রাজউকের সৌন্দর্যবর্ধক কাজে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরা লেক, ঝুঁকিতে আশেপাশের ভবন

রাজধানীর উত্তরা লেকের সৌন্দর্যবর্ধণ ও পাড় উন্নয়ন কাজ করতে গিয়ে লেকেরই চারপাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
উত্তরা সেক্টর-৯ ও সেক্টর-১১ এর মধ্যবর্তী লেক পুনঃখনন করার সময় লেকের পাশের ওয়াকওয়ে ও পাড় ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লেকের পাড়-ঘেঁষে গড়ে ওঠা বেশকিছু ভবনেও ধরেছে ফাঁটল।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, লেকটি অতিরিক্ত খনন করায় এবং পাড় থেকেও মাটি অপসারণ করায় চারপাশের ওয়াকওয়েসহ পাড় ভেঙেছে।
সম্প্রতি উত্তরা লেকের একটি অংশ সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লেকের চারিদিক থেকেই পাড়সহ অধিকাংশ ওয়াকওয়ে ভেঙে পড়েছে। উত্তরা সেক্টর-৯ ও সেক্টর-১১ এর সোনারগাঁও জনপথ এর অংশ থেকে লেকসাইড অংশের ওয়াকওয়ে অধিকাংশই ভেঙে লেকের মধ্যে গিয়ে জমেছে। বেশ কয়েকটি বাড়ির গার্ড দেওয়ালেও ফাঁটল ধরেছে।
এদিকে, ইতোমধ্যেই কয়েকটি বাড়ির মালিকের পক্ষ থেকে 'লেক খননের কারণে তাদের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে' উল্লেখ করে রাজউককে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, লেকের খনন ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সুয়ারেজ ড্রেন ও রাস্তার কাজ করতে গিয়ে তাদের বাড়ির দেওয়াল ও ছাদে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছিল এবং রাজউককে জানিয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। পুনরায় একই ধরনের দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, যা আগের চেয়েও ভয়াবহ।
উত্তরা সেক্টর-৯ এর বাসিন্দা শর্মিলা দাস টিবিএসকে বলেন, "আমি নিয়মিত লেকের পাড়ের ওয়াকাওয়েতে হাঁটতাম, গত কয়েকদিন ধরে লেকের কাছেই যেতে পারছি না। এখন শুনছি পাইলিং দিয়ে ওয়াকওয়ে ঠিক করবে।"
"কিন্তু এভাবে পুরো লেকটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার এমন কাজের দায় রাজউক এড়াতে পারে না," যোগ করেন তিনি।
স্লাজ অপসারণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লেক: রাজউক
এদিকে রাজউক বলছে, লেকে অতিরিক্ত পরিমাণে জমে থাকা স্লাজ (কাদা) অপসারণ এবং আশেপাশের বাড়িগুলোর সুয়েজ লাইনসহ বিভিন্ন নর্দমার লাইনের সংযোগ লেকে থাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, লেকের পাড়-ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভবনগুলো নকশার ব্যাত্বয় ঘটিয়েছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখছে রাজউক।
উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্মাণ সংস্থা কনভে গ্রুপের অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এই লেকের চারিদিকের অধিকাংশ ড্রেনের সংযোগ লেকের মধ্যেই এবং পুরো লেকে স্লাজ জমে ছিল। সেগুলো অপসারণ করতে গিয়ে এমনটি ঘটেছে।"
তিনি বলেন, "আমরা এখন লেকের পাড়ে বড় বড় খুঁটি গেড়ে পাইলিং করে পাড় বাঁধাই করছি। আর এই লেকে বহুদিন ধরে স্লাজ ও আশপাশের সকল ধরনের ময়লা জমে পুরো ব্যবহার অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে।"

বর্তমান উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রায় এক মাস ধরে উত্তরা লেকের এই অংশে কাজ করছে রাজউক। 'উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্প' এর অধীনে লেক খনন, স্লাজ অপসারণ, পাড় সুরক্ষা ও ওয়াকওয়ে তৈরির কাজগুলো তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে ডেটা এক্সপার্ট (প্রাইভেট) লিমিটেড, যার উন্নয়ন অংশীদার হলো উদয়ন বিল্ডার্স
প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে, লেকের ২.১৫ কিলোমিটার অংশের মধ্যে তিনটির কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৪.১৭ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ এবং ৬৩.৮৪ একর লেকফ্রন্ট বরাবর বৃক্ষরোপণ ও এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা।
চলমান সংস্কার কাজের মধ্যেই উত্তরা লেক ঘুরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য দেখা গেছে। বিশেষ করে সোনারগাঁও জনপথ এলাকার লেকসাইড ওয়াকওয়ের একটি বড় অংশই পানিতে তলিয়ে গেছে।
লেকের মাটি বিক্রির অভিযোগ, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধির সম্ভাবনা
এদিকে, লেকের মাটি বিক্রি অভিযোগের বিষয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, "আমরা লেকটি থেকে শুধুমাত্র স্লাজ অপসারণ করছি, উল্টো বিভিন্ন স্থানে মাটি ফেলে পাড় বাঁধাই করতে হচ্ছে। আর স্লাজগুলো রাজউকের দিয়াবাড়ির দিকের নিচু প্লটগুলোতেই ফেলা হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "এই লেকটির বড় একটি অংশ বস্তি দখল করে আছে, আর ওই অংশেই সবচেয়ে বেশি স্লাজ জমেছে। আমরা লেকটির কাজ শুরু করতে গিয়ে মাত্র ৩ ফুট পানি পেয়েছি। লেক থেকে ১৫ ফুটের বেশি স্লাজ অপসারণ করা হয়েছে।"
এছাড়া, পাড় ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে পাইলিং করার কারণে এই প্রকল্পের খরচ বেড়ে যেতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: মোবারক হোসেন জানান, "আমরা খুব সাবধানতার সাথে উত্তরা লেকের কাজ করছি। লেক পাড়ের ওয়াকওয়েগুলো আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। এখন যেগুলো ভেঙে পড়েছে, সেগুলো আমরা সংস্কার করবো। লেকের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হলে লেকের সৌন্দর্য বোঝা যাবে।"
ভবন নির্মাণ বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে রাজউক
এদিকে ভবন নির্মাণের সময় রাজউকের বিধিমালার লঙ্ঘন ঘটেছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে উল্লেখ করে মোবারক হোসেন বলেন, "লেকের পাড়-ঘেঁষে যে ভবনগুলো গড়ে উঠেছে, সেগুলোর নকশা ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছি। লেকের পাড়ে ভবন করতে হলে যে পরিমাণ পাইলিং এবং দূরত্ব বজায় করতে হয়, সেগুলো মানা হয়েছিলো কিনা সেগুলোও যাচাই করা হচ্ছে।"
"যদি কোনো ভবন অবৈধভাবে কিংবা নকশা বহির্ভূত গড়ে উঠে, সেক্ষেত্রে ওই ভবনের দায় তো রাজউক নেবে না, বরং ব্যত্যয় ঘটা ভবনের বিরুদ্ধে রাজউক ব্যবস্থা নিতে পারবে," যোগ করেন তিনি।