তিনজনের ডিএনএ ব্যবহার করে জন্ম নেওয়া শিশুরা বংশগত রোগ থেকে মুক্ত

যুক্তরাজ্যে তিনজনের ডিএনএ ব্যবহার করে জন্ম নেয়া আট শিশু এখন বংশগত দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে মায়ের ডিম্বাণু ও বাবার শুক্রাণুর সঙ্গে একটি তৃতীয় দাতা মহিলার ডিম্বাণু সংযুক্ত করা হয়।
গত এক দশক ধরে যুক্তরাজ্যে এই পদ্ধতি বৈধ হলেও এবারই প্রথম নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এর মাধ্যমে এমন শিশু জন্ম নিচ্ছে যারা প্রাণঘাতী মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ থেকে মুক্ত।
এই রোগগুলো সাধারণত মায়ের মাধ্যমে সন্তানদের মধ্যে সংক্রমিত হয় এবং শরীরের কোষগুলোর শক্তি উৎপাদনে বাধা দেয়।
এই রোগের কারণে শিশুদের শরীরে গুরুতর অক্ষমতা সৃষ্টি হয় এবং কিছু শিশু জন্মের পর কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায়। যেসব দম্পতির আগের কোনও সন্তান, পরিবারের সদস্য বা মায়ের মধ্যে এই রোগের কোনও ইতিহাস থাকে, তারা ঝুঁকিতে রয়েছেন।
তিনজনের ডিএনএ ব্যবহার করে জন্ম নেওয়া শিশুর অধিকাংশ ডিএনএ তাদের বাবা-মার কাছ থেকে আসে, তবে প্রায় ০.১ শতাংশ ডিএনএ থাকে তৃতীয় দাতা মহিলার থেকে। এই পরিবর্তন প্রজন্মের পর প্রজন্মে বহন করা হয়।
যেসব পরিবার এই পদ্ধতিতে সন্তান নিয়েছেন, তারা গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রকাশ্যে কথা বলছেন না। তবে তারা নিউক্যাসেল ফার্টিলিটি সেন্টারের মাধ্যমে গোপনে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, যেখানে এই চিকিৎসা সম্পন্ন হয়েছে।
এক নবজাতক কন্যার মা বলেন, 'বহু বছর অনিশ্চয়তার পর এই চিকিৎসা আমাদের জীবনে আশার আলো দেখিয়েছে—আর তারপর আমাদের একটি ছোট্ট শিশুও দিয়েছে। তাকে বেড়ে ওঠতে দেখে আমরা কৃতজ্ঞতায় অভিভূত।'
অন্যদিকে, এক পুত্রশিশুর মা জানান, 'এই অসাধারণ উন্নতি আর প্রাপ্ত সহযোগিতার কারণে আমাদের ছোট্ট পরিবার পূর্ণতা পেয়েছে। মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগের মানসিক চাপ কমে গেছে, তার জায়গায় এসেছে আশা, আনন্দ আর গভীর কৃতজ্ঞতা।'

মাইটোকন্ড্রিয়া হলো আমাদের প্রায় প্রতিটি কোষের অতি ক্ষুদ্র এক অংশ। এগুলো অক্সিজেন ব্যবহার করে খাবার থেকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি বা শক্তিতে রূপান্তর ঘটায়, যার কারণে আমরা শ্বাস নিতে পারি।
যদি মাইটোকন্ড্রিয়া ঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে শরীরে শক্তির অভাব হয়। ফলে হার্ট সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি, জ্বর, অন্ধত্ব, পেশী দুর্বলতা এমনকি বিভিন্ন অঙ্গেরও ক্ষতি হতে পারে।
অনেক দম্পতিই এই মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগের কারণে নিজের সন্তানদের হারিয়েছেন।
প্রতি ৫হাজার শিশুর মধ্যে প্রায় একজন মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ নিয়ে জন্ম নেয়। নিউক্যাসেল দলের অনুমান, প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০টি শিশু এই পদ্ধতিতে জন্ম নেবে।
অনেক দম্পতিই এই রোগের কারণে নিজের সন্তানদের হারিয়েছেন।
গত এক দশক আগে নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি ও স্থানীয় হাসপাতালগুলোর গবেষণায় এ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে। ২০১৭ সালে এনএইচএস-এ বিশেষায়িত একটি সেবা চালু হয়।
মাইটোকন্ড্রিয়া শুধুমাত্র মায়ের মাধ্যমে সন্তানে সঞ্চারিত হয়। তাই এই অগ্রণী প্রজনন প্রযুক্তিতে পিতামাতার সঙ্গে মায়ের ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকন্ড্রিয়া বদলে অন্য এক নারীর সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া ব্যবহার করা হয়।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, নিউক্যাসেল ফার্টিলিটি সেন্টারে ২২টি পরিবার এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিয়েছে।
এর ফলে চারজন ছেলে, চারজন মেয়ে, যার মধ্যে একটি যমজ, এবং একটি গর্ভধারণ সম্ভব হয়েছে। সব শিশুই মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ মুক্ত।
যদিও এক শিশুর মধ্যে মৃগী রোগ দেখা দিয়েছিল, যা নিজে নিজেই সেরে গআর এক শিশুর হার্টের আকারে অস্বাভাবিকতা থাকলেও তার সফলভাবে চিকিৎসা চলছে।
তবে এগুলো মাইটোকন্ড্রিয়াল ত্রুটির সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করা হয় না। এই সমস্যাগুলো কি সাধারণ ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) ঝুঁকির অংশ, অথবা তিনজনের ডিএনএর বিশেষ কোনো প্রভাব, নাকি এই পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া সব শিশুর স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের কারণে শনাক্ত হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি।