ক্ষমতায় থাকতে সালমানের ‘আমার বন্ড’ ছিল রমরমায়, ২য় বন্ড এখন ব্যর্থ

সালমান এফ রহমান এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, ক্ষমতা ও ব্যবসায়িক সাফল্য প্রায়শই পাশাপাশি চলে — আর একটিতে ধাক্কা লাগলে অন্যটিও দ্রুত ভেঙে পড়তে পারে।
এর বড় উদাহরণ শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড (এসটিএল)। সালমানের বেক্সিমকো সাম্রাজ্যের অধীনে ২০২৩ সালের মার্চে তড়িঘড়ি গঠিত এ রিয়েল এস্টেট কোম্পানির লক্ষ্য ছিল গাজীপুরে মায়ানগর নামক একটি বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন। এটি প্রতিষ্ঠার পরপরই 'আইএফআইসি আমার বন্ড' নামে একটি আর্থিক প্যাকেজ বাজারে আসে — যার মাধ্যমে ১,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হয়। দেশের সংবাদপত্রগুলোতে এ বন্ডের পূর্ণপৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়ে।
কৌশলটি তখন সফল হয়। মাত্র পাঁচ সপ্তাহে ১,০০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়ে যায়, বিনিময়ে ১২ শতাংশ রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সালমানের প্রভাব তখন অটুট ছিল, তাই অর্থ প্রবাহও ছিল সহজ।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সালমান গ্রেপ্তার হন। রাজনৈতিক প্রভাব হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বেক্সিমকোর ১,৫০০ কোটি টাকার দ্বিতীয় বন্ড ইস্যু ভেঙে পড়ে।
২০২৪ সালের মে মাসে ঋণ পুনঃঅর্থায়ন ও এসটিএলে তহবিল আনার নামে বেক্সিমকো বিএসইসির কাছ থেকে নতুন বন্ড ইস্যুর অনুমোদন পায়। তবে এরপর রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে যায়। ১৫ শতাংশ রিটার্নের প্রস্তাব সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোরও আগ্রহ কমে যায়।
বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, বেক্সিমকো লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ ৫৪১ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছিল, যার বেশিরভাগই শাসনক্ষমতা পরিবর্তনের আগে। যেমন, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ফেব্রুয়ারিতে তাদের পরিকল্পিত ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ বাতিল করে এবং তা এপ্রিলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানায়।
ব্যাংক, ধনী ব্যক্তি ও অনুগত প্রতিষ্ঠানগুলোর পিছু হটার ফলে বেক্সিমকো বাকি তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা বন্ধ করে দেয়।
বেক্সিমকো লিমিটেডের সিএফও মো. লুৎফর রহমান বলেন, 'আমরা সাবস্ক্রিপশন সময়ের মধ্যে যে তহবিল পেয়েছি, সেটিকেই চূড়ান্ত হিসেবে নিয়েছি। আর কোনও তহবিল সংগ্রহ করা হবে না।' তিনি স্বীকার করেন, ব্যবসা এখন চাপের মধ্যে আছে; ইতোমধ্যে একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে এবং ব্যাংকগুলোর সহায়তাও কমে এসেছে।
মায়ানগর: একটি স্বপ্নভঙ্গ
দুটি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বেক্সিমকো মোট ১,৫৪১ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে — প্রথম বন্ড থেকে ১,০০০ কোটি এবং দ্বিতীয় থেকে ৫৪১ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিল নাগাদ মায়ানগর প্রকল্পের কাজ মাত্র ১০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এক সময়ের সাশ্রয়ী মূল্যের শহরতলি গড়ার স্বপ্ন এখন যেন এক ভুতুড়ে প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।
এসটিএলের কোম্পানি সচিব কায়সার আহমেদ জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীরা নির্মাণ সামগ্রী ভাঙচুর করে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষতি করে এবং সীমানা প্রাচীরও ধ্বংস করে। ভূমি উন্নয়ন ও রাস্তা নির্মাণ শেষ হলেও ভবন নির্মাণ শুরু হয়নি।
বন্ডের অর্থ দিয়েই পরিশোধ
প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মায়ানগরের জন্য সংগৃহীত মূলধন দিয়েই এসটিএল বন্ডধারীদের পরিশোধ করা হচ্ছে। ২৪০ কোটি টাকার রিজার্ভ তহবিল থেকে প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা করে পরিশোধ চলছে; এর মধ্যে ১৮০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। তবে রিজার্ভ শেষ হয়ে গেলে শেষ ভরসা থাকবে আইএফআইসি ব্যাংকের গ্যারান্টি — যদিও আইএফআইসি ব্যাংকও সালমানের অতীত সংশ্লিষ্টতার কারণে চাপে রয়েছে।
আইএফআইসি ব্যাংকের মুখপাত্র রফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২৪০ কোটি টাকার রিজার্ভ তহবিল শেষ হতে আরও ছয় মাস লাগবে।
তিনি বলেন, 'তহবিল শেষ হওয়ার আগে আমরা প্রকল্প মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করব। তাদের পরিকল্পনা শুনে তা বোর্ডে উপস্থাপন করা হবে। যেহেতু আমরা বন্ডের গ্যারান্টার, তাই বোর্ডের নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
স্বপ্নের পেছনের হিসেব
নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে গাজীপুরের ৭৬ লাখ বর্গফুট জমিতে গড়ে ওঠার কথা ছিল মায়ানগর প্রকল্পের। পুরো প্রকল্পের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৬,০৯৫ কোটি টাকা। জমির মালিকানার ৭৫ শতাংশ ছিল বেক্সিমকোর এবং ২৫ শতাংশ এসটিএলের। অর্থায়ন হওয়ার কথা ছিল ইক্যুইটি, ঋণ, জমির মালিকদের অবদান এবং ক্রেতাদের অগ্রিমের মাধ্যমে।
২০২৩ সালে ইস্যু করা বন্ডের মাধ্যমে ১,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয় এবং মেয়াদ শেষে ১,৬০০ কোটি টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বর্তমানে এ বন্ড ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিকল্প ট্রেডিং বোর্ডে লেনদেন হচ্ছে।
দ্বিতীয় বন্ডের পরিকল্পনা
বেক্সিমকো ১,৫০০ কোটি টাকার 'বেক্সিমকো প্রথম জিরো-কুপন বন্ড' ইস্যু করেছিল, যার মোট অভিহিত মূল্য ছিল ২,৬২৫ কোটি টাকা। এ তহবিলের ৫০০ কোটি টাকা বিদ্যমান ঋণ পরিশোধে এবং ১,০০০ কোটি টাকা মায়ানগর প্রকল্পের ডেভেলপার এসটিএলকে ঋণ হিসেবে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১,৫০০ কোটি টাকা তুলে মেয়াদ শেষে ২,৬২৫ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। বন্ডটি বার্ষিক ১৫ শতাংশ ছাড়ে অফার করা হয়েছিল।
সালমানের খেলার কৌশল: বন্ড ও ক্ষমতা
রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বাজার থেকে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। জানা গেছে, ব্যাংকসহ একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীকে বন্ডে বিনিয়োগ করতে চাপ দেওয়া হয়েছিল।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শ্রীপুর টাউনশিপের ১,০০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দেয়, যেখানে আইএফআইসি ব্যাংক গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করে। 'আইএফআইসি আমার বন্ড' নামে বাজারজাত করা এ বন্ড এক মাসের মধ্যে ৭,১৭৩ জন বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করে।
বন্ডের শর্ত অনুযায়ী, শ্রীপুর টাউনশিপ ১,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে এবং মেয়াদ শেষে ১,৬০০ কোটি টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ বন্ডও বর্তমানে বিকল্প ট্রেডিং বোর্ডে লেনদেন হচ্ছে।
এর আগে, ২০২১ সালে, বেক্সিমকো দুটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ও টেক্সটাইল ইউনিট সম্প্রসারণের জন্য সুকুক বন্ডের মাধ্যমে ৩,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর দাঁড়ানো আর্থিক প্রকল্প যে কতটা ভঙ্গুর, মায়ানগর তার বড় প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।