জুলাই-জানুয়ারিতে এডিপি ব্যয় কমেছে ১৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা

চলতি অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে মোট ৫৯ হাজার ৮৭৬.৮৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা কম। আগের বছর এই সময়ে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৪৬৪.১৯ কোটি টাকা।
প্রথম সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২১.৫২ শতাংশ, গত অর্থবছরে একই সময়ে তা ছিল ২৭.১১ শতাংশ।
আইএমইডির ওয়েবসাইটে থাকা ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এডিপি বাস্তবায়নে এমন ধস আগে দেখা যায়নি।
সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির মূল কারণ জুলাই মাসের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা।
আন্দোলনের সময় দেশজুড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে গিয়েছিল। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু চলমান প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করেছে এবং অনেক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্প বাতিল করেছে। এসব কারণে উন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ কমে গেছে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানান, আন্দোলনের পর প্রকল্প পরিচালকদের অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। পাশাপাশি অনেকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় প্রশাসনিক অস্থিরতা বেড়েছে। দেশীয় ঠিকাদারদের অনেকে এখনও প্রকল্প এলাকায় ফিরে আসেননি।
বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর বিদেশি ঠিকাদাররাও যথাসময়ে ফিরে আসতে পারেননি। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতির কারণে এডিপি বাস্তবায়নের হার এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে এবং আগামী মাসগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, এডিপি বাস্তবায়ন সাধারণত প্রথম ছয় থেকে নয় মাস ধীর হয়, সাধারণত অর্থবছরের শেষ তিন মাসে উন্নয়ন ব্যয়ের গতি বাড়ে।
তবে এবার আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন ও প্রশাসনিক অস্থিরতার কারণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
ফলে অর্থবছরের শেষ পর্যন্তও এডিপি বাস্তবায়নের হার আশানুরূপ হবে না বলে আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, অতীতের মতো তড়িঘড়ি করে বরাদ্দ খরচের প্রবণতা থাকলে অনিয়মের ঝুঁকি বাড়বে। তাই সরকারের উচিত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি তহবিল থেকে ৩০,০৯৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ১৮.২৪ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এই ব্যয়ের হার ছিল ২৫.৩৫ শতাংশ। বিদেশি সহায়তা থেকে ব্যয় হয়েছে ২৪,৯৬১ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর তা ছিল ২৮,৩৮৪ কোটি টাকা।
সরকার চলতি অর্থবছরের এডিপির ৭৬.৬৫ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে। ফলে এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি মূলত এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে।
এডিপি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অগ্রগতি হতাশাজনক। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ মাত্র ৫ শতাংশ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ৯.৬৬ শতাংশ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ১১.৮৪ শতাংশ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ১৬ শতাংশ এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ১৮.১৪ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। অন্যদিকে, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৯.৯১ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে।
তবে কিছু মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি তুলনামূলক ভালো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ৩৬.৫৫ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ ৩৩.৬৪ শতাংশ বরাদ্দ বাস্তবায়ন করেছে।
অন্যদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাত্র ০.৩৩ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ১.৯০ শতাংশ, ভূমি মন্ত্রণালয় ৫.৩১ শতাংশ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৬ শতাংশ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৭ শতাংশ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭.৪১ শতাংশ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৯ শতাংশ এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ৯.৬৬ শতাংশ বরাদ্দ বাস্তবায়ন করেছে, যা এডিপির গড় অগ্রগতির তুলনায় অনেক কম।
সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি কীভাবে বাড়ানো যায় এবং অর্থবছরের বাকি অংশে কীভাবে উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি আনা যায়। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং প্রকল্প বাতিলের কারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবারের এডিপি বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।