ব্যবসায়ীকে হত্যার পর লাশের ওপর প্রকাশ্যে নৃশংসতা: নেপথ্যে ‘অবৈধ’ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব

বুধবার বিকেল। পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল কম্পাউন্ডে তখন তেমন ভিড় নেই। রোগীর স্বজনদের আনাগোনাও কমেছে। ঠিক তখন হাসপাতাল কম্পাউন্ডে শুরু হয় এক নৃশংসতা। লাল চাঁদ মিয়া ওরফে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ীকে ধরে এনে সেখানে পিটিয়ে ও ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়। এরপর নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে কম্পাউন্ডের বাইরের সড়কে এনে শত শত মানুষের সামনে চলে উন্মত্ততা।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলের একটি সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়, লাশ ঘিরে হামলাকারীদের নৃশংসতা। ঘটনার সময় অদূরেই চলছিল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা, নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন আনসার ক্যাম্পের সদস্যরাও। তবে সন্ত্রাসী আতঙ্কে কেউই এগিয়ে আসেননি।
পরে সোহাগকে যখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়, তখন চিকিৎসক জানান, আগেই মারা গেছেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুধু হত্যা করেই থামেনি হামলাকারীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও তারা লাশের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে। রক্তাক্ত নিথর দেহ রাস্তার মাঝখানে ফেলে তার ওপর দাঁড়িয়ে উন্মত্ত উল্লাস করেছে। একজন নয়, একাধিক হামলাকারী লাশের নাক-মুখে এবং বুকের ওপর একের পর এক আঘাত করেছে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সোহাগের অর্ধবিবস্ত্র নিথর দেহ দুই যুবক টেনেহিঁচড়ে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে আসেন। নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা ব্যক্তিদের একজন তখন মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। ওই সময় সোহাগের রক্তাক্ত মুখের ওপর কিল-ঘুষি দিতে থাকেন আরেকজন। আরেকজন দৌড়ে এসে সোহাগের বুকের ওপর লাফাতে শুরু করেন।
প্রকাশ্যে কেন এই নৃশংসতা?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, সোহাগ মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসার সঙ্গে পুরনো বৈদ্যুতিক কেবল কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। তার দোকানের নাম সোহানা মেটাল। ওই এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণ ছিল সোহাগের হাতে।
সেই নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিলেন মাহমুদুল হাসান মহিন ও সারোয়ার হোসেন টিটু। তারা ওই 'অবৈধ' বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন। তা নাহলে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল তারা। এর জেরেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্বে ঘটে এ হত্যাকাণ্ড।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সোহাগ ও হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া মহিন, টিটুসহ অন্যরা ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবেও তাদের সবাই যুবদলের নেতা বলে জানেন। তবে সংগঠনে তাদের কোনো পদ রয়েছে কি না, নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী, আনিসুর রহমান হাওলাদারসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনার মূলহোতা মহিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরেক আসামিকে যৌথ বাহিনী আটক করেছে।
নিহতের ভাগ্নি মীম আক্তার জানান, তার মামার পরিচিত লোকজনই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তার মামা স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসা করতেন। কিন্তু টিটু, মহিনসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন এ ব্যবসায় ভাগ বসাতে চাচ্ছিলেন। তারাও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
তিনি বলেন, 'খুনিরা সোহাগের কাছে ব্যবসার ৫০ শতাংশ অংশীদার দাবি করেছিলেন। নাহলে লাভের ৫০ শতাংশ চাঁদা দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এনিয়ে ওই গ্রুপটি কয়েকদিন আগে তার মামাকে হত্যার হুমকিও দেন এবং তিন দিন দোকানও খুলতে দেয়নি।'
নিহতের আরেক স্বজন জানান, বুধবার দুপুরে সোহাগের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করেন টিটু। ভাত খাওয়ার সময় টিটু সোহাগকে বলেছিলেন, সব মিটমাট করে ফেলবেন। কোনো ঝামেলা ছাড়াই যেন ব্যবসা করা যায়, সেজন্য সবার সঙ্গে বসে একবার কথা বললেই হবে। টিটু এই কথা বলে সোহাগকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করা ৪০ থেকে ৫০ জন সোহাগকে হত্যা করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনের এডিসি আমিনুল কবির তরফদার বলেন, 'হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। আসামিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে।'
যা বলছে যুবদল
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মঈন নামের এজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। তিনি এক সময় ছাত্রদল করতেন। যুবদলের কোথাও তিনি এখনো আসেন নাই। তবে মিছিল-মিটিং করতে পারেন।'
তিনি আরও বলেন, 'অপরাধী যেই হোক, কোনো ছাড় নাই। আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি। যুবদলের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকেও বলা হবে।'
আগামীকাল শনিবার সংবাদ সম্মলেন করে এ বিষয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়ন টিবিএসকে বলেন, 'যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি চকবাজার থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন। অনেকেই প্রার্থী হতে পারেন। ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তারা সরাসরি যুবদলের নেতা বা কর্মী নন। তবে মামলায় আসামিদের মধ্যে থেকে যুবদলের দুইজনের নাম আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলবো, জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে।'