চিকেনস নেকের ওপর নির্ভরতা কমাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে রেলপথে বাকি দেশের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ ভারতের

২০৩০ সাল নাগাদ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যকে রেলপথে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করার এক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঠিক করেছে দিল্লি। এর মাধ্যমে ২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেনস নেক-এর ওপর দেশটির নির্ভরতা কমানো হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ করিডরকে প্রায়ই ভারতের 'ভূ-রাজনৈতিক চোকপয়েন্ট' (সংকীর্ণ প্রবেশপথ) বলা হয়। নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের মাঝে অবস্থিত এই সংকীর্ণ ভূখণ্ডই মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতকে সংযুক্ত করার একমাত্র স্থলপথ।
আসাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ এবং এখন মিজোরাম—উত্তর-পূর্ব ভারতের এই চার রাজ্য বর্তমানে রেলপথে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত আছে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালডুহমা জানিয়েছেন, ৫১.৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বৈরাবি-সাইরাং লাইনটি শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করতে চলেছেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতে দ্রুত রেল নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ হচ্ছে। আর এই সংযোগ প্রকল্পগুলো কেবল আকারেই বিশাল নয়, এগুলোর মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্রও বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর এই তাগিদের পেছনে আছে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক দুর্বলতা। কারণ এ অঞ্চল ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংকীর্ণ এক ভূখণ্ড দ্বারা যুক্ত। এই করিডরে সামান্য উত্তেজনা বা প্রতিবন্ধকতাও মূল ভারতের ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্রমেই জোরদার হওয়ায় চিকেনস নেক নিয়ে ভারতের উদ্বেগ বেড়েছে।
জাতীয় রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে মিজোরাম
প্রায় ৮ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ বৈরাবি-সাইরাং (আইজলের কাছে) রেললাইনে রয়েছে ৪৮টি টানেল (মোট দৈর্ঘ্য ১২.৮৫৩ কিমি), ৫৫টি বড় ও ৮৭টি ছোট সেতু, ৫টি রোড ওভারব্রিজ এবং ৯টি রোড আন্ডারব্রিজ। এর মধ্যে ১৯৬ নম্বর সেতুর উচ্চতা ১০৪ মিটার, যা কুতুব মিনারের চেয়ে ৪২ মিটার বেশি উঁচু।
রেললাইনটি চারটি ধাপে চালু করা হয়েছে: বৈরাবি-হরতকি (১৬.৭২ কিমি) অংশটি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এবং বাকি তিনটি অংশ—হরতকি-কাওনপুই (৯.৭১ কিমি), কাওনপুই-মুয়ালখাং (১২.১১ কিমি) ও মুয়ালখাং-সাইরাং (১২.৮৪ কিমি)—এ বছরের জুনে চালু হয়।
চ্যালেঞ্জিং ভৌগোলিক অবস্থান সত্ত্বেও রেললাইনটি সফলভাবে আইজলকে বৃহত্তর রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এই প্রকল্প উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ। বৈরাবি ও সাইরাংয়ের মধ্যে এই রেল প্রকল্প শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর।
নির্মাণাধীন অন্যান্য রেল প্রকল্পগুলো কী কী?
উত্তর-পূর্ব ভারতজুড়ে রেল সংযোগ সম্প্রসারণের মিশনে নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেলেও স্থানীয় প্রতিরোধের কারণে মেঘালয়ে এখনও বড় অগ্রগতি হয়নি।
নাগাল্যান্ডে ৮২.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডিমাপুর-কোহিমা রেললাইনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আসামের ধানসিঁড়ি স্টেশন থেকে শুরু হয়ে লাইনটি কোহিমার কাছে জুবজা পর্যন্ত যাবে। এ প্রকল্পে আটটি নতুন স্টেশন—ধানসিঁড়ি, ধানসিঁড়িপাড়, শোখুভি, মলভোম, ফেরিমা, পিফেমা, মেঙ্গুজুমা ও জুবজা—নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ২৭টি বড় সেতু, ১৪৯টি ছোট সেতু, ৫টি রোড ওভারব্রিজ, ১৫টি রোড আন্ডারব্রিজ ও মোট ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ ২০টি টানেলের মতো বড় অবকাঠামোও নির্মিত হচ্ছে। ধানসিঁড়ি ও শোখুভির মধ্যে ১৬.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি অংশ ২০২১ সালের অক্টোবরে চালু হয়। এছাড়া ইতিমধ্যে শোখুভি থেকে অরুণাচল প্রদেশের নাহারলাগুন ও মেঘালয়ের মেন্দিপাথার পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। নির্মাণকাজ শেষ হলে ১৪.৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ শোখুভি-মলভোম অংশটি নাগাল্যান্ডকে উত্তর-পূর্বের সব প্রতিবেশী রাজ্য এবং ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে আরও ভালোভাবে যুক্ত করবে।
মণিপুরের রুক্ষ ভূখণ্ড ও চলমান অস্থিরতা সত্ত্বেও রাজ্যটিতে ১১১ কিলোমিটার দীর্ঘ জিরিবাম-ইম্ফল রেললাইনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে রয়েছে অসংখ্য টানেল ও সেতু। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলওয়ে পিয়ার সেতু, যার নির্মাণকাজ এখন প্রায় শেষের পথে। পরিকল্পিত ৫২টি টানেলের মধ্যে মোট ৬১.৩২ কিলোমিটারের মধ্যে ৫৯ কিলোমিটার টানেল তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেতুর কাজেও বেশ অগ্রগতি হয়েছে; ১১টি বড় সেতুর মধ্যে ৫টি এবং ১৩৮টি ছোট সেতুর মধ্যে ৮১টির কাজ শেষ হয়েছে। এই রেললাইনে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাঙ্গাইহেল টানেলও অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যা হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের দীর্ঘতম রেলওয়ে টানেল।
পশ্চিমবঙ্গের সিভোক ও সিকিমের রাংপো-কে যুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ রেল প্রকল্পটি ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। নর্থইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ের (এনএফআর) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন। এনএফআরের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা (সিপিআরও) কপিঞ্জল কিশোর শর্মা বলেন, ৪৪.৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সিভোক-রাংপো প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে এটি পশ্চিমবঙ্গের হয়ে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটককে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করবে।
তবে মেঘালয়ে এখনও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। রেল সংযোগ বাড়লে বহিরাগতদের আগমন ঘটতে পারে—এই আশঙ্কায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদের কারণে এ রাজ্যে রেল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা স্থগিত রয়েছে। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা সম্প্রতি বলেছেন, রাজ্য সরকার রেল প্রকল্পের জন্য বিকল্প স্থান খুঁজছে।
ভারত কেন চিকেনস নেকের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে
চিকেনস নেক নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের অন্যতম ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতা। এর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশের প্রস্থ মাত্র ২২ কিলোমিটার।
এই সরু ভূখণ্ডই নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আটটি রাজ্যকে যুক্ত করেছে।
এই করিডর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকেনস নেক উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষের লাইফলাইন এবং সামরিক রসদ সরবরাহের প্রধান পথ।
গত বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ করিডর নিয়ে ভারতের উদ্বেগ বেড়েছে। এছাড়া সীমান্তে চীনের ক্রমবর্ধমান তৎপরতাও এ অঞ্চল নিয়ে ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্ভাবনা তৈরির পর থেকে চিকেনস নেকের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত।