নির্বাচনে জেতার জন্য স্লোগান তৈরির কি কোনো গোপন ফর্মুলা আছে?

প্রতিটি রাজনৈতিক প্রচারণার জন্য একটি ভালো স্লোগান অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি বিবিসির একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কিছু স্লোগান ভোটের দিন পেরিয়ে গিয়েও মানুষের মনে গেঁথে থাকে, কোনো জাতীয় মনোভাব বা সময়ের অনুভূতি ধরে রাখতে সক্ষম হয় — যেমন বারাক ওবামার 'ইয়েস, উই ক্যান' বা ব্রেক্সিট প্রচারণার স্লোগান 'টেক ব্যাক কন্ট্রোল'।
আবার কিছু স্লোগান জন্মের পরই মারা যায় — জটিল, খটমট আর মনে রাখার মতো নয় বলে।
রাজনৈতিক কৌশলবিদ ও জনমত জরিপকারী ক্রিস ব্রুনি-লো দাবি করছেন যে তিনি আদর্শ স্লোগান তৈরির ফর্মুলা বের করেছেন।
তিনি সারা বিশ্বের ২০ হাজার প্রচারণার বার্তা বিশ্লেষণ করেছেন এবং আটটি শব্দ চিহ্নিত করেছেন। তিনি দেখেছেন, এ স্লোগানগুলো সব ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভোটারদের মধ্যে প্রমাণিতভাবে সাড়া জাগিয়েছে।
সে শব্দগুলো হলো: পিপল (মানুষ), বেটার (ভাল), ডেমোক্র্যাসি (গণতন্ত্র), নিউ (নতুন), টাইম (সময়), স্ট্রং (শক্তিশালী), চেঞ্জ (পরিবর্তন) এবং টুগেদার (একসাথে)।
তার নতুন বই 'এইট ওয়ার্ডস দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড'-এ ব্রুনি-লো স্পষ্ট করে বলেছেন, এই শব্দগুলো ব্যবহার করলেই যে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত হবে, তা নয়। যদি কোনো প্রার্থী আকর্ষণহীন হন বা অজনপ্রিয় নীতিমালা থাকে, তবে এই শব্দগুলো কোনো উপকারেই আসবে না।
আর এই শব্দগুলোকে এলোমেলোভাবে জুড়ে দিলেই হবে না — যেমন স্ট্রং নিউ টাইম বা পিপল বেটার চেঞ্জ — এতে ফল পাওয়া যাবে না।
বরং, ব্রুনি-লো বলেন, এগুলো হলো 'ইমোশনাল শর্টকাট' বা এমন কিছু ভিত্তি ভিন্ন সংস্কৃতি আর ভাষার সীমা পেরিয়ে স্লোগান লেখকদের জন্য কাজ করে।
ভোটাররা স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারেন যে 'পিপল', 'বেটার' বা 'টুগেদার' কী প্রতিশ্রুতি দেয় — এজন্য কোনো নীতিমালার কাগজ পড়ার প্রয়োজন হয় না।
এই শব্দগুলো আবার খুবই নমনীয়: দক্ষিণ আফ্রিকার একজন সমাজতান্ত্রিক, লুক্সেমবার্গের একজন রক্ষণশীল বা হাঙ্গেরির একজন জনপ্রিয়তাবাদী — সবাই একই শব্দে নিজের গল্পের সাথে মানিয়ে নিতে পারে।
ব্রুনি-লোয়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজয়ী প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ হলো 'পিপল'। উদাহরণ হিসেবে তিনি বিল ক্লিনটনের ১৯৯২ সালের স্লোগান 'পুটিং পিপল ফার্স্ট' এবং 'ফর পিপল, ফর আ চেঞ্জ'-এর কথা উল্লেখ করেছেন। তার এ স্লোগান বাস্তবে বড় পরিবর্তন এনেছিল। এই স্লোগানগুলো ক্লিনটনকে 'মানুষদের মানুষ' হিসেবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করেছিল, বিপরীতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জর্জ এইচডাব্লিউ বুশকে অনেকটাই কাঠখোট্টা মনে হয়েছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবাই যদি একই ফর্মুলা অনুসরণ করে, তাহলে কি স্লোগানগুলো শেষ পর্যন্ত ফিকে, সবার জন্য একরকম আর সাদামাটা হয়ে যাবে না?
সবচেয়ে কার্যকর স্লোগানগুলোর কিছু — যেমন বরিস জনসনের ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের স্লোগান 'গেট ব্রেক্সিট ডান' — একটি মাত্র স্পষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখেই তৈরি করা হয়েছিল।
(তেমনি কিছু ভয়াবহ স্লোগানও আছে — যেমন 'ভোট ফর আল স্মিথ অ্যান্ড হি'ইল মেক ইয়োর ওয়েট ড্রিমস কাম ট্রু'। মদ বিক্রির বৈধতা ফিরিয়ে আনতে চাওয়া এই অ্যান্টি-প্রহিবিশনিস্ট স্মিথ ১৯২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন।)
ব্রুনি-লো বলেন, 'গেট ব্রেক্সিট ডান'-এর মতো 'বেসপোক' বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক স্লোগানগুলোই আসলে তার নিয়মের ব্যতিক্রম যা নিয়মটিকেই প্রমাণ করে।
বেসপোক বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক স্লোগান তখনই তীব্রভাবে কাজ করে, যখন কোনো একটি অমীমাংসিত ক্ষোভ বা সমস্যাই সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়, আর কোনো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নতুন মুখ মাত্র তিন শব্দে তার সমাধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ধরনের স্লোগান সেই নির্বাচনের জন্য দারুণ কার্যকর হয়, কিন্তু ঝড় কেটে গেলে তা আর কোনো কাজে আসে না।
ব্রুনি-লো নিজেও এমন কিছু স্লোগানের কারিগর — যেমন নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টির জন্য 'চেঞ্জ পলিটিক্স ফর গুড', আর মন্টেনিগ্রোর ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাকভ মিলাতোভিচের বিজয়ী প্রচারণার জন্য 'ইটস টাইম', যেখানে তার লক্ষ্য ছিল দেশটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করা।
তার বইয়ে একটি পুরো অধ্যায় তিনি উৎসর্গ করেছেন 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' (এমএজিএ) স্লোগানকে — যা তার নিয়মের সাথে মিলে না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, ২০১২ সালে ট্রাম্প টাওয়ারের ২৬ তলায় নিজের ডেস্কে বসে তিনি এই স্লোগানটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ব্রুনি-লো বলেছেন, 'গ্রেট এগেইন' রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
১৯৫০ সালে কনজারভেটিভ পার্টি 'মেক ব্রিটেন গ্রেট এগেইন' স্লোগান নিয়ে সাধারণ নির্বাচনে লড়েছিল, তবে সফল হয়নি। এর অনেক পরে, ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রেগান 'লেট'স মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' স্লোগান ব্যবহার করে সফল হয়েছিলেন।
ব্রুনি-লো বলেন, ট্রাম্প এই ইতিহাস জানতেন কি না, সেটি শেষ পর্যন্ত খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ ট্রাম্প এমএজিএ-কে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ডে পরিণত করেছিলেন — এমন একটি বিভাজনরেখা তৈরি করেছিলেন যা ভালো হোক আর খারাপ হোক, আমেরিকার রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে।
ট্রাম্প এমনকি এটি যাতে অন্য রাজনীতিকরা ব্যবহার না করতে পারে, সেজন্য মাত্র ৩২৫ ডলার ফি দিয়ে মার্কিন ট্রেডমার্ক অফিসে স্লোগানটি নিবন্ধনও করেছিলেন।
যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে স্মরণীয় রাজনৈতিক স্লোগান সম্ভবত ব্রেক্সিট প্রচারণার 'টেক ব্যাক কন্ট্রোল'।
এটি সংক্ষিপ্ত, ঝটপট তিন শব্দের স্লোগানের দিকে একটি প্রবণতার অংশ ছিল — একসময় মনে করা হতো, তিন শব্দের স্লোগানই জয়ের চাবিকাঠি।
গত বছর লেবার পার্টি সাধারণ নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছিল আর তাদের বার্তাটি এক কথায় সীমাবদ্ধ ছিল — 'চেঞ্জ'।
এর বিপরীতে, কনজারভেটিভ পার্টির স্লোগানটি ছিল অনেক দীর্ঘ আর কম আকর্ষণীয় — 'ক্লিয়ার প্ল্যান, বোল্ড অ্যাকশন, সিকিউর ফিউচার'। যদি ভুলে গিয়ে থাকেন, এটিই ছিল তাদের স্লোগান!
কিন্তু শিগগিরই হয়তো প্রচলিত অর্থে আর কোনো স্লোগান থাকবে না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন ক্রমেই ব্যবহার হচ্ছে ভোটারদের ব্যক্তিগত উদ্বেগের উপর ভিত্তি করে বার্তা তৈরি করতে — যা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং সর্বোচ্চ প্রভাব ফেলার জন্য বারবার বদলানো হচ্ছে।
ব্রুনি-লো আরও উল্লেখ করেছেন যে, স্নায়ুবিজ্ঞানের (নিউরোসায়েন্স) প্রতি আগ্রহও বাড়ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিংয়ের (এফএমআরআই) কথা বলেছেন, যা রক্তপ্রবাহের পরিবর্তন দেখে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পরিমাপ করে।
এটি গবেষকদের সাহায্য করছে রাজনৈতিক বার্তা, প্রচার বিজ্ঞাপন, ভাষণ বা নির্বাচনী স্লোগানের প্রতি মানুষের স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য।
এই নতুন প্রবণতাগুলো গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে মূলত বদলে দিতে পারে, নির্বাচিত প্রতিনিধি আর ভোটারদের সম্পর্কের ধরনটাকেও নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারে।
তবে এর ফলে আমরা হয়তো কিছু বিরক্তিকরভাবে মনে আটকে যাওয়া নির্বাচনী স্লোগানও হারিয়ে ফেলতে পারি।
এই ধরনের স্লোগানের সবচেয়ে ভালো উদাহরণগুলোর একটি ছিল ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম দিকের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে একটি।
এই ৬০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটি রিপাবলিকান প্রার্থী ডুইট ই. আইজেনহাওয়ারকে, যিনি 'আইক' নামে পরিচিত ছিলেন, মানুষের কাছে আরও আপন করে তোলার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।
কম্পোজার ইরভিং বার্লিনের অত্যন্ত ছোঁয়াপড়া একটি সঙ্গীতসংবলিত 'আই লাইক আইক' স্লোগানটি ডিজনির একটি কার্টুন হিসেবে বানানো হয়েছিল, যা সবচেয়ে বিস্তৃত দর্শককে আকর্ষণ করার লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছিল।
এই প্রচারণাটি এতটাই সফল হয়েছিল যে তার পুনঃনির্বাচনের সময় তার প্রচারকারী দল সূত্র পরিবর্তনের প্রয়োজন বুঝে উঠেনি; তারা মাত্র একটি শব্দ যোগ করেছিল, সম্ভবত এরপর দ্রুত দুপুরের খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়েছিল।
'আই স্টিল লাইক আইক' ব্রুনি-লোয়ের সূত্র অনুসরণ করে না — কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি আরেকটি সফল স্লোগান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল।