ক্ষমতা যখন যার হাতে থাকে, নৃশংসতাও তার দাসে পরিণত হয়

বিশ্বজিৎরা কখনোই মরেন না। তারা বারবার ফিরে আসেন, নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে, শুধু নির্মম মৃত্যুর জন্য। এটা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্তহীন ট্র্যাজেডি। যখন আমরা জিজ্ঞাসা করি— এই হত্যা, চাঁদাবাজি আর পাশবিক নির্যাতনের জন্য কে দায়ী? আওয়ামী লীগ? বিএনপি? জামায়াতে ইসলামী? তখন সবচেয়ে কঠিন অথচ সঠিক উত্তরটি দাঁড়ায়- ক্ষমতা।
কারণ, ক্ষমতা যখন যার হাতে আসে, নৃশংসতাও তখন তার অনুগত হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে দেশের মানুষ দেখল এক পৈশাচিকতা। জনসমক্ষে পাথর দিয়ে আঘাত করে হত্যা, তারপর উল্লাস— এ দৃশ্য সভ্যতা ও আইনের মুখে কষাঘাত। পরে জানা গেল, অভিযুক্তরা বিএনপির যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যাদের তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক তার আগেই, এক বহিষ্কৃত যুবদল নেতাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে আরেকটি পক্ষ।
মাত্র কিছুদিন আগেই, কক্সবাজারে তিন সন্তানের বাবা এক যুবলীগ নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়। তার জানাজায় জনসমুদ্র প্রমাণ করে মানবিকতা রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে, যদি তা সমাজে প্রকৃতভাবে অনুরণিত হয়।
গত ১১ মাসে শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। আবার এই দলের শাসনকালেই গুম, খুন, অপহরণের অসংখ্য অভিযোগ বিরোধী দলগুলোর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। এ ইতিহাস আমাদের সামনে একটি আয়নার মতো দাঁড়িয়ে যায়, যেখানে নির্যাতক কেবল বদলায়, কিন্তু নির্যাতনের রূপ বদলায় না।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এ ভয়াবহতাকে আরও স্পষ্ট করে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর সহিংসতা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতি ও দলীয় দ্বন্দ্বে প্রাণ হারিয়েছেন বহু রাজনৈতিক কর্মী।
সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে 'মব জাস্টিস'। আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এতটাই ভেঙে পড়েছে যে বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা ভয়াবহ হারে বেড়েছে।
ডয়চে ভেলে ও অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে পরবর্তী ১০ মাসে মব জাস্টিসে নিহত হয়েছেন ১৪০ জনের বেশি। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক পরিবারের তিন সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা এ বর্বরতার মাত্রা ও বিচারহীনতার ভয়াবহতা একসাথে দেখিয়ে দিয়েছে।
এই চিত্র বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; এটি আমাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বিচার ব্যবস্থার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। যখন দেখা যায়, জঙ্গিরা সহজে পালিয়ে যেতে পারে, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা অনায়াসে জামিন পায়, কিন্তু শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে শত শত মানুষ বছরের পর বছর বিচার থেকে বঞ্চিত থাকে, তখন সমাজ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকেই ন্যায্য মনে করে।
এই প্রেক্ষাপটে যখন অধ্যাপক ড. ইউনূসের মতো বর্ষীয়ান ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের থেকে মানুষ একটি দৃঢ় অবস্থান ও নৈতিক হস্তক্ষেপ আশা করে, তখন তাদের নীরবতা হতাশ করে। হয়তো তাদের সক্রিয় ভূমিকা কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে সঠিক পথে আনতে পারত। কিন্তু সেই সদিচ্ছা বা প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়।
মোটকথা, এখানে কেউ নির্দোষ নয়। এ দেশে রাজনীতির প্রতিটি বড় দলই কোনো না কোনো সময় রক্তাক্ত ইতিহাসের অংশ হয়েছে। আর সেই ইতিহাসে ক্ষমতাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বিপজ্জনক অশুভ শক্তি। মব জাস্টিস, গুম, রাজনৈতিক হত্যা—এ চক্রই বাংলাদেশকে করে তুলেছে এক আতঙ্কের জনপদ।
প্রশ্ন রয়ে যায়— এই রক্তমাখা ক্ষমতার রাজনীতি থেকে বাংলাদেশ আদৌ কোনোদিন মুক্তি পাবে কি?
লেখক: পিএইচডি গবেষক, লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র