মহামারির সময়ে টিকা বিপণনকারী সালমানকে কেন দুদকের তদন্তের মুখোমুখি হতে হচ্ছে?

২০২০ সালের ৮ মার্চ, বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া নিশ্চিত করে কর্তৃপক্ষ। দেশবাসী বুঝে যায় মহামারির আঘাত আসছে। এর মাত্র ১০ দিন পরেই, কোভিডে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, যা জনমনে উদ্বেগ আর আতঙ্ককেই বাড়িয়ে তোলে। এমনকী যানজট আর কর্মতৎপরতায় মুখর প্রাণচঞ্চল নগরী ঢাকাতেও নেমে আসে এক অস্বস্তিকর স্থবিরতা; পথঘাট মানুষশূন্য, বন্ধ দোকানের শাটার আর জীবনজীবিকার অস্বাভাবিক বিরতিতে—- এক অচেনা নগরী যেন। মহামারির শুরুর সে সময়ে আতঙ্ক এমন পর্যায়েই পৌঁছেছিল যে, কোনো কোনো পরিবার কোভিডে মৃত প্রিয়জনের লাশও নিজেদের হাতে দাফন করতে চায়নি এমন ঘটনাও ঘটেছে।
এই ভয় ও অচলাবস্থার মধ্যে অবশ্য একজন সিদ্ধান্ত নিতে এগিয়ে আসেন। অন্যরা যখন মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত, তিনিই তখন একটি সুযোগ অনুধাবন করেন।
এই ব্যক্তি হচ্ছেন, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। বাংলাদেশের কোভিড-১৯ টিকা ক্রয়ে যিনি মূল খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভুত হন। কোনোপ্রকার দরপত্র বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই – একমাত্র তাঁরই প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস – ৩ কোটি ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত করোনার টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে আমদানির চুক্তি পায়।
এধরনের এক্সক্লুসিভ চুক্তিতে অনিয়মের সন্দেহ জাগলেও, এনিয়ে তখন প্রশ্ন কেউ করতে পারেনি।
অথচ প্রতি ডোজ টিকা আমদানিতে বেক্সিমকো স্পষ্টভাবেই ৭৭ টাকা মুনাফা করে। আর এই লাভ করে, পরিবহনসহ সব ধরনের লজিস্টিকস ব্যয় নির্বাহের পরেও।
তবে এই ঘটনা আরও প্রকট অনিয়মের কাহিনি তুলে ধরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদনমতে, এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ প্রতি ডোজ টিকা কিনতে ১,৫৫০ টাকা বেশি দিয়েছে— যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় সর্বোচ্চ। যেখানে প্রতি ডোজ টিকা কিনতে ভারতের যে ব্যয় বাংলাদেশি টাকায় তা ৪৩৯ টাকা, নেপালের ৩৬২ টাকা এবং মালদ্বীপের ৪৪৭ টাকা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে একজনকে যে দুই ডোজ করে টিকা নিতে হয়েছে, তার দাম পড়েছে ৩ হাজার ১৭৮ টাকা। সীমান্তের ওপারে ভারত এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়ে তার নাগরিকদের টিকা প্রদান করে।
দামের এই বিশাল পার্থক্য নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, তখন বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম এর দায় নিতে চাননি।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, টিকা কেনার চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চুক্তির শর্তগুলো গোপনীয়তার চুক্তি (নন-ডিজক্লোজার এগ্রিমেন্ট) দ্বারা সুরক্ষিত হওয়ায়, প্রকাশ করা যাবে না। জাতীয় সংসদে এমপিরা এনিয়ে প্রশ্ন করলে, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীও একই রকম জবাব দেন। তিনিও জানান যে, দাম প্রকাশ করা যাবে না।
কিন্তু, টিকা কেনার বিশাল ব্যয়ের অংকই যেকোনো বিবৃতির চেয়ে স্পষ্ট অনিয়মের বার্তা দিয়েছিল।
টিকার ডোজ যখন আসে, মহামারিপীড়িত দেশবাসীর উদ্বেগ তখন কমে, অন্যদিকে বেক্সিমকোর বরাত হয় আরও ঊর্ধ্বমুখী। গ্রুপের ফার্মাসিউটিক্যালস ইউনিটের শেয়ারদর – একসময় যা ১৬ টাকা ছিল – ভ্যাকসিন চুক্তির ১১ মাসের মধ্যে ১৩৬ টাকা থেকে ২৫৫ টাকায় উল্লম্ফন করে। অর্থাৎ, জাতির এক দুর্ভোগকে পুঁজি করে বেক্সিমকো গ্রুপের তখন রমরমা দশা।
ভ্যাকসিন সম্রাট যেভাবে দুদকের অনুসন্ধানের আওতায়
জাতি যখন মহামারিতে আতঙ্কগ্রস্ত, তখন বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সালমান এফ রহমানকে প্রশংসাই করা হয়েছিল। কিন্তু, বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সালমানের নেতৃত্বে কতিপয় ব্যক্তির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট, কোভিড-১৯ এর টিকা কেনার সময়ে ২২ হাজার কোটি টাকার সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছে— আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
গতকাল সোমবার দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এনিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (ডিএমআরসি) কর্মকর্তা মঈদুল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতে এই অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
মঈদুল জানান, স্বাস্থ্য বিভাগ শুরুতে তাদের বিজ্ঞপ্তিতে প্রথমে জানায় সিনোফার্মের এক ডোজ টিকা কিনতে ব্যয় হবে ১০০ ডলার, অথচ পরে সরকারের কমিটি তা ১০ ডলারে কেনার অনুমোদন দিয়েছিল। 'ভ্যাকসিন ক্রয় প্রক্রিয়া এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল'- তিনি যোগ করেন।
তাঁর অভিযোগ অনুসারে, যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষ হিসাবে বেক্সিমকো ফার্মাকে অন্তর্ভুক্ত করায় অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি দামে বাংলাদেশকে সেরামের টিকা কিনতে হয়েছে। সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচত, তা দিয়ে আরও ৬৮ লাখ বেশি টিকা কেনা সম্ভব হতো। এটি সরকারের ক্রয়বিধির লঙ্ঘন এবং যার ফলে বাংলাদেশের প্রতি ডোজ টিকা কেনার দামও বেড়ে যায়।
আর টাকার অংকও সেখানে অবিশ্বাস্য।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ?
অভিযোগে বলা হয়, তৎকালীন সরকার যদি সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সরাসরি চুক্তিতে গেলে, প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচত, তা দিয়ে আরও ৬৮ লাখ ডোজ টিকা বেশি কেনা যেত।
দেশে টিকা নিয়ে টানাটানির মধ্যে– এটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক জীবন হয়তো সেক্ষেত্রে বাঁচানো সম্ভব ছিল।
২০২১ সালের ১৬ আগস্ট, বিএমজে মেডিকেল জার্নালে পিয়ার-রিভ্যিউ করা এক নিবন্ধে বলা হয়, 'কোভিড-১৯ টিকার বৈশ্বিক বরাদ্দ করা হয় (ক্রয়কারী দেশ বা পক্ষের ) শক্তি, প্রথম চুক্তিকারীকে অগ্রাধিকার প্রদান ও মূল্য পরিশোধের সক্ষমতার ভিত্তিতে।'
নিবন্ধনের শিরোনাম ছিল, 'প্রফিটিয়ারিং ফ্রম ভ্যাকসিন ইনইকুয়ালিটি: অ্যা ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটি?' যেখানে বলা হয়, নৈতিক এই স্খলন বা দুর্নীতি, যা কর্পোরেট ও রাজনৈতিক শক্তির যোগসাজশে (টিকার অভাবে) গণমৃত্যুর অনুমোদন দিয়েছে— তা 'মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধের শামিল।'
টিকা কেনার চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
এর আগে ২০২২ সালের আগস্টে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক বলেছিলেন, কোডিড-১৯ টিকা ক্রয় এবং বিতরণের ক্ষেত্রে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এত বিপুল টাকার কথায় অনেকের ভ্রূ কুঞ্চিত হলেও— খতিয়ে দেখার সাহস কারো ছিল না। কিন্তু, এগিয়ে আসে দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এক গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই খরচ সর্বোচ্চ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি হবার কথা নয়।
গতকাল এই অনুসন্ধানের বিস্তারিত জানানোর ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, 'কীভাবে এসব টাকা আত্মসাৎ হয়েছে এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। আমরা অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত জানাবো।'
টিকা কেনার দুর্নীতিতে জড়িত ওই সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে, অভিযোগে সালমান এফ রহমানের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকজন হাই-প্রোফাইল কর্মকর্তার নাম এসেছে। যাদের মধ্যে আছেন– সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য সচিব লোকমান হোসেন, বিএমআরসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোদাচ্ছের আলী এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস।
আটকে যায় বঙ্গভ্যাক্স অনুমোদন
অভিযোগকারী বলেছেন, একই সিন্ডিকেটের শক্তির বলয়ে দেশীয় আবিষ্কার গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্সে টিকা প্রক্রিয়া আটকে যায়। চক্রটি তাদের পকেট ভারী করতেই মূলত বাংলাদেশ আবিষ্কৃত করোনা ভ্যাকসিনের অনুমোদনের বিষয়ে গড়িমসি করেছে। বারবার অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন নথিপত্র চেয়েছে এবং প্রতিকূল নানান শর্ত আরোপ করেছে। ফলে এই ভ্যাকসিনের গবেষণা প্রক্রিয়া থমকে পড়ে।
২০২২ সালের জুলাইয়ে অবশেষে যখন বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়া হয়– ততোদিনে মহামারির সংক্রমণ আর তেমন ছিল না। ফলে করোনা মোকাবিলায় অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগও পায়নি দেশীয় এই আবিষ্কার।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বঙ্গভ্যাক্সের অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অন্তত অর্ধডজন চিঠি দিয়েও কোনো সহায়তা মেলেনি। উল্টো প্রতিষ্ঠানটির অফিসে হামলা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন পক্ষ থেকে গবেষকদের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
টিকার ফর্মুলা ও প্রযুক্তি শেয়ার করার জন্য গ্লোব বায়োটেককে চাপ দেন সালমান এফ রহমান। দিয়েছিলেন বেক্সিমকোর মাধ্যমে উৎপাদন ও বিপণনের প্রস্তাবও। গ্লোব তাতে রাজী হয়নি। আর তার ফলেই এসব হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। ক্ষমতাধরদের দাপটে সবকিছু মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল গ্লোব বায়োটেক।
গ্লোব বায়োটেকের চেয়ারম্যান মো. হারুনুর রশিদ টিবিএসকে বলেন, 'বেক্সিমকো আয়ের ৪০ শতাংশ দিয়েও আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি চেয়েছিলাম, কিন্তু সালমানের নজর ছিল আমাদের প্রযুক্তি কেড়ে নেওয়ার দিকে।'
তিনি বলেন, '২০২০ সালের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকাভুক্ত প্রথম তিনটি (কোভিড-১৯) ভ্যাকসিনের একটি ছিল আমাদেরটা। এই প্রজেক্টে আমাদের ৪০০ কোটি টাকা খরচ হলেও— তৎকালীন সরকারের অসহযোগিতার কারণেই তা ব্যর্থ হয়।'
কিন্তু, মহামারির অন্ধকার সময়ে দেশের ত্রাতা হিসেবে নিজেকে প্রচার করা সালমান এফ রহমানের ভাগ্যের চাকাও উলটে গেছে। দুদকের তদন্তকারীরা এখন এই ২২ হাজার কোটি টাকার হদিশ খুঁজছেন। এই অবস্থায়, জনমনে সরল একটা প্রশ্নই হয়তো উঁকি দিচ্ছে, প্রাণরক্ষাকারী টিকা প্রকৃতপক্ষে কত টাকায় কেনা হয়েছিল, আর তার জন্য জীবন ও সম্পদের আকরে মূল্যটা কত মানুষকে চুকাতে হয়েছিল?