স্টেট অফিসটিই শুধু কেন্দ্রীয় অফিসে নিয়ে আসা হচ্ছে। বাকি ৭টি জোনের স্টেট অফিস আগে থেকেই প্রধান কার্যালয়ে আছে। অনেক সময় দেখা যায়, গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকার ফাইল হারিয়ে যায়। এছাড়া, প্রতিদিন জোনাল অফিস থেকে প্রধান কার্যালেয়ে ফাইল আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাগজ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।"
"কারণ নকশা অনুমোদন, হস্তান্তর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে জোনাল অফিস থেকে ফাইলগুলো প্রতিদিন প্রধান কার্যালয়ে আনতে হয় চেয়ারম্যানের অনুমোদনের জন্য," যোগ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, "হেড অফিসে নিয়ে আসলে ঘুষ বাণিজ্যের ঘটনা কমবে, কিন্তু গ্রাহকদের ডিসকমফোর্ট (অসুবিধা) হতে পারে। কারণ উত্তরা থেকে আসা যাওয়ার কারণে গ্রাহকদের কিছুটা ভোগান্তি হবে।"
রাজউকের ফাইল নাড়াচাড়া না করে পুরো ব্যবস্থাপনা অনলাইনে নিয়ে আসার জন্য কাজ চলছে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, "আমরা একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছি রাজউকের পুরো ব্যবস্থাপনা ই-ডেটাবেজড করে প্রতিটি ফাইল ই-ফাইলিং করার। হয়তো এ কাজে একটু সময় লাগবে, কিন্তু এটি সম্পন্ন হলে গ্রাহকদের আর ভোগান্তি থাকবে না।"
এদিকে উত্তরাবাসীর সুযোগ-সুবিধার স্বার্থে রাজউক এস্টেট ও ভূমি-২, উত্তরা জোনাল অফিস স্থানান্তরের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করাসহ রাজউক চেয়ারমানকে স্মারকলিপিও দিয়েছেন গ্রাহকরা।
গ্রাহক মো: জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, "ফাইল হারিয়ে যাওয়ার যে অযুহাতে জোনাল অফিস সরাতে চাচ্ছে, সেটি বরং প্রধান কার্যালয়ে বেশি ঘটবে। মতিঝিলের প্রধান কার্যালয় থেকে উত্তরা ৩য় ফেইজ প্রকল্পের আমাদের ৪১ জন গ্রাহকের ফাইল হারিয়ে গেছে।"
তিনি বলেন, "ফাইল যেখানেই থাকুক, সেগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজউকের। আমরা চাই, রাজউক গ্রাহকদের বিরুদ্ধে না গিয়ে অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসবে।"
১৯৫৬ সালে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের উন্নয়ন ও পরিবর্ধনের বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে সর্ব প্রথম 'ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট' (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠিত হয় দ্য টাউন ইমপ্রুভমেন্ট এক্ট, ১৯৫৩ এর আওতায়।
ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত তৎকালীন ডিআইটি পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে উক্ত আইন সংশোধনের মাধ্যমে 'রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ' (রাজউক) হিসেবে পরিবর্তন করে। বর্তমানে রাজউকের আয়তন ১,০৯৪ বর্গকিলোমিটার।
রাজউক কর্মকর্তারা জানান, রাজউকের কেন্দ্রীয় অফিস ব্যতীত উত্তরা এবং মহাখালীর অফিস ছিল। কিন্তু গত ২-৩ বছরের মধ্যে বাকি জোনগুলোর অফিসও আলাদা হয়ে যায়। উত্তরাতে জোন-১ ও জোন-২ এর অফিস, মহাখালীতে জোন ৩ ও ৪, পান্থপথে জোন-৫, মতিঝিলে আলাদা আলাদা ভবনে জোন ৬ ও ৭ এবং সাইনবোর্ডে জোন-৮ এর অফিস রয়েছে।