শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প; পোস্টার, ক্যালেন্ডার, প্রশিক্ষণেই খরচ ২৬ কোটি টাকা

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা ব্যয় করেও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল দুই দশক পুরোনো শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা হালনাগাদ ও শব্দের মাত্রা পরিমাপে সারাদেশে রিয়েল-টাইম মনিটরিং যন্ত্র বসানো—কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। বরং প্রকল্পের প্রায় ২৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে পোস্টার, ক্যালেন্ডার, প্রশিক্ষণসহ নানা উপহার সামগ্রীর পেছনে।
২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদী 'ইন্টিগ্রেটেড অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি প্রজেক্ট টু কন্ট্রোল নয়েজ পলিউশন' নামের এই প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ৫৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা—যার একটি বড় অংশই অপ্রয়োজনীয় খাতে গেছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু প্রচারণামূলক সামগ্রী কিনতেই ব্যয় হয়েছে ১৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে পোস্টার, ফেস্টুন, খাতা, কলম ও ব্যাগ। এছাড়া ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, পরিবহন শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস কক্ষ ঘুরে দেখা গেছে, এসব ব্যয়বহুল সামগ্রী—কলমদানি, ক্যালেন্ডার, পেপার ওয়েট—কর্মকর্তাদের ডেস্কে শোভা পাচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের সামগ্রী বিভিন্ন প্রকল্প থেকেই তৈরি ও বিতরণ করা হয়।
প্রকল্পের আওতায় আরও কেনা হয়েছে টি-শার্ট, ক্যাপ, ব্যাগ, বুকলেট, খাতা ও কলমসহ প্রচুর পরিমাণে সচেতনতামূলক উপকরণ। তবে আইএমইডি বলছে, এসব সামগ্রীর ব্যবহার হয়েছে খুব কম; বেশিরভাগই পড়ে আছে অপ্রয়োজনে।
এছাড়া একাধিক পণ্যের জন্য খরচও দেখানো হয়েছে বাজারদরের পাঁচ-সাতগুণ বেশি। যেমন—মাত্র ১২ পৃষ্ঠার একটি টেবিল ক্যালেন্ডার তৈরি করতে খরচ দেখানো হয়েছে ১ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ১০০ থেকে ১২০ টাকা। কলমদানি কেনা হয়েছে প্রতিটি ১ হাজার টাকায়, যার বাজারদর ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।
প্রকল্পের আওতায় শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ সংশোধনের কথা থাকলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়া দেশের ৬৪ জেলায় শব্দ পরিমাপক মনিটরিং স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্যে ১৩টি রিয়েল-টাইম মনিটর বসানোর কথা বলা হলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, বাস্তবে এসব যন্ত্র কোথাও স্থাপন করা হয়নি। অথচ কাগজে-কলমে এ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং হাইড্রোলিক হর্ন ধ্বংস। কিন্তু চার বছর ছয় মাসে মাত্র ১,৭৪৯টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। দায়ের করা হয়েছে ৬,৩৩১টি মামলা এবং আদায় হয়েছে মাত্র ৮১.১৮ লাখ টাকা জরিমানা।
এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলায় ২টি করে মোট ১২৮টি শব্দসচেতনতামূলক বিলবোর্ড স্থাপনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা, প্রতিটির জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এছাড়া ৬০টি স্থানে বসানো সাইনবোর্ডের প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। অফিস সরঞ্জামাদি কেনায় ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা, যার মধ্যে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে ৩০০টি সাউন্ড মিটার কেনায়—প্রতিটির দাম ৩৮ হাজার টাকা হিসেবে। তবে মাঠপর্যায়ে এসব যন্ত্রের কার্যকর ব্যবহার দেখা যায়নি।
শব্দের মাত্রা পরিমাপ, প্রদর্শন ও রিয়েল টাইম মনিটরিং যন্ত্র ১৩টি স্থাপনের জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে প্রকল্প পরিচালক নিজেই স্বীকার করেছেন, এসব যন্ত্র কোনো স্থানেই স্থাপন করা হয়নি।
জেলার বিভিন্ন স্থানে শব্দ দূষণবিষয়ক সাইনবোর্ড বসানো হলেও সেগুলোর সঙ্গে কার্যকর কোনো পরিমাপক যন্ত্র সংযুক্ত ছিল না। এমনকি অনেক জায়গায় সচেতনতামূলক নোটিশ বোর্ডও অনুপস্থিত। আর যে সব বোর্ড বসানো হয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এখন ছেঁড়া বা নষ্ট অবস্থায় রয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার প্রকল্প পরিচালকের
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে অনিয়ম বা অপচয়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমেদ। তার দাবি, প্রকল্পের সকল ব্যয়ই পূর্ব অনুমোদিত এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। প্রকল্পে কিছু কাজ পিছিয়ে যাওয়ায় এক বছরের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে ফরিদ আহমেদ বলেন, 'কিছু কাজ বাকি থাকায় প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। আইএমইডির অভিযোগগুলো বাস্তবসম্মত নয়। তারা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় না করেই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।'
কলমদানি ও ক্যালেন্ডারের উচ্চমূল্য নিয়ে উঠা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কলমদানি ও ক্যালেন্ডারের জন্য অতিরিক্ত খরচ হয়নি, বরং ৩০০ ও ১৫০ টাকার মধ্যেই কেনা হয়েছে। এগুলো সচেতনতামূলক উপকরণ হিসেবে কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।'
প্রকল্পের মূল কাজগুলো—শব্দ পরিমাপক যন্ত্র স্থাপন ও বিধিমালা সংশোধনের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, 'বিধিমালা হালনাগাদের কাজ চলছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে এটি সম্পন্ন করা যাবে। কয়েকটি স্থানে ডিজিটাল বোর্ডসহ শব্দ পরিমাপক যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে।'
তবে এসবকে তিনি বড় কাজ হিসেবে দেখছেন না। তার মতে, 'প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনসচেতনতা সৃষ্টি, যেখানে তারা অনেকটাই সফল হয়েছেন।'
তবে আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্প পরিচালকের এসব দাবির সঙ্গে স্পষ্ট দ্বিমত প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বিলবোর্ড সাধারণ মানুষের নজরেই পড়েনি। এমনকি এক-তৃতীয়াংশ বিলবোর্ড ছেঁড়া বা অনুপস্থিত ছিল। প্রকল্পে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০০টি সাউন্ড মিটার কেনার কথা বলা হলেও সেগুলোর বাস্তব ব্যবহার যাচাই করা যায়নি।
আইএমইডির নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান 'ইন্টিগ্রেড সল্যুশনস লিমিটেড'-এর এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, 'ফিল্ড সার্ভে শুরুর সময় বেশিরভাগ জেলায় কোনো সচেতনতামূলক উপকরণ চোখে পড়েনি। পরবর্তীতে হঠাৎ করেই কয়েকটি স্থানে তড়িঘড়ি করে বোর্ড বসানো হয়। প্রকল্পে "ইন্টিগ্রেটেড" শব্দটি থাকলেও চিকিৎসক, পুলিশ ও নীতিনির্ধারকদের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করা হয়নি।'
আওয়ামী লীগ আমলের বরাদ্দ এসব: পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে ব্যয় করা অর্থের বেশিরভাগই অকার্যকর হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান। তিনি জানান, এই প্রকল্পটি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই শুরু হয় এবং অর্থ বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত কার্যক্রমও তখনই সম্পন্ন হয়।
তিনি বলেন, 'আমার দায়িত্বকালীন সময়ে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। যেসব ক্রয় হয়েছে, সেগুলো আমার আগেই হয়েছে। এখন আমরা প্রকল্পটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছি, যাতে বিভিন্ন খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও সেন্টার ফর অ্যাটমসফেরিক পলিউশন স্টাডিজের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'শব্দ দূষণ এখন শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে পড়েছে জেলা-উপজেলাতেও। এই প্রকল্পে যে টাকা খরচ হয়েছে, তা বাস্তব সমাধানে কাজে আসেনি। আইন প্রয়োগের বাস্তবতা না থাকলে সচেতনতাও কাজে আসে না। মোবাইল কোর্ট বাড়াতে হবে, নির্দিষ্ট এলাকায় "নো হর্ণ জোন" নিশ্চিত করতে হবে।'