ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনামে লেবার এমপি টিউলিপের কারাদণ্ড
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিককে ২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার আদালত। সাথে দেয়া হয়েছে ১ লাখ টাকার অর্থদণ্ড। আর সে অর্থ অনাদায়ে আরও ৬ মাস কারাভোগের সাজাও দেয়া হয়েছে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমে নিয়মিত আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে মধ্যস্থতা, মিথ্যাচার ও অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের 'সিটি মিনিস্টার' পদ থেকে পদত্যাগের ঘটনায় তিনি দুই দেশের সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। এবার দুর্নীতির মামলায় সাজা পাওয়ার খবরটিও ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের শীর্ষ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে—'ব্রিটিশ এমপি টিউলিপের অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশের আদালতে তার দুই বছরের কারাদণ্ড'।
গার্ডিয়ান বলেছে, আসামিদের অনুপস্থিতিতেই এই মামলার বিচারকাজ ও রায় ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার রায় পড়ার সময় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, টিউলিপ সিদ্দিক কিংবা অভিযুক্ত তাদের পরিবারের অন্য কোনো সদস্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন না।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের কোনো বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। ফলে টিউলিপ সিদ্দিককে দেশে ফিরিয়ে এনে এই সাজা কার্যকর করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এদিকে, টিউলিপ সিদ্দিক তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, রাষ্ট্রপক্ষ যেসব নথিপত্র উপস্থাপন করেছে, তার অধিকাংশই জাল বা বানোয়াট। মামলায় তাকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে এবং তার পাসপোর্ট ও টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) থাকার কথা উল্লেখ করে বিচার করা হয়েছে। অথচ টিউলিপের দাবি, শৈশবের পর থেকে তার কোনো বাংলাদেশি পাসপোর্ট ছিল না এবং তিনি কখনোই বাংলাদেশে কর প্রদান করেননি।
দ্য টেলিগ্রাফ শিরোনাম করেছে—'বাংলাদেশে টিউলিপ সিদ্দিকের দুই বছরের কারাদণ্ড।' পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড হলেও টিউলিপ সিদ্দিকের এই সাজা খাটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে এখনো বেশ কিছু অভিযোগ ও মামলা চলমান রয়েছে।
টিউলিপ সিদ্দিক তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি এই বিচার প্রক্রিয়াকে 'প্রহসন' হিসেবে অভিহিত করেছেন। টিউলিপ মন্তব্য করেছেন, এটি 'বানোয়াট অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে সাজানো এবং স্পষ্টত রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত।'
মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সালাহউদ্দিনের বরাতে দ্য টেলিগ্রাফ আরও জানায়, সালাহউদ্দিন আদালতে দাবি করেন—'সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে টিউলিপ সিদ্দিক তার খালা শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করেছিলেন। আর শেখ হাসিনা তার প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং বিশেষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনবিশ্বাসের খেয়ানত করেছেন।'
আইনজীবী আরও বলেন, 'তদন্তকালে সংগৃহীত নথিপত্র পর্যালোচনায় এও দেখা যায় যে, আসামি শেখ হাসিনা বিধিবহির্ভূতভাবে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে আসামি শেখ রেহানার অনুকূলে প্লট বরাদ্দে প্রভাব খাটিয়েছেন।'
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি 'বিনা উপস্থিতিতে বিচার শেষে বাংলাদেশে টিউলিপ সিদ্দিক এমপিকে কারাদণ্ড' শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছে।
বিবিসি জানায়, বিচার শুরু হওয়ার সময় এই এমপি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ 'মিথ্যা ও হয়রানিমূলক অভিযোগ ছড়িয়েছে, যা গণমাধ্যমকে জানানো হলেও তদন্তকারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই আমার কাছে উপস্থাপন করেননি।'
টিউলিপের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতির বরাতে বিবিসি লিখেছে: 'আমি শুরু থেকেই স্পষ্টভাবে বলেছি যে, আমি কোনো অন্যায় করিনি এবং আমার সামনে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আমি তার জবাব দেব। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করার এই প্রচেষ্টা ভিত্তিহীন ও ক্ষতিকর।' রায় ঘোষণার পর থেকে তিনি প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত সপ্তাহে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাজ্যের একদল জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধির কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন
সাবেক জাস্টিস সেক্রেটারি রবার্ট বাকল্যান্ড, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ডমিনিক গ্রিভ এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী ও মানবাধিকার আইনজীবী লেডি চেরি ব্লেয়ার।
ফিনান্সিয়াল টাইমস 'সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বাংলাদেশে দুই বছরের কারাদণ্ড' শিরোনামে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত সপ্তাহে হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটের এই এমপি (টিউলিপ) চেরি ব্লেয়ারসহ একদল 'বিশিষ্ট আইনজীবীকে' ধন্যবাদ জানিয়েছেন 'বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটিগুলো তুলে ধরার জন্য'। টিউলিপের ভাষ্যে, 'বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এখন তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে উদ্যত'।
সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ শিরোনাম করেছে—'দুর্নীতির দায়ে বাংলাদেশে লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের দুই বছরের কারাদণ্ড'। এছাড়া যুক্তরাজ্যের আরেক জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি মেইল তাদের শিরোনামে লিখেছে—'সাবেক সিটি মিনিস্টার ও লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত, দুই বছরের কারাদণ্ড'।
উল্লেখ্য, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে করা এই মামলায় টিউলিপ সিদ্দিক ছাড়াও তার মা শেখ রেহানা এবং খালা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
